সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্ক কোন পথে?
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়া সৌদি নেতৃত্বের সাথে আলোচনার জন্য সোমবার সৌদি আরব গেছেন। শুরুতে এই সফরকে সামরিক-সংশ্লিষ্ট হিসেবে অভিহিত করা হলেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক সমালোচনার ফলে রিয়াদ ক্ষুব্ধ হয়েছে বলে মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভুল বোঝাবুঝি দূর করার সুযোগও করে দিয়েছে।
এদিকে পাকিস্তানে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত অ্যাডমিরাল সাইদ আল-মালকি গত সপ্তাহে সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাত করেন। তারা আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকই আছে।
গত ৫ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি ভারত-শাসিত কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্রতিক্রিয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন। তিনি একটি উর্দু টকশোতে বিকল্প ওআইসি গঠনের ইঙ্গিতও দেন। ওআইসিতে সৌদি আরবের প্রভাবশালী ভূমিকা থাকায় সাধারণ ধারণা হলো এই যে পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্যে রিয়াদ সরকার ক্ষুব্ধ হতে পারে।
কোরেশির ক্ষুব্ধ মন্তব্যের পর পরই খবর প্রকাশিত হয় যে রিয়াদের কাছ থেকে নেয়া এক বিলিয়ন ডলারের ঋণ ফেরত দিয়েছে ইসলামাবাদ। এই দুই ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক থাকতে পারে।
অবশ্য এ ধরনের ছোটখাট বিষয় রিয়াদ ও ইসলামাবাদের মধ্যকার সম্পর্ককে বিচ্যুত করতে পারে না। সাবেক সৌদি গোয়েন্দাপ্রধান প্রিন্স তুর্কি বিন ফয়সাল এই সম্পর্ককে অভিহিত করেছিলেন বিশ্বের যেকোনো দু্ই দেশের মধ্যকার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক হিসেবে।
সৌদি-পাকিস্তান সম্পর্কের সূত্রপাত ব্রিটিশ আমল থেকে।সেই ১৯৪০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগের সাথে একটি আরব প্রতিনিধিদল সাক্ষাত করেছিল। সৌদি আরবের সাথে বিভিন্ন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক ফোরামে কাজ করার প্রেক্ষাপটে ১৯৬৯ সালে ওআইসির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হয় পাকিস্তান।
এই ঐতিহাসিক সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়।
প্রথমত, পাকিস্তান-সৌ আরব সম্পর্কের নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিভিন্ন সঙ্কটে সৌদি আরবকে সহায়তা করেছে পাকিস্তান। একমাত্র মুসলিম পরমাণু শক্তির অধিকারী পাকিস্তান মক্কা ও মদিনার নিরাপত্তাও নিশ্চিত করে থাকে। ১৯৬০-এর দশক থেকে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্কও রয়েছে। ওই সময় থেকেই সৌদি আরবের সুরক্ষায় পাকিস্তানি সৈন্যদের মোতায়েন করা হয়েছে।
২০১৮ সালে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আলোকে প্রায় এক হাজার পাকিস্তানি সৈন্য সেখানে মোতায়েন রয়েছে। সৌদি সৈন্য ও পাইলটেরা পাকিস্তানি সামরিক স্থাপনায় নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে। একসময় রিয়াদ ছিল পাকিস্তানি ক্ষুদ্র ও মাঝারি অস্ত্রের বৃহত্তম আমদানিকারক।
ইয়েমেনে হাউছি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন বাহিনীর অংশ হতে পাকিস্তান অস্বীকৃতি জানালে কিছু সমস্যা হয়। তবে তা স্থায়ী হয়নি। অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনাপ্রধান রাহিল শরিফকে ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্সের প্রধান হতে বলার মধ্যে পারস্পরিক আস্থার বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করে সৌদি আরব। ১৯৭০-এর দশক থেকে বিভিন্ন সঙ্কটজনক অধ্যায়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছে দেশটি। বিভিন্ন সময়ে বাকিতে তেল দিয়েও সহায়তা করেছে সৌদি আরব।
দেশটিতে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন পাকিস্তানি শ্রমিক কাজ করছে। তারা দেশে প্রায় ৬ থেকে ৮ মিলিয়ন ডলার পাঠায় বছরে। দেশটিতে বিপুলসংখ্যক চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক কাজ করছেন।
সবশেষে বলা যায়, দুই দেশের সম্পর্ক কৌশলগত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। অন্যান্য দেশের সাথে এই দুই দেশের সম্পর্কের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কোনো প্রকার প্রভাব বিস্তার করে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইরানের সাথে পাকিস্তান ও ভারতের সাথে সৌদি আরব সম্পর্ক উন্নয়ন ঘটালেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অটুটই রয়ে যায়।
পাকিস্তান-সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বিষয় হলো এই যে পাকিস্তান সবসময় রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে মধ্যস্ততার চেষ্টা করে আসছে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখাটা পাকিস্তানের সফল পররাষ্ট্রনীতির অংশ এবং এর মাধ্যমে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে পাকিস্তান।
আল-মনিটর