কঠিন পরীক্ষায় মোদি

নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
সমালোচকেরা বলছে, ভারত তার নিজের পায়েই গুলি করছে। ভারতীয় পত্রিকা ইকোনমিক টাইমসের ভাষ্যানুযায়ী, ভারতে তৈরী হয় এমন পণ্যের উৎপাদনের জন্যও চীনের ওপর নির্ভরশীল ভারত। যেমন সোলার প্যানেলের ৯০ ভাগ, স্মার্টফোনের ৭০ ভাগ ও ওষুধের কাঁচামালের জন্য ৬০ ভাগ নির্ভরশীল।
ভারতের ২০১৯ সালের মোট আমদানির ১৯ ভাগ হয়েছিল চীন থেকে। আর ওই বছর চীনের মোট রফতানির মাত্র ৩ ভাগ গেছে ভারতে। এর মানে হলো এই যে চীনা পণ্য বয়কট করলে ভারতই সম্ভবত বেশি ক্ষতির শিকার হবে।
তাহলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার কেন চীনের ওপর এত কঠোর হলেন? এর একটি কারণ হলো, লোকরঞ্জক দাবির প্রতি সাড়া দিচ্ছেন মোদি। জুনে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী, ৯৭ ভাগ লোক চীনা পণ্য বয়কটের পক্ষে।
কিন্তু জাতীয়তাবাদী অনুভূতি পরিবর্তনশীল। ভারতীয় অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
গত নভেম্বরে, ভারত রিজিওন্যাল কম্প্রেহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের আলোচনা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। প্রস্তাবিত এই এশিয়ান অবাধ বাণিজ্য জোনে চীনও রয়েছে। আরসিইপি নিয়ে ছয় বছর আলোচনা করার পর ভারত নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ভারতের আশঙ্কা, আরসিইপির ফলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শুল্ক হ্রাস পাবে।আর তাতে করে চীন থেকে আমদানির বন্যা বয়ে যাবে। গত বছর ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি ১৬১.৮ বিলিয়ন ডলারে উপনীত হয়েছে, এর ৩০ ভাগই চীনের সাথে। নয়া দিল্লির জন্য এটি এক মাথাব্যথার কারণ।
মে মাসে ভারত সরকার করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য ২৭৩ বিলিয়ন ডলারের জরুরি অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করে। মোদির দল অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতার গুণগান গাইছে। অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও করোনার প্রভাবে সংরক্ষণবাদের দিকে ঝোঁক সৃষ্টি হয়েছে।চীনের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা হ্রাস করার আশঙ্কার মধ্যে প্রতিবেশীর হুমকিতে থাকা জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগই ফুটে ওঠেছে।
এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সঙ্ঘাত ও ডিজিটাল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির কথা বলা যায়। চীনের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা হ্রাস করার বিষয়টি কেবল সীমান্ত সঙ্ঘাতের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা না করে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে যাচাই করা উচিত।
এক সময় বিশ্বের অর্ধেক উৎপাদন হওয়া চীন ও ভঅরত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বদ্ধ, পরিকল্পিত অর্থনীতির পথ গ্রহণ করে। এর একটি কারণ ছিল ১৯ ও ২০ শতকের বিশ্ব শক্তিগুলোর উপনিবেশিক তিক্ত স্মৃতি। কিন্তু ওই অবস্থায় তারা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারেনি। বরং অর্থনীতি খুলে দেয়ার পরই তারা প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারছেন।
চীন ১৯৭৮ সালে দেং জিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি গ্রহণ করে বিশ্বের কারখানায় পরিণত হয় সস্তা শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করে পণ্যসম্ভার তৈরী করে। চীনের পথ অনুসরণ করে ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও অর্থনীতির বাধ্যবাধকতা তুলে নেন। বিজ্ঞান শিক্ষায় দেশটির শক্তিশালী অবস্থানের কারণে ভারত তথ্যপ্রযুক্তি, সফটওয়্যার ও আউটসোর্সিং শিল্পে দারুণ করে।
চীন অনেক আগেই শ্রমঘন ম্যানুফেকচারিং শিল্প আত্মস্থ করলেও ভারত অনেক পিছিয়ে আছে। দেশটি প্রতি বছর কর্মী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা এক কোটি লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থঅ করতে হিমশিম খাচ্ছে। এই সমস্যার আলোকে ২০১৪ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করে মোদি ‘মেইক ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন।
কিন্তু ছয় বছর পর মেইক ইন ইন্ডিয়া কর্মসূচি তেমন কিছুই দিতে পারেনি। সমালোচকেরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ খাতের দিকে নজর দিতে না পারার কারণেই এমনটা হয়েছে।তারপর এলো করোনাভাইরাস ও চীনের সাথে সীমান্ত যুদ্ধ। মোদি সরকার এই প্রেক্ষাপটে চীনের সাথে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা হ্রাস করার লক্ষ্য স্থির করলেন।
ভারতের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে।
প্রথমটি হলো তার ঘরোয়া বাজারের আকার। জাতিসঙ্ঘের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৭ সালে চীনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হবে ভারত। ২০৩০ সাল নাগাদ, তাদের জনসংখ্যা ১.৫ বিলিয়ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।পরবর্তী ৫ বছরে ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণি ৩০০ মিলিয়ন থেকে বেড়ে ৬০০ মিলিয়ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে করোনা মহামারি বাধার সৃষ্টি করতে পারে।
ভারতের আরেকটি বড় সুবিধা হলো এর শিল্প ভিত্তি। ভারতের ম্যানুফেকচারিং খাত অনুন্নত হলেও তারা ম্যাচ বাক্স থেকে শুরু করে পরমাণু বোমা পর্যন্ত বিভিন্ন সামগ্রী তৈরী করে। আর তা হচ্ছে অতীতের বদ্ধ অর্থনীতির অবশিষ্টাংশ।
আবার করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতি সমস্যায় পড়লেও গুগল ঘোষণা করেছ, তারা দেশটিতে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। আর আরেক মার্কিন টেক জায়ান্ট অ্যাপল তাদের সর্বশেষ মডেলের আইফোন ১১ হ্যান্ডসেট ভারতে উৎপাদন করবে বলে জানিয়েছে।
মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির অর্থনৈতিক আদর্শ হলো স্বদেশী দর্শনের ওপর নির্মিত। মধ্য ২০ শতকে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিক্রমায়। অ্যাক্টিভিস্টরা ওই সময়ের ভারতবর্ষের উপনিবেশিক প্রভু ব্রিটেনের পণ্য বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
ইনস্টিটিউট ফর ইন্ডিয়ান ইকোনমিক স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিরোশি সুগায়া বলেন, মেইক ইন ইন্ডিয়া ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি সন্দেহাতীতভাবে স্বদেশী আন্দোলনই।
বর্তমানে প্রতিপক্ষ হিসেবে যুক্তরাজ্যের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে চীন। বিশ্বজুড়ে সংরক্ষণবাদী ভাবাবেগ ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর আত্মনির্ভরতা বুদ্ধিমান, প্রোঅ্যাক্টিভ সিদ্ধান্ত নাকি সেকেল আমদানি বিকল্প কৌশলের ভিত্তিতে ক্ষীণ দৃষ্টির চমকবাজি? ভারত শিগগিরই মানব ইতিহাসের সবচেয়ে জনবহুল দেশে পরিণত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটেই দেশটি বিশাল মাত্রায় একটি অর্থনৈতিক পরীক্ষা করতে যাচ্ছে।
লেখক : এডিটর-ইন-চিফ, এডিটোরিয়াল হেডকোয়াটার্স ফর এশিয়া
নিক্কিই এশিয়ান রিভিউ