যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ব্যর্থতা নিশ্চিত!
যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের ব্যর্থতা নিশ্চিত! - ছবি : সংগৃহীত
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি ভারত মহাসাগরকে অন্তর্ভুক্ত করতে এশিয়া-প্যাসিফিককে সম্প্রসারণ করে এর নাম দিয়েছেন ইন্দো-প্যাসিফিক এবং পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তত সামরিক থিয়েটার প্যাসিফিক কমান্ডের নামকরণ করেছেন ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ড।
এর অর্থ হলো চীনকে সংযত করার জন্য ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি তথা জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ- যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতকে নিয়ে গঠিত- চাঙ্গা করা।
অবশ্য, ট্রাম্পের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ সম্ভবত ব্যর্থ হবে। কারণ এটি সদস্য দেশগুলোর, এমনকি খোদ যুক্তরাষ্ট্রের, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী।
এসব দেশ চীনের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক উত্থানে হুমকিগ্রস্ত বা উদ্বিগ্ন হলেও যেকোনো ধরনের উত্তেজনা বাড়া মানে তাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হওয়া এবং এই অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ঝুঁকি শঙ্কা বৃদ্ধি।
কোয়াডভুক্ত চার দেশই চীনের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদার। ফলে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য চীনা বাজার তাদের জন্য ক্রমবর্ধমান হারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনা অর্থনীতি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। অ্যাপেল, জেনারেল মোটর্সসহ যুক্তরাষ্ট্রের ফরচুন ৫০০ প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোর কারখানা ও বাজার উভয়টিই চীনে অবস্থিত।
দুই জায়ান্টের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্কের কারণেই ট্রাম্পের বাজে পরামর্শজাত চীনের সাথে বাণিজ্যে যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ডুবতে বসেছে, ভোক্তা মূল্য বাড়ছে, কৃষকরা দেউলিয়া হচ্ছে, দারিদ্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেসব পণ্যের ওপর করারোপ করা হয়েছে, সেগুলোর অনেকগুলো এশিয়ান দেশের জন্য মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোই তৈরী করে।এই প্রেক্ষাপটে কোয়াডের পুনর্জীবন মার্কিণ অর্থনীতির জন্য, বিশেষ করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি ও সংশ্লিষ্ট মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে বিপর্যয়কর হতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব অনুযায়ী, দ্বিতীয় কোয়ার্টারে মার্কিন অর্থনীতি ৩০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। ফলে ২০২০ সালে ৮ ভাগ কমতে পারে।এর বড় একটি কারণ হলো ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং মহামারিটি যথাযথভাবে সামাল দিতে না পারা। অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্টই দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হতে পারেনি।
ট্রাম্প মহামারির জন্য চীনকে দায়ী করে গেলেও এর বিস্তার ঠেকাতে তিনি কাজ করেছেন খুবই সামান্য। চীনা প্রযুক্তি হত্যার চেষ্টার ফলে আকর্ষণীয় চীনা বাজার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ফ্রন্টে চীনকে আক্রমণ করার ফলে আমেরিকার স্বার্থ ইতোমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া শুরু করেছে।আর ট্রাম্প কল্পনাও করতে পারছেন না যে চীনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সামরিক জোট গঠন কতটা ধ্বংসকরী হতে পারে। এ কারণেই সম্ভবত ৬ আগস্ট চীনা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সাথে শান্তি আলোচনার জন্য ৯০ মিনিটের টেলিফোন সংলাপে বসতে ট্রাম্প তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, চীনের সাথে যুদ্ধ চান না ট্রাম্প।
ওয়াশিংটনের কোয়াড অংশীদারেরা সম্ভবত একই বিষয় ভাবছে : কেন তারা কথিত হুমকির তাদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে বা কেন মার্কিন চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে? তাছাড়া চীন কখনো এই ইঙ্গিত দেয়নি যে সে তাদের কোনো দেশের ওপর সামরিকভাবে হামলা চালাবে।
বস্তুত, কেউ যদি পূর্ব ও দক্ষিণ চীন সাগরের ভূখণ্ডগত ও হিমালয়ের বিরোধগুলো তীক্ষ্ণভাবে নজর দিলে বোঝা যাবে, চীন সম্ভবত খারাপ ছেলে নয়।
যুক্তরাষ্ট্র ২০১২ সালে ‘পাইভোট টু এশিয়া’ ঘোষণা করার আগে পর্যন্ত দক্ষিণ চীন সাগরে নৌচলাচলের স্বাধীনতার কোনো সমস্যাই কোনোকালে দেখা যায়নি। ওই একই বছর জাপান সরকার তার ‘জাপানি মালিকদের’ কাছ থেকে দিয়ায়ু/সেনকাকু আইল্যান্ডস কেনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরই চীন ও জাপানের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ভারত-চীনের সীমান্ত সমস্যার কারণ লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) যথাযথভাবে নির্ধারণ না করা। এখানে উভয় দেশেরই আলাদা আলাদা চিহ্নিত এলাকা আছে।
‘জ্ঞাতির সম্পর্ক’ ছাড়া অন্য কোনো কারণ না থাকলেও ওয়াশিংটনের সাথে অস্ট্রেলিয়ার গাটছড়া বাঁধা অদ্ভূত বিষয়। চীন যদি অস্ট্রেলিয়ার রফতানি বন্ধ করে দেয়, চীনা ছাত্র ও পর্যটক পাঠানো অবসান করে, তবে অস্ট্রেলিয়া সাথে সাথে তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিণত হবে। এই দুটি খাত অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতির ৪০ ভাগ।
অধিকন্তু, চীনের আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের সীমার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। দেশির বেশির ভাগ লোক প্রধান প্রধান নগরীতে বাস করায় সিডনি, মেলবোর্ন ও অন্যান্য প্রধান নগরীতে হামলার পর টিকে থাকতে পারবে না অস্ট্রেলিয়া। ফলে চীনকে তার স্থানে আটকে রাখার বদলে চীন-কোয়াড যুদ্ধে অস্ট্রেলিয়া নিজেকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত বা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেখতে পাবে।
অ্যাবে সরকার ও তার ডানপন্থী সমর্থকেরা হয়তো কোয়াড চাঙ্গা করতে চাইবে, কিন্তু জাপানের বেশির ভাগ লোক তা নাও চাইতে পারে, বিশেষ করে দেশটির ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ক্রমহ্রাসমান ও বৃদ্ধ জাপানি লোকজন বৃদ্ধির ফলে জাপানের আর্থিক নির্ভরতার জন্য চীনা বাজার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।চীনের বিশাল ও ক্রমবর্ধমান সম্পদশালী জনসংখ্যঅ ও ব্যাপকভিত্তিক অবকাঠামো ব্যবস্থা জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলোর কারাখানা ও বাজার উভয়টির জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।
জাপানের ভূমি অপেক্ষাকৃত কম হওয়ায় এবং এর লোকজন মাত্র কয়েকটি নগরীতে সীমাবদ্ধ থাকায় কোয়াড জাপানের জন্য আরো কম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে। চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জাপান টিকতে পারবে কিনা তা অস্পষ্ট। কারণ টোকিও ও মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো চীনা ক্ষেপণাস্ত্রের প্রথম শিকার হতে পারে।
ভারতের জন্য কোয়াডে অংশগ্রহণ একইভাবে অযৌক্তিক হতে পারে। কারণ এর অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ছোট এবং তা গভীর মন্দার কবলে পড়েছে। চীনকে মোকাবেলার জন্য ভারত বিপুল পরিমাণ অর্থ অস্ত্র আমদানিতে ব্যয় করতে পারে না।
খবরে প্রকাশ, ভারতে যে পরিমাণ গোলাবারুদের মজুদ আছে, তা দিয়ে ছয় মাসের বেশি চলবে না। রাশিয়া, ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কেনা গুটিকতেক জেট ছাড়া ভারতের বেশির ভাগ অস্ত্রই সেকেলে। তাছাড়া চীনের পক্ষে পাকিস্তানও যোগ দিতে পারে। এক ফ্রন্টে লড়াই করাই কঠিন। আর দুই ফ্রন্টে লড়াই করা ভারতের জন্য হবে প্রাণঘাতী।
সবশেষে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ ব্যর্থ হবে।
এশিয়া টাইমস