গ্যাড়াকলে ভারতের পরাশক্তি হওয়ার অভিলাস

গ্যাড়াকলে ভারতের পরাশক্তি হওয়ার অভিলাস - ছবি : সংগ্রহ
চলমান ভারত ও চীন সঙ্কট, যার পরিণতিতে ১৫ জুন রক্তাক্ত সঙ্ঘাত ঘটে, সোফোক্লেন প্যারাডক্সের প্রকাশ, যা নরেন্দ্র মোদি সরকারের একটি কৌশলগত দোটানা নিরসন থেকে সৃষ্ট।সম্ভাব্য পরাশক্তি হিসেবে বিশ্বপর্যায়ে ভারতের আত্মপ্রকাশের পর থেকে দুই দশক ধরে নয়া দিল্লি তার ভবিষ্যতের ভূমিকার আকঙ্ক্ষার সাথে আসন্ন ভূকৌশলগত নির্দেশনার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। চীনের সাথে চলমান সামরিক অচলাবস্থার মনে হচ্ছে, ওই প্রক্রিয়াটি দৃশ্যত সিদ্ধান্তসূচক পরিণতির দিকে যাচ্ছে, ভারত হয়তো সমন্বয় প্রক্রিয়াটিকে অসম্ভব করে তুলবে।
রবার্ট কাপলান ২০১২ সালে তার একটি গ্রন্থে ভারতের ভৌগোলিক দোটানাকে দেশটির ভূগোল ও ইতিহাসের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত করেছেন। পাকিস্তান ও সেইসাথে চীনের সঙ্গে দীর্ঘ বিরোধপূর্ণ সীমান্ত ও ভূখণ্ডের কারণে, যা উপনিবেশ আমলের জের, নয়া দিল্লির সামরিক শক্তি ভূমির ওপর নজর নিবদ্ধ রেখেছে।
একই সাথে ভারতের পরিমণ্ডলে থাকা নেপালের মতো ছোট দেশগুলো এমনভাবে নতুন প্রাপ্ত রাজনৈতিক এজেন্সি প্রয়োগ করছে, যা ক্রমবর্ধমান হারে নয়া দিল্লির কাছে গ্রহণ করা কঠিন।তারা উপমহাদেশে ভারতের ঐতিহাসিক কোমল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে, ভারতের সীমিত কূটনীতিক শক্তিকে সমস্যায় ফেলেছে।
ভারতের মহাদেশীয় বাধ্যবাধকতার নিট প্রভাব এই যে ভারত মহাসাগরে থার তার শক্তি ও প্রভাব অনেক বেশি প্রতিফলিত করতে পারলেও তার বস্তুগত কৌশলগত মনোযোগ প্রতিবেশী এলাকায় ব্যয় হবে।ভারতের দোটানা এটিই।আবার জানা কথা যে ভারত তার সীমান্তে স্থায়ী শান্তকরণের মাধ্যমেই কেবল শীর্ষস্থানীয় ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাক্টর হিসেবে কাজ করতে পারবে। আর এর মাধ্যমেই সে তার নিজস্ব ভূখণ্ডে শক্তি সুসংহত করতে পারবে, সব প্রতিবেশীর সাথে স্থিতিশীল শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারবে।
গত বছরের নভেম্বরে এক বক্তৃতায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর অস্বাভাবিক খোলামেলাভাবে বলেছিলেন যে অশান্ত সীমান্ত, অ-একীভূত অঞ্চল ও গ্রহণ না করা সুযোগ নিয়ে কোনো জাতি ভবিষ্যতে শীর্ষস্থানীয় শক্তি হতে আকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। এটি একটি যৌক্তিক ব্যাখ্যা।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তান কিন্তু ভারতের বিকল্পগুলো সহজ করার কোনো কাজই করছে না। সাম্প্রতিক সামরিক মতবাদ ও সেইসাথে প্রতিরক্ষা বরাদ্দ বিবেচনা করলে দেখা যাবে, ভারতের প্রতিরক্ষানীতির ওপর রাওয়ালপিন্ডি বড় ধরনের হুমকিই সৃষ্টি করছে।ভারতের ভৌগোলিক দোটানার ফলে বৈশ্বিক উচ্চাভিলাষ নিয়ে শীর্ষস্থানীয় শক্তি হিসেবে ঘোষিত কৌশলগত উদ্দেশ্য এবং তার উপকূলে ঘটনাপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার কূটনৈতিক ও সামরিক পেশীশক্তিরর মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে ভারত যখন ছোট বা বড়- অন্য যেকোনো শক্তির সাথে মতবিনিময় করছে, তখন সে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্কট ভুগছে।
ভারত চাচ্ছে শক্তি দিয়ে সিদ্ধান্তসূচকভাবে পাকিস্তানকে বশ মানতে। কিন্তু তা করার জন্য তার প্রয়োজনীয় সামরিক শক্তি অনেক কম হয়ে পড়েছে। আর সেজন্য ভারত জনশক্তি-ঘন সেনাবাহিনীকেই প্রাধান্য দিচ্ছে।
গত চার বছরে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ২০১৬ সালে বিশেষ বাহিনীর হামলা থেকে শুরু করে গত বছরের বিমান হামলা- সবাই করেছে তার ভৌগোলিক দোটানা নিরসনের জন্য।নয়া দিল্লি যতই তার সীমান্তে অবস্থান সুসংহত করতে চাইছে, বেয়াদব প্রতিবেশীদের শান্ত করতে চাইছে, ততই সামিরক ও কূটনৈতিক প্রয়াসের আলোকে মূল্য অনেক বেশি দিতে হচ্ছে।
পূর্ব লাদাখে চীনের সাথে সঙ্কটে ভারতের সীমান্ত ধাঁধাটি প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলের ভারতের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চীনা প্রতিক্রিয়া অনেক দিক থেকেই পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ততার ধারাটিকে বদলে দিয়েছে। এখন ওই এলাকায় পাকিস্তানের ভূখণ্ডগত নিয়ন্ত্রণ হারানো মানে চীনা অব্স্থানই ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
আবার সীমান্ত ধাঁধা অপ্রত্যাশিত কৌশলগত ফলাফল সৃষ্টি করছে।
কোভিড-১৯ মহামারির ফলে ভারতের সামরিক ব্যয়ে কড়াকড়ি আরোপ হবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি লাদাখে চীনের বর্তমান অনুপ্রবেশের আগেই ভারতের প্রতিরক্ষা অগ্রাধিকার নিহিত ছিল দেশের সীমান্ত ও আসন্ন সামুদ্রিক হুমকি সামাল দেয়া, সামরিক অভিযান চালানার সক্ষমতা অর্জনের নয়।
জেনারেল রাওয়াত এমনকি বিমানবাহী ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে সাবমেরিনকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছেন এ কারণেই। আবার প্রতিরক্ষা বাজেট কমানো হলে ভারত তার সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিতে বিমান বাহিনীর ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। কিন্তু সেটা করতে হলে আন্তঃবাহিনী আমলাতান্ত্রিক জটের মধ্যে পড়তে হবে ভারতকে।এতে বোঝা যাচ্ছে, ইন্দো-প্যাসিফিকে ভারতের ক্ষমতার প্রক্ষেপণ ভবিষ্যতে বেশ ম্লান হয়ে পড়বে।
আর তা ভারতের সীমান্ত ধাঁধার ট্রাজিক পরিণতির দিকে যেতে পারে।অন্যতম বৈশ্বিক অ্যাক্টর হওয়ার প্রক্রিয়ায় ভারতকে তার ভূখণ্ডে প্রথম ক্ষমতা সুসংহত করতে হবে এবং বৈরী প্রতিবেশীদের বলপ্রয়োগে দমন করার ক্ষমতা ধারণ করতে হবে। এ দুটি করতে পারলে তারা দ্বিধাহীনভাবে ক্ষমতার প্রক্ষেপণ করতে পারবে। আর পরাশক্তি হতে গেলে এমনটি করতেই হয়।কিন্তু প্রতিবেশী এলাকায় নিষ্পত্তির প্রক্রিয়ায় ভারত যে অবস্থায় পড়েছে, তা থেকেই এখন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর