রবীন্দ্রনাথের পাত্রী দেখা
রবীন্দ্রনাথ - ছবি : সংগৃহীত
বাংলা সাহিত্যের শিখর আরোহণ করে রয়েছে কলকাতার দুই পরিবার। সাহিত্য-শিল্পের দৌড়ে পাথুরিয়াঘাটার টেগোর কাসলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার। শিখরে আরোহিত পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদের শিকড়ের সন্ধানে মাটি খুঁড়তে গিয়ে প্রথমেই পাওয়া যাবে রবিঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি। রবিঠাকুর থেকে শুরু করে তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর, পূর্বপুরুষ রামমণি ঠাকুর, রামলোচন ঠাকুর, জয়রাম ঠাকুরসহ অনেকেই বিয়ে করেছেন তৎকালীন যশোরের ‘পিরালি’ পরিবারে। ঠাকুর পরিবারের শুধু অন্দরমহল নয়, বহির্মহলের শিকড়ও প্রোথিত রয়েছে যশোরের পিঠাভোগ গ্রামে। ঠাকুর পরিবারের ছেলেদের বিয়ের বয়স শুরু হলেই কনে খুঁজতে শুরু হতো। শেষ রক্ষে যশোরের ‘পিরালি’ পরিবার।
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের মেয়ে দেখতে যাওয়ার আগে আরো দু-একটি জায়গাতে পাত্রী দেখার কথা হয়েছিল। সেগুলো বেশ মজার ও তথ্যের দিক দিয়ে ভারী আকর্ষণীয়। কবিগুরু বার্ধক্যে (১৯৩৮) পৌঁছে যৌবনের ঘটনাটি বলেছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর অনুরোধে। কবিগুরুর ভাষায়, ‘একবার আমার একটি বিদেশী, অর্থাৎ অন্য province-এর মেয়ের সাথে বিয়ের কথা হয়েছিল। সে এক পয়সাওয়ালা লোকের মেয়ে, জমিদার আর কী, বড় গোছের। সাত লাখ টাকার উত্তরাধিকারিণী। আমরা কয়েকজন মেয়ে দেখতে গেলুম, দু’টি অল্পবয়সী মেয়ে এসে বসল- একটি নেহাত সাদাসিধে, জড়ভরতের মতো এক কোণে বসে রইল; তার একটি যেমন সুন্দরী, তেমনি চটপটে। চমৎকার তার স্মার্টনেস। একটুও জড়তা নেই, বিশুদ্ধ ইংরেজি উচ্চারণ। পিয়ানো বাজালে ভালো- তার পর music সম্বন্ধে আলোচনা শুরু হলো। আমি ভাবলুম, এর আর কথা কী? এখন পেলে হয়! এমন সময় বাড়ির কর্তা ঘরে ঢুকলেন। বয়স হয়েছে, কিন্তু শৌখিন লোক, ঢুকেই পরিচয় করিয়ে দিলেন মেয়েদের সাথে। সুন্দরী মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, Here is my wife এবং জড়ভরতটিকে দেখিয়ে Here is my daughter- আমরা আর করব কী, পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে চুপ করেই রইলুম; আরে তাই যদি হবে তবে ভদ্রলোকদের ডেকে এনে নাকাল করা কেন! যাক, এখন মাঝে মধ্যে অনুশোচনা হয়। যা হোক, হলে এমনই কি মন্দ হতো। মেয়ে যেমনই হোক না কেন, সাত লাখ টাকা থাকলে বিশ্বভারতীর জন্য তো এ হাঙ্গামা করতে হতো না, তবে শুনেছি সে মেয়ে নাকি বিয়ের বছর দুই পরই বিধবা হয়। তাই ভাবি- ভালোই হয়েছে, কারণ স্ত্রী বিধবা হলে আবার প্রাণ রাখা শক্ত।’
রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবী ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘পূর্ব প্রথানুসারে রবি কাকার কনে খুঁজতেও তার বউঠাকুরানীরা মানে মা আর নতুন কাকিমা (কাদম্বরী দেবী), জ্যোতি কাকা মহাশয় আর রবি কাকাকে সাথে বেঁধে নিয়ে যশোর যাত্রা করলেন। বলাবাহুল্য, আমরা দুই ভাইবোনেও সে যাত্রায় বাদ পড়িনি। যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে ছিল আমার মামার বাড়ি। সেখানেই আমরা সদলবলে আশ্রয় নিলুম। যদিও এই বউ পরিচয়ের দলে আমরা দুই ভাইবোন থাকতুম না। তা হলেও শুনেছি যে, তারা দক্ষিণডিহি চেঙ্গুটিয়া প্রভৃতি আশপাশের গ্রামে যেখানে একটু বিয়েযোগ্য মেয়ের খোঁজ পেতেন, সেখানেই সন্ধান করতে যেতেন। কিন্তু বোধহয় তখন যশোরে সুন্দরী মেয়ের আকাল পড়েছিল। কারণ এত খোঁজ করেও বউঠাকুরানীরা মনের মতো কনে খুঁজে পেলেন না। আবার নিতান্ত বালিকা হলেও তো চলবে না। তাই সবশেষে তারা জোড়াসাঁকোর কাছারির একজন কর্মচারী বেণী রায় মশায়ের অপেক্ষাকৃত বয়স্কা কন্যাকেই মনোনীত করলেন।’
শুধু দুই ছেলে (সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) নয়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বিয়ে করেছিলেন ফুলতলার দক্ষিণডিহি গ্রামে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাতা সারদাসুন্দরী দেবী ছিলেন যশোরের দক্ষিণডিহি গ্রামের রামনারায়ণ চৌধুরীর মেয়ে। ১৮৩৪ সালের মার্চ মাসে ১৭ বছর বয়সী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে বিয়ে হয় ছয় বছর বয়সী সারদাসুন্দরীর।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। প্রিন্স দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী এই এলাকারই ‘পিরালি’ বংশের মেয়ে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাবা রামমণি ঠাকুর ও চাচা রামলোচন ঠাকুর দুই সহোদর বিয়ে করেছিলেন দিগম্বরী দেবীর পিসিমা দুই সহোদরা মেনকা দেবী ও অলকা সুন্দরীকে।
জয়রাম ঠাকুর যশোরের একই এলাকার দুই মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। যাদের একজনের নাম রামধনী এবং অন্যজনের গঙ্গা। রামধনীর দুই ছেলে, দর্পনারায়ণ ও গোবিন্দরাম। গঙ্গারও দুই ছেলে নীলমণি ও আনন্দরাম।
জয়রাম ঠাকুরের পূর্বসূরি জগন্নাথ কুশারী বিয়ে করেছিলেন দক্ষিণডিহি গ্রামের শুকদেবের মেয়ে সুুন্দরী দেবীকে। শুকদেব ‘পিরালি’ ব্রাহ্মণ। শুকদেবের মেয়ে সুন্দরীকে বিয়ে করে ‘পিরালি’ থাকভুক্ত হয় জগন্নাথ কুশারী।
অষ্টম কিংবা দশম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ৭০০ বছর ঠাকুরদের পূর্বপুরুষ দক্ষিণডিহি গ্রামেই ছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে পঞ্চানন কুশারী কলকাতা চলে গেলেও তাদের অন্দরমহল আলোকিত করে রাখত খুলনার ‘পিরালি’ পরিবারের মেয়েরা। পঞ্চানন কুশারীর সহোদর প্রিয়নাথ কুশারী। প্রিয়নাথ কুশারী পিঠাভোগ গ্রামে থেকে যান, যার সপ্তদশ ও অষ্টাদশ বংশধর এখনো পিঠাভোগ গ্রামে বসবাস করছেন। ১৯৯৫ সালে সরকার তাদের আদি বাড়িটি উদ্ধার করেছে।
ভট্টনারায়ণের ২৭তম উত্তরসূরি পঞ্চানন ঠাকুর এবং ৩৩তম উত্তরসূরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম-মৃত্যু (১৮৬১-১৯৪১) কলকাতায় হলেও কর্মক্ষেত্র পূর্ববঙ্গ। রবীন্দ্র জীবন ও সাহিত্যের সাথে মিলেমিশে আছে আজকের বাংলাদেশের শিলাইদহ, শাহজাদপুর আর পতিসর। তিনটি স্থানেই ছিল ঠাকুর পরিবারের জমিদারি। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১ সাল ৩০ বছর বয়সে জমিদারির দায়িত্ব নিয়ে পূর্ববঙ্গে আসেন এবং সর্বশেষ ১৯৩৭ সালের ২৭ জুন (পরলোকগমনের চার বছর আগ পর্যন্ত) পতিসর ত্যাগ করেন।
শিলাইদহের কুঠিবাড়ি
কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার একটি গ্রাম শিলাইদহ। পদ্মা নদীর কোলঘেঁষে অবস্থিত গ্রামটির পূর্ব নাম কসবা। রবীন্দ্রনাথের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ১৮০৭ সালে এ অঞ্চলের জমিদারি পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে জমিদার হয়ে এসে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারি পরিচালনা করেন। এ সময় এখানে বসেই তিনি রচনা করেছেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী প্রভৃতি। এখানে গীতাঞ্জলি কাব্যের অনুবাদের কাজও শুরু করেন। [৩][৪] এখানে রবীন্দ্রনাথের সাথে দেখা করতে এসেছেন জগদীশচন্দ্র বসু, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, প্রমথ চৌধুরীসহ অনেকে।
১৮৯৮ সালের ৩ আগস্ট পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে পাকাপাকিভাবে জোড়াসাঁকো থেকে শিলাইদহে বসবাসের জন্য আসেন কবিপত্নী মৃণালিনী। গৃহবিদ্যালয় খুলে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা শেখানোর প্রতি সেখানে যেমন মন দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাদের স্বনির্ভর করে তুলতে ঘরের কাজ শিখিয়েছিলেন মৃণালিনী।
রোববার বাড়ির কাজের লোকদের ছুটি দিতেন তিনি। কাজেই বাড়ির কাজে সেদিন হাত লাগাতে হতো সবাইকে। রবীন্দ্রনাথ যেমন দুর্বল ছিলেন তার দরিদ্র প্রজাদের প্রতি, গরিব মানুষ সাহায্যপ্রার্থী হলে তাকে ফেরাতে পারতেন না মৃণালিনীও।
এভাবেই রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতেই শিলাইদহে এক দরিদ্র পাঞ্জাবি মূলা সিংহকে মাসিক ১৫ টাকা মাইনেতে বাড়ির দারোয়ানের চাকরি দিয়েছিলেন মৃণালিনী। ঠাকুর এস্টেটের স্বল্প বেতনভোগী আমলা আর কর্মীদের জন্য সরকারি তহবিল থেকে খুলে দিয়েছিলেন একটি মেস। কুঠিবাড়িতেই নিজে করেছিলেন শাকসবজির বাগান।
এখান থেকে স্ত্রী মৃণালিনী বরাবর ১৮৮৯ থেকে ১৮৯২ সালের মধ্যে আটটি চিঠি পাঠিয়েছেন কবি। ১৯০১ সালের একটি চিঠিতে কুঠিবাড়িতেই মৃণালিনীর নিজ হাতে করা সবজি বাগান ছাড়াও নীতুর পাঠানো গোলাপ, মালতি, ঝুমকো, হাস্নাহেনা ফুলের বর্ণনা রয়েছে।
জুন ১৯০১ অপর এক পত্রের একাংশে ‘লেখায় হাত দিয়েছি। কলকাতার ভিড়ে আমার জীবনটা নিষ্ফল হয়ে থাকে... সে জন্য মেজাজ বিগড়ে গিয়ে প্রত্যেক তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আক্ষেপ করতে থাকি। ... আমার নিচের ঘরের চার দিকের শার্সি বন্ধ করে এই বর্ষণদৃশ্য উপভোগ করতে করতে তোমাকে চিঠি লিখছি। তোমাদের সেখানকার দোতলার ঘর থেকে এ রকম চমৎকার ব্যাপার দেখতে পেতে না। চার দিকে সবুজ ক্ষেতের ওপর স্নিগ্ধ তিমিরাচ্ছন্ন নবীন বর্ষা ভারি সুন্দর লাগছে। বসে বসে মেঘদূতের ওপর একটা প্রবন্ধ লিখছি। (এই) প্রবন্ধের ওপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকের কাছে চিরকালের জিনিস করে রাখতে পারতুম, তা হলে কেমন হতো!’ (রবীন্দ্রসমগ্র খণ্ড-২২ চিঠি নং ৩০, পৃষ্ঠা ৩১)।
১৯০২ সালে শিলাইদহ থেকে স্ত্রী মৃণালিনী বরাবর কবিগুরুর শেষ চিঠি। চিঠিতে শিলাইদহের মুগ কলাই ও গুড় পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। নানা রকম উপদেশসহ শেষপত্রের শেষ দিকে রয়েছে ধর্মবিষয়ক উপদেশও। যেমন ‘আমাদের যা হয়েছে বোধহয় তার আর প্রতিকার নেই... এখন ছেলেদের নিজের হাত থেকে মঙ্গলের হাতে ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করতে চাই ... তিনি এদের ঐশ্বর্যের গর্ব্ব, ইচ্ছার তেজ, প্রবৃত্তির বেগ, দশের আকর্ষণ অপহরণ করে মঙ্গলের ভাবে এবং সুকঠিন বীর্য্যে ভূষিত করে তুলুন। এই আমার কামনা... আমরা আমাদের সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল ইচ্ছাকে কঠিনভাবে সংযত করে ঈশ্বরের নিগূঢ় ধর্ম নিয়মের যেন সহায়তা করি... পদে পদেই যেন তাকে প্রতিহত করে আপনার অভিমানকেই অহোরাত্রি জয়ী করার চেষ্টা না করি। এতেও যদি নিষ্ফল হই, তবে আমার সমস্ত জীবন নিষ্ফল হলো বলে জানব। মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল ২৩ নভেম্বর ১৯০২ সালে।
শাহজাদপুর
১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩ টাকা ১০ আনায় এই জমিদারি কিনে নিয়েছিলেন। এর আগে কাছারি বাড়ির মালিক ছিল নীলকররা। ১৮৯০ সালে জমিদারি তত্ত্বাবধানের জন্য প্রথম শাহজাদপুর আসেন। রবীন্দ্রনাথ এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের বিচিত্র জীবন প্রবাহের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হন। এখানে এসে তার লেখা একটি কবিতায় তিনি বলেছেন,
‘নদী ভরা কূলে কূলে, ক্ষেত ভরা ধান,
আমি ভাবিতেছি বসে কি গাহিব গান।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে বসেই রচনা করেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ সোনার তরী, বৈষ্ণব কবিতা, দুই পাখি, আকাশের চাঁদ, পুরস্কার, হৃদয়, যমুনা, চিত্রা, চৈতালী প্রভৃতি। এখানে গীতাঞ্জলি কাব্যের কাজও শুরু করেন যাতে পরবর্তীতে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পের রতন চরিত্রও শাহজাদপুরে বসেই লেখা। চিত্রা, শীতে ও বসন্তে, নগর সঙ্গীতে এবং চৈত্রালীর ২৮টি কবিতা, ছিন্ন পত্রাবলীর ৩৮টি, পঞ্চভূতের অংশবিশেষ এবং বিসর্জনের নাটক তিনি শাহজাদপুরে বসেই রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ থেকে ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত বছর জমিদারির কাজে শাহজাদপুরে অবস্থান করেছেন।
শাহজাদপুর থেকে স্ত্রী মৃণালিনী বরাবর ছয়টি চিঠি পাঠানো হয়েছে। জানুয়ারি ১৮৯০ সালের প্রথম পত্রের একাংশে ‘দেখচ, বসে বসে কত উপার্জনের উপায় করছি। সকালে উঠেই বই লিখতে বসেছি তাতে কত টাকা হবে একবার ভেবে দেখ! ছাপানোর সমস্ত খরচ না উঠুক দশ-পঁচিশ টাকা তো হবে। এ রকম উঠেপড়ে লাগলে হয়। তোমরা তো কেবল খরচ করতে জানো, এক পয়সা ঘরে আনতে পারো?’
জুন ১৮৯১ সালের চিঠির একাংশে ‘আমি যে তোমাকে এই শাহজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখনমারা ঘের্ত্ত, সেবার জন্য পাঠিয়েছিলুম তৎসম্পর্কে কোনো কথাই উল্লেখ করলে না।’
নওগাঁ জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কিলোমিটার দক্ষিণে আত্রাই উপজেলার নাগর নদের তীরে রবিঠাকুরের পতিসর কুঠিবাড়ি অবস্থিত। পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত কালিগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখাশোনার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৯১ সালে সর্বপ্রথম পতিসরে আসেন। জমিদারি দেখাশোনার জন্য এলেও প্রকৃতি ও মানবপ্রেমী কবি অবহেলিত পতিসর এলাকার মানুষের জন্য দাতব্য চিকিৎসালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ অনেক জনহিতৈষী কাজ করেন। কৃষকের কল্যাণে নোবেল পুরস্কারের এক লাখ আট হাজার টাকা দিয়ে তিনি এখানে একটি কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেছিলেন। কবির সাহিত্য সৃষ্টির একটি বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে পতিসর। পতিসরে বসেই কবি চিত্রা, পূর্ণিমা, সন্ধ্যা, গোরা, ঘরে-বাইরেসহ অনেক গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৩৭ সালের ২৭ জুলাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষবারের মতো পতিসরে আসেন। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বুকে নিয়ে আজো দাঁড়িয়ে আছে পতিসর কুঠিবাড়ি। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯০ সালে বাড়িটির দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
প্রমথ চৌধুরীর ভাষায়, ‘সে সময় সমাজের অধিকাংশ মানুষ মনে করত, ‘যৌবনকে টিকা (প্রতিষেধক) দেওয়া অবশ্য কর্তব্য, তাহাকে বসন্তের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য।’ কিন্তু সবুজপত্র পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই তো তিনি প্রস্তাব করেছিলেন ‘টিকা’ দিয়ে যৌবনকে প্রতিরোধ করা নয় বরং ‘যৌবনে দাও রাজটিকা’ (রাজতিলক)। কারণ যৌবন এবং তারুণ্যই একটি সমাজকে সচল রাখে, সামনের দিকে নিয়ে যায়।’ কবিগুরুর শিকড়সহ যৌবন কেটেছে পূর্ব বাংলায় পদ্মায়। পদ্মার উপর জেগে ওঠা চরে। সবুজ প্রকৃতিতে। সাধারণ মানুষের মাঝে। গরিবের টানাপড়েনের ভেতর। কলকাতার ডামাডোলের বাইরে এই সবুজ বাংলাই ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের চতুর্দশতম সন্তান রবি থেকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠার পটভূমি।
লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট