এখন কী হবে?
এখন কী হবে? - ছবি : সংগৃহীত
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ইসরাইলের সাথে কয়েক বছর ধরে অনানুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পর অবশেষে চূড়ান্তভাবে একটি আনুষ্ঠানিক ‘শান্তি চুক্তিতে’ উপনীত হয়েছে। এর ফলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে দুই দেশের মধ্যে একটি কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির পথ খুলে গেল।
গত চার বছর ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনের ওপর যে হামলা চালিয়ে আসছিলেন- এই চুক্তির মাধ্যমে তাদেরকেই পুরস্কৃত করা হলো। এই চুক্তি স্বাক্ষর এবং এর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার মাধ্যমে নেতানিয়াহুর কোয়ালিশন সরকারকেই যেন শক্তিশালী করা হলো। এর মাধ্যমে ইসরাইলের দখলদারিত্বকে আরো গভীর এবং আরবের স্বৈরাচারী শাসকদের সাথে ইসরাইলের জোটবদ্ধ হওয়াকে আরো জোরদার করা হলো। এ দিকে পশ্চিমা মিডিয়ায় কথিত এই শান্তি চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক’ সাফল্য বলে স্বাগত জানানো হয়েছে। অপর দিকে ইউএই নেতৃবৃন্দ ইসরাইলের আরব ভূমি জবর দখল বন্ধ করার অছিলায়, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্য পূরণের সহায়তা প্রদানের জন্য এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের এই চুক্তি করা হয়েছে বলে সাফাই গাইছেন।
আরব আমিরাত হয়তো ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের আরো জবরদখল বন্ধ করার কৃতিত্ব পাওয়ার আশা করতে পারে। কিন্তু অধিকৃত পশ্চিম তীরের তৃতীয় একটি অংশ অবৈধভাবে দখল করার যে পরিকল্পনা নেতানিয়াহু করেছিলেন, তা বহু আগেই ইউএইর ডি ফেক্টোলিডার আবুধাবির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের উদ্যোগ গ্রহণের আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে।
আরব এবং আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে তীব্র বিরোধিতার কারণে ট্রাম্প প্রশাসন আরব ভূমি জবরদখলের ব্যাপারে নেতানিয়াহুকে সবুজ সঙ্কেত দিতে নিরুৎসাহিত হয়েছেন। তখন এমনকি, নেতানিয়াহুর নিজের কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার বেনি গান্টজও এর বিরোধিতা করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আমিরাতিরা ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে প্রকারান্তরে তাদের বেপরোয়া প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি মই হাতে তুলে দিয়েছেন। অধিকন্তু, দখলদারিত্ব হচ্ছে সত্যিকারের সমস্যার নিছক একটি বাইপ্রডাক্ট বা উপজাত। ইসরাইলের দখলদারিত্ব এবং অবৈধ বসতি যে কারণে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে গেছে- ইউএইকে সেটির প্রশমিতকরণের জন্য ধন্যবাদ।
এখনো আমিরাত জোর দিয়ে বলছে যে, তারা ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে সৌহার্দ্য প্রকাশ করে তাদের ‘একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের অধিকার ও মর্যাদার প্রতি জোর সমর্থন জানাচ্ছে’। এটা হলো আমিরাতি স্টাইলের ‘ধূর্ততা’। ইসরাইলের সাথে নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে সহযোগিতার ব্যাপারে আমিরাত দীর্ঘ দিন ফিলিস্তিনিদেরকে অন্ধকারে রেখেছে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা অথবা নিজেদের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের ইচ্ছা এবং এ ব্যাপারে ঘোষণা প্রদানের ব্যাপারে ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সাথে তারা কোনো আলোচনা বা সমন্বয় করেনি। প্রকৃত পক্ষে, তারা পক্ষত্যাগকারী বিশ্বাসঘাতক ফিলিস্তিনি নেতা মোহাম্মদ দাহলানকে সমর্থন দিয়ে ফিলিস্তিনি ঐক্যকে অব্যাহতভাবে হেয়প্রতিপন্ন করেছে। ফিলিস্তিনিরা আমিরাতের এই তৎপরতাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’, ‘আগ্রাসন’ এবং ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিক্রি করে দেয়ার অপপ্রয়াস বলে নিন্দা জানিয়েছেন। সর্বোপরি, ফিলিস্তিনিদের কথিত কল্যাণের জন্য তাদের ভূমি দখল করে এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে একটি সরকার কিভাবে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত করার কথা ভাবতে পারে?
ইসরাইল অবৈধভাবে তাদের ভূমি দখলকে আরো বিস্তৃত করার এবং ফিলিস্তিনিদেরকে পদানত করে রাখার লক্ষ্যে আরব আমিরাত ও অন্যান্য আরবদেশকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার জন্য যদি তাদের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়- তা হলে সেটি কেমন হবে?
এ ব্যাপারে তাদের অস্বীকৃতি সত্ত্বেও আমিরাত আরব দেশগুলোর ‘শান্তির জন্য ভূমি’ ঐকমত্যকে লঙ্ঘন করেছে। উল্লেখ্য, ফিলিস্তিনিদের দখলীকৃত তথা অধিকৃত ভূখণ্ড এবং আরব ভূখণ্ড ইসরাইল ছেড়ে দিলে বা সেখান থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নেবার পরই কেবল আরব দেশগুলো ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে বলে ঐকমত্যে পৌঁছেছিল।
ফিলিস্তিনিদের অধিকার পরিপূর্ণভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠার আগে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে আরব নেতৃবৃন্দ সর্বাত্মকভাবে বিরোধী বলে তাদের দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু আমিরাত আরব নেতাদের সেই অঙ্গীকারকে বিসর্জন দিয়েছে। আমিরাত এখন বলছে মিসর এবং জর্দান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারলে আমিরাত পারবে না কেন? এই খোঁড়া যুক্তি দিয়ে তারা ইসরাইলের সাথে চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে সাফাই গাইছেন। এই তুলনা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও উদ্ভট। কারণ মিসর ইসরাইলের বিরুদ্ধে চারটি বড় যুদ্ধ করেছে এবং ইসরাইল মিসরের সব ভূখণ্ড ছেড়ে দিতে সম্মত হওয়ার পর মিসর তাদের সাথে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
জর্দানও ইসরাইলের বিরুদ্ধে তিনটি যুদ্ধ করেছে এবং ফিলিস্তিনিরা একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করার পরই কেবল জর্দান ইসরাইলের সাথে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু তখন থেকে এই পর্যন্ত ইসরাইল ফিলিস্তিনিদের ব্যাপারে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেগুলো তারা রক্ষা করেনিÑ সেগুলো থেকে বেরিয়ে এসে বরং ফিলিস্তিনে তাদের দখলদারিত্ব আরো গভীর ও জোরদার করেছে। অপর দিকে, ইসরাইলের সাথে আমিরাতের কোনো সীমান্ত নেই এবং আমিরাত ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধও করেনি। ইসরাইলি বাহিনী তাদেরকে কোনো হুমকি দেয়নি এবং তাদের ভূখণ্ডও দখল করেনি। সুতরাং নেতানিয়াহু যখন ফিলিস্তিনিদের ওপর আরো কড়াকড়ি আরোপ করেছেন এবং ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’কে প্রত্যাখ্যান করেছেন, তখন আবুধাবি কেন ইসরাইলের পক্ষে দৌড়ে এলো?
আমিরাত নেতৃবৃন্দের দাবি হলো, আরব নেতৃবৃন্দ অহঙ্কারী মনোবৃত্তি এবং যুদ্ধের চেয়ে কূটনীতি ও শান্তির মাধ্যমে আরো বেশি অর্জন করতে পারে। কিন্তু এটা হলো মিথ্যা ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য।
আরেকটি আঞ্চলিক যুদ্ধের পথে
আমিরাত সরকার ওই অঞ্চলে অত্যন্ত যুদ্ধংদেহী মনোবৃত্তি প্রদর্শন করছে। তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাইল। তারা ইয়েমেনে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। লিবিয়ায় তারা প্রক্সিযুদ্ধে নিয়োজিত । তিউনিসিয়া, তুরস্ক ও কাতারের ব্যাপারে তাদের বিবাদ সৃষ্টিকারী, সর্বনাশা ও গণতন্ত্রবিরোধী নীতি এবং সৌদি আরবের সাথে মিলে ওই অঞ্চলকে অচল ও অসহায় করে দিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রগুলোকে দেউলিয়া বা সর্বস্বান্ত করার হীনমনোবৃত্তি স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমিরাত সিরিয়ার বাশার আল আসাদ এবং মিসরের আবদুল ফাত্তাহ আল সিসির মতো আঞ্চলিক স্বৈরশাসকদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শান্তির প্রতি অশ্রদ্ধা এবং যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ‘আরব বসন্ত’ এবং ওই অঞ্চলের যেকোনো ধরনের গণতন্ত্রের ব্যাপারে আমিরাত ও সৌদি আরবের বিরোধিতা এবং সব ধরনের জনপ্রিয়, প্রগতিশীল, উদার অথবা ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে গভীর বা তীব্র শত্রুতা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এবং উত্তর আফ্রিকায় তাদেরকে প্রতিবিপ্লবী শক্তির কর্ণধারে পরিণত করেছে। তারা হয়তো কোথাও জয়লাভ করতে পারবে না। কিন্তু তারা নিশ্চিত করেছে, এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সংক্ষেপে বলা যায়, তুরস্কের প্রভাবের মোকাবেলা এবং ইরান সরকারকে বাগে আনা অথবা ধ্বংস করে দেয়ার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল-আরব, এই তিন শক্তির সমন্বয়ে একটি জোট গঠনের আশায় ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনুকূল স্রোতে আমিরাত নৌকা ভাসিয়ে দিয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, আমিরাত ইসরাইলের সাথে কল্যাণ ও শান্তির নয় একটি নৈরাজ্যবাদী বা হতাশাবাদী জোট গড়তে চাচ্ছে। ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হলে নিশ্চিতভাবে বলা যায়Ñ আঞ্চলিক শান্তি ও সমৃদ্ধি আসবে না, বরং গোটা অঞ্চলব্যাপী অধিক অস্থিতিশীলতা এবং দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়বে। যারা ‘ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি’ উদযাপন করছেন তারা হয়তো শিগগির আবিষ্কার করবেন এটা আরেকটি আঞ্চলিক সঙ্ঘাত অথবা মন্দ যুদ্ধ ডেকে আনবে।
ইসরাইল সব আরব ভূমি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে সম্মত হলে, তাদের আধিপত্যবাদী উচ্চাভিলাষ ও পরমাণু অস্ত্র পরিত্যাগ করলে এবং ফিলিস্তিনিদের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার মেনে নিয়ে আরব ও মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথ খুলে দিলেই কেবল সত্যিকারের শান্তি আসবে।
লেখক : আলজাজিরার সিনিয়র রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার