ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রতত্ত্বের প্রভাব

ড. ফোরকান উদ্দিন আহাম্মদ | Aug 22, 2020 07:04 pm
ম্যাকিয়াভেলি

ম্যাকিয়াভেলি - ছবি : সংগৃহীত

 

মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলির জন্ম হয় ১৪৬৯ সালের ৩ মে ইতালির ফ্লোরেন্সে এক অ্যাটর্নির ঘরে। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন ইতালি রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত। এটা দেখে বৃহৎ ইতালি রাজ্যের স্বপ্ন ও স্বদেশপ্রেম ম্যাকিয়াভেলিকে একটি রাজনৈতিক দর্শনের দিকে ধাবিত করে। তিনি ইতালি সরকারের বিভিন্ন বড় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ফলে তার রাজনৈতিক তত্ত্বের বিরাট অংশ তার কর্ম-অভিজ্ঞতা ও বাস্তব জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই রচিত। তার লেখা বইগুলোর মধ্যে দ্য প্রিন্স, ফ্লোরেনটাইন হিস্টরিজ, দ্য ডিসকোর্স, দ্য আর্ট অব ওয়্যার উল্লেখযোগ্য। এগুলোর মধ্যে দ্য প্রিন্সের জন্যই তিনি আজ স্মরণীয় এবং উল্লেখযোগ্য। আলোচিত আর সমালোচিত এ বইটি লেখা হয়েছিল ১৫১৪ সালে কিন্তু প্রকাশ পেয়েছিল ১৫৩২ সালে, তার মৃত্যুর পর।

দ্য প্রিন্স বইটিতে ম্যাকিয়াভেলি লিখেছেন ‘শাসনক্ষমতার বৈধতা কোনো নৈতিকতার মাপকাঠিতে আবদ্ধ নয়; কর্তৃত্ব আর ক্ষমতাই এখানে মূল বিষয়। যার ক্ষমতা আছে সে-ই শাসন করবে, নৈতিকতা কাউকে ক্ষমতায় বসায় না। ক্ষমতা অর্জন আর ক্ষমতা রক্ষা করাই রাজনীতির মূলনীতি। ক্ষমতার উপযুক্ত ব্যবহার দিয়েই জনগণের আনুগত্য অর্জন করতে হয়। রাজনীতি মানেই হলো ক্ষমতা ‘গ্রহণ আর প্রয়োগের’।

নীতিকথাটি শুনতে যতই কঠিন আর রূঢ় শোনাক না কেন, বাস্তবতা এটাকেই সমর্থন করে আসছে। বইটিতে তিনি একটি দেশের উন্নয়নের জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা ও দীর্ঘ শাসনের ওপর জোর দেন। এতে শাসক তার শাসনক্ষমতা ধরে রাখার জন্য জনগণের আকাক্সক্ষা অনুযায়ী কিভাবে কাজ করবে তার বর্ণনা রয়েছে। পাশাপাশি, তিনি প্রশাসন ও প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যদের বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহারের কৌশলগুলোর ওপর বিস্তারিত বর্ণনা করেন। বইটিকে আধুনিক রাজনৈতিক দর্শনের প্রথম লেখা হিসেবে কৃতিত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কেননা, এতে মূর্ত ধারণার পরিবর্তে কার্যকরি সত্য গ্রহণ করা হয়েছে।

ম্যাকিয়াভেলি ‘দ্য প্রিন্স’ ও ‘ডিসকোর্সের’ মধ্যে যে রাষ্ট্রদর্শন প্রচার করেছেন তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো মানব প্রকৃতি ও মনোভাব সম্পর্কে তার ধারণা। ম্যাকিয়াভেলির মতানুসারে, মানুষ প্রকৃতিগতভাবে খারাপ। তার মধ্যে ভালো বা সদগুণ বলে সহজাত কোনো জিনিস নেই। তিনি মানুষকে ‘দুর্বলতা, ভ্রম ও শঠতা’র এমন একটি যোগফল বলে বিবেচনা করেন, যে চতুর লোকের হাতে পড়ে বোকায় পরিণত হয় এবং যাকে স্বেচ্ছাচারী শাসক তার স্বেচ্ছাচারিতার শিকারে পরিণত করে’। সাধারণভাবে মানুষকে তিনি ‘অকৃতজ্ঞ, চঞ্চল, প্রতারক, কাপুরুষ ও লোভী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো- তার থেকে সবল কোনো শক্তির দ্বারা বাধ্য না হলে সে ভালো কিছু করতে চায় না। স্বার্থপরতা ও কলহপ্রিয়তা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। সুতরাং সে সুযোগ পেলেই অন্যায় কর্মে লিপ্ত হতে চায়। তা ছাড়া মানুষ চায়, সব থেকে ভালো জিনিসটি তার হোক এবং তার ভাগেই সবচেয়ে বেশি পড়ুক। মোট কথা, মানুষের লোভ-লালসার সীমা নেই। সে চায় গোটা বিশ্বকেই গ্রাস করতে। মানুষের এই সহজাত স্বার্থপরতা ও লোভ-লালসার কারণে তাদের মধ্যে অবিরাম দ্বন্দ্ব-কলহ লেগেই থাকে এবং আইনের সবল হস্তে ব্যাহত না হওয়া পর্যন্ত তারা সমাজজীবনকে নৈরাজ্যিক অবস্থায় পরিণত করতে চায়।

ম্যাকিয়াভেলি বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্রই হচ্ছে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং সেদিক দিয়ে তা অন্য কোনো উচ্চতার ক্ষমতার অধীন হতে পারে না। মধ্যযুগে সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হতো যে, পার্থিব ও ক্ষমতা হিসেবে রাষ্ট্রধর্ম, নৈতিকতা, ঐশ্বরিক আইন বা প্রাকৃতিক আইনের উচ্চতর ক্ষমতার অধীন। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলি এসব ক্ষমতাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে ঘোষণা করেন, এগুলো সব বাজে কথা, রাষ্ট্রই হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতা এবং তার ওপর কোনো উচ্চতর ক্ষমতা থাকতে পারে না। ম্যাকিয়াভেলি আরো বিশ্বাস করেন, চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে রাষ্ট্র তার অস্তিত্ব, নিরাপত্তা ও সম্প্রসারণের জন্য যা কিছু অনুকূল, তাই করতে পারে। এতে ধর্ম বা নৈতিকতা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। তার মতে, রাষ্ট্রকে সবসময় যে ধর্ম ও নৈতিকতার পথ ধরে চলতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। ম্যাকিয়াভেলি অবশ্য মনে করেন, ধর্ম ও নৈতিকতার পথ অনুসরণ করে রাষ্ট্র যদি তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে তবে তা হবে সর্বাপেক্ষা উত্তম। কিন্তু যেহেতু মানুষ প্রকৃতিগতভাবে দুর্নীতিপরায়ণ, প্রতারক, লোভী ও হিংসুটে, কাজেই এ পথে চলে রাষ্ট্র কোনো দিনই তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বাধাপ্রাপ্ত হতে হবে। সুতরাং ধর্ম বা নৈতিকতার কথা আদৌ চিন্তা না করে রাষ্ট্র তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য ‘যা কিছু অনুকূলে’ তাই করে যাবে। তার মতে, রাষ্ট্র যদি চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করতে পারে, মাধ্যম যতই নিচ বা ঘৃণ্য হোক না কেন অর্জিত সাফল্যই মাধ্যমের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, লক্ষ্য মাধ্যমের যৌক্তিকতা বিধান করে, মাধ্যম লক্ষ্যের নয়।

ম্যাকিয়াভেলি যেখানে সম্ভব, সেখানে প্রজাতান্ত্রিক শাসন এবং যেখানে প্রয়োজন সেখানে রাজতান্ত্রিক শাসনের কথা বলেছেন। অভিজাততন্ত্র ও অমাত্য ব্যক্তিদের শাসন সম্পর্কে তার অত্যন্ত হীন ধারণা ছিল। তার মতে, সম্ভ্রান্ত অভিজাতদের স্বার্থ রাজা বা জনসাধারণ কারো স্বার্থের অনুকূল নয়। এরা রাষ্ট্রের শান্তি ও স্থায়িত্বের ঘোর দুশমন, কাজেই সুশৃঙ্খল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এদেরকে সমূলে বিনাশ করা প্রয়োজন। সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে ম্যাকিয়াভেলির ধারণা হলো- ‘এসব ভদ্দর লোকেরা তাদের সম্পদ থেকে আহরিত লভ্যাংশের ওপর আলস্যপূর্ণ জীবনযাপন করে, কিন্তু সমাজের আদৌ কোনো উপকার করে না। তারা সর্বত্র সরকারি শাসনের দুশমনিতে লিপ্ত থাকে।’

রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ম্যাকিয়াভেলি যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন তার একটি বড় কারণ হলো- তিনি জাতীয় রাষ্ট্রের প্রথম প্রবক্তা। প্রাচীন যুগ যেমন ছিল নগররাষ্ট্রের যুগ এবং মধ্যযুগ বিশ্বজনীন সাম্রাজ্যের যুগ, তেমনি বর্তমান যুগ হলো জাতীয় রাষ্ট্রের যুগ। সুতরাং জাতীয় রাষ্ট্রতত্ত্বের জনক হিসেবে আমরা ম্যাকিয়াভেলিকে একজন যুগস্রষ্টা চিন্তাবিদ বলেও আখ্যায়িত করতে পারি। আমরা বলতে পারি, ম্যাকিয়াভেলিকে শুধু ‘ম্যাকিয়াভেলিবাদদের’ জন্মদাতা হিসেবে চিহ্নিত করা অনুচিত। তার চিন্তাধারার মধ্যে যে আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে তার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়নি। এ কথা অনস্বীকার্য, ষোড়শ শতাব্দীতে যদি ম্যাকিয়াভেলির আবির্ভাব না হতো, তাহলে হয়তো আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার জন্ম আরো দীর্ঘ দিন বিলম্বিত হয়ে যেত। রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে ম্যাকিয়াভেলির মূল্য নির্ধারণ করতে গিয়ে ডব্লিউ টি জোনস বলেন, ‘রাষ্ট্রকে শুধু যে মানুষের লোভ ও ক্ষুধার পরিপ্রেক্ষিতে বোঝা যায়, ম্যাকিয়াভেলির এই অন্তর্দৃষ্টি এবং লোভ ও ক্ষুধার এই শক্তি কী করে দমন করতে হয় একজন সফল শাসকের তা অবশ্যই জানা প্রয়োজন, ম্যাকিয়াভেলির এই পরবর্তী স্বীকৃতি, রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে এক নবযুগের সূচনা করে এবং তা আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তার সার্বিক বিকাশের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

ম্যাকিয়াভেলির মতে, মানুষের স্বাভাবিক হীন চরিত্রকে ‘সামষ্টিক ভালো’তে পরিণত করার সবচেয়ে ভালো হাতিয়ার হচ্ছে রাষ্ট্র। নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি সামরিক সক্ষমতায় বিশ্বাসী ছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি সফল সরকারের অবশ্যই একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনী প্রয়োজন। দেশের প্রতিটি নাগরিককে অপর নাগরিকের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব সামরিক বাহিনীর। তার মতে, সে রাষ্ট্রই সফল যার নাগরিকরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে যে, তাদের প্রতি কোনো অন্যায় হতে পারে না কিংবা হলেও তারা তার সঠিক বিচার পাবে।

এখন দেখতে হবে, বাংলাদেশের এই সরকার সাধারণ মানুষের এই স্বাভাবিক হীন চরিত্রকে কিভাবে সামস্টিক ভালোতে পরিণত করতে পারে। অনেকের মতে, সারা ইউরোপের এই উন্নয়ন পুরোটাই ম্যাকিয়াভেলির তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই পরিচালিত। আর সে কারণে ইউরোপিয়ানরা রাস্তাঘাটে আইন মেনে চলে, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-ফ্যাসাদ এড়িয়ে চলে, কেউ বেশি গরিবও নয়, আবার কেউ মাত্রাতিরিক্ত ধনীও নয়। অফিস আদালতে কোনো ঘুষবাণিজ্য নেই, টেন্ডারবাণিজ্য নেই, মন্ত্রিপরিষদে কেউ দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হয় না। মানুষের দাবি আদায়ের জন্য হরতাল-ধর্মঘট করতে হয় না। নাগরিকের মৌলিক সমস্যার সমাধান রাষ্ট্রই করে থাকে। শিক্ষা, চিকিৎসা নিতে এসে মানুষ প্রতারিত হয় না। রাষ্ট্র যদি নাগরিককে কাজ দিতে না পারে তাহলে রাষ্ট্র তাকে বেকার ভাতা দেয়। এই কাজগুলো যদি বাংলাদেশের সরকার করতে পারে। তাহলে সাধারণ মানুষ একদিন অ্যারিস্টটলের গণতন্ত্রের কথা ভুলে গিয়ে সুনাগরিক হয়ে যাবে; রাষ্ট্রের সেবক হয়ে যাবে। ম্যাকিয়াভেলির মতে, ‘সামষ্টিক ভালোর জন্য কোনো কাজ করতে গেলে নৈতিক-অনৈতিক বিবেচনার কোনো প্রয়োজন নেই’। এটা বর্তমান সরকার সুনিপুণভাবে করেই যাচ্ছে। অবশ্য ম্যাকিয়াভেলি যা-ই বলেছেন তার মূল লক্ষ্য ছিল একটি আদর্শ শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন।

মধ্যযুগে প্রাকৃতিক অপেক্ষা অপ্রাকৃতিক ধারণাগুলো মানুষের চিন্তাকে অধিক প্রভাবিত করত। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীতে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশ লাভ করার ফলে অতিপ্রাকৃতিক ধারণাগুলোর পরিবর্তন হয় এবং মানুষকে তার বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিফলিত দেখতে পাওয়া যায়। এভাবে রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, স্বাধীনতাসহ সবকিছু সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মেষ ঘটে এবং সমগ্র ইউরোপে নতুন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এই পরিবেশ ম্যাকিয়াভেলির চিন্তাধারাকেও স্পর্শ করে এবং তার রাষ্ট্রচিন্তার সর্বত্র এর সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয়। প্রধানত এসব কারণে ম্যাকিয়াভেলিকে আধুনিক জাতীয় রাষ্ট্রের জনক বলে অভিহিত করা হয়।

লেখক : সাবেক উপ-মহাপরিচালক, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us