ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিনে যে ক্ষতি হতে পারে
করোনা ভ্যাকসিন - ছবি : সংগৃহীত
চীনে আবির্ভূত হওয়া করোনাভাইরাসটি গত আট মাসে ছড়িয়ে পরেছে ২১৩টি দেশে, সংক্রমিত করেছে দুই কোটি ১১ লাখ মানুষকে এবং মৃত্যু ঘটিয়েছে সাড়ে সাত লাখের উপরে। করোনা মহামারীর কেন্দ্র ইউরোপ-আমেরিকা ঘুরে এখন অবস্থান নিয়েছে ল্যাটিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ায়। মৃত্যুহার আগের চেয়ে কিছুটা কমে এলেও সংক্রমণের হার এখনো ঊর্ধ্বগতি। এ থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়ই হচ্ছে একটি নিরাপদ এবং কার্যকরী ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন দৌড়ে কে কোথায়?
আবির্ভাবের পরপরই চীন করোনাভাইরাসটির জেনম সিক্যুয়েন্স করে দ্রুতগতিতে এবং তা উন্মুক্ত করে দেয় সবার জন্য। এই সিক্যুয়েন্সকে ভিত্তি করে চলতি বছরের শুরু থেকেই কয়েকটি দেশ ভ্যাকসিন তৈরির কাজে নেমে পড়ে সর্বশক্তি নিয়ে; যার মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং জার্মানি অগ্রগামী। ভ্যাকসিন দৌড়ে এখন পর্যন্ত অংশ নিয়েছে মোট ১৬৫টি ভ্যাকসিন, যার মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে ল্যাবরেটরি পর্যায়ে এবং ৩১টি রয়েছে বিভিন্ন ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে থাকা ভ্যাকসিনগুলোর মধ্যে শেষ ধাপ বা ফেইজ-৩ ট্রায়ালে রয়েছে অক্সফোর্ডের চ্যাডক্স-১, মর্ডানার এমআরএনএ ভ্যাকসিন, জার্মানির বায়োন্টেক এবং চীনের সিনোভ্যাক ও ক্যানসিনোবায়ো ভ্যাকসিন। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন তাদের ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষ করবে সেপ্টেম্বরে এবং অক্টোবরেই তারা ভ্যাকসিনটি বাজারে আনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে মর্ডানা এবং সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিন এ বছরের শেষে বা আগামী বছরের প্রথমে বাজারে আনতে পারে। ক্যানসিনোবায়ো মাত্র তাদের ফেইজ-৩ ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছে সৌদি আরবে।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন এবং মিডিয়া হাইপ!
আগস্টের আগ পর্যন্ত রাশিয়ার ভ্যাকসিন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় ছিল না। হঠাৎ করেই রাশিয়া ঘোষণা দিলো, তারা সফল করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেছে এবং তা সর্বসাধারণের ওপর ১২ আগস্ট থেকে প্রয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। অভিনবভাবে ভ্যাকসিনটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কন্যাকে টিকা দেয়ার মাধ্যমে! এভাবেই ভ্যাকসিন দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হয় রাশিয়া। তারা তাদের ভ্যাকসিনটির নাম দেয় স্পুটনিক-ভি!
স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিনটি উদ্ভাবন করেছে মস্কোর গ্যামালেয়া ইনস্টিটিউট। ভ্যাকসিনটি তারা তৈরি করেছে তাদের উদ্ভাবিত দ্বৈত-অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে তারা সম্প্রতি ইবোলাভাইরাস ভ্যাকসিন তৈরি করে এবং তা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনটি তৈরি শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাস (সিএইচ-অ্যাড) ভেক্টরে এবং চীনের ক্যানসিনোবায়ো ভ্যাকসিনটি তৈরি হিউম্যান অ্যাডিনোভাইরাস (অ্যাড-৫) ভেক্টরে। তবে গ্যামালেয়া এ ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে একটির বদলে দুটি অ্যাডিনোভাইরাস। একটি অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর (অ্যাড-২৬) ব্যবহার করা হবে প্রথম ডোজ ভ্যাকসিনে এবং আরেকটি অ্যাডিনোভাইরাস (অ্যাড-৫) ব্যবহার করা হবে ২১ দিন পরে দেয়া দ্বিতীয় ডোজে। তাদের দাবি অনুযায়ী এভাবে দুই ধরনের অ্যাডিনোভাইরাস ব্যবহার করলে ইমিউন রেসপন্স বেশি হয় এবং ভ্যাকসিনটি দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেয়।
ভ্যাকসিন তৈরির এই পদ্ধতিতে রিকম্বিনেন্ট টেকনোলজির মাধ্যমে অ্যাডিনোভাইরাসের মধ্যে করোনাভাইরাসের স্পাইকপ্রোটিনের জিন প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়। এতে করে অ্যাডিনোভাইরাসটি যখন টিকার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে, তখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম এই ভাইরাসটিকে করোনাভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত করে এর বিপরীতে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা পরবর্তীতে আমাদের আসল করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দেয়। তবে জনসাধারণের ব্যবহারের আগে এভাবে তৈরিকৃত ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ
একটি ভ্যাকসিন কতটুকু নিরাপদ এবং কার্যকরী তা দেখার জন্য তিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়। প্রথম ধাপের (ফেইজ-১) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয় স্বল্পসংখ্যক (২৫-১০০ জন) সুস্থ মানুষের ওপর। এই ধাপের ট্রায়ালে দেখা হয় প্রয়োগকৃত ভ্যাকসিনটি শরীরে কোনোরূপ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে কি না এবং কতটুকু ইমিউন রেসপন্স করে। দ্বিতীয় ধাপের (ফেইজ-২) ট্রায়াল করা হয় অপেক্ষাকৃত অধিকসংখ্যক (১০০-৫০০ জন) সুস্থ ভলান্টিয়ারের ওপর। এই ধাপে নির্ধারণ করা হয় ভ্যাকসিনটির কার্যকরী ডোজ এবং তা শরীরে কতটুকু নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি এবং টি-সেল বা ইমিউন সেল রেসপন্স ঘটাতে পারে।
এই দুটো ধাপে সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেলে শুরু করা হয় শেষ ধাপের (ফেইজ-৩) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল। এই ধাপের ট্রায়ালটি করা হয় ১০-৩০ হাজার সুস্থ মানুষের ওপর। এই ট্রায়ালটি হতে হবে প্ল্যাসিবো-কন্ট্রোল্ড ডাবল-ব্লাইন্ড ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল, যেখানে ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারী অর্ধেকের শরীরে দেয়া হয় ভ্যাকসিন এবং বাকি অর্ধেককে দেয়া হয় প্ল্যাসিবো। এরপর তাদের মুক্তভাবে চলাফেরা করতে দেয়া হয় জনমানুষের ভেতরে, যেখানে করোনা মহামারী চলমান। ট্রায়াল শেষে দেখা হয়, আসল ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের ভেতরে কতজন করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের ভেতরে যদি ৬০-৭০ শতাংশ করোনা থেকে মুক্ত থাকে তাহলে ধরে নেয়া হয় যে ভ্যাকসিনটি কার্যকরী। এই ফলাফলের পরই একটি নতুন ভ্যাকসিন সর্বসাধারণে প্রয়োগের অনুমতি দেয়া হয়।
অক্সফোর্ড, মর্ডানা, বায়োন্টেক এবং সিনোভ্যাক তাদের ভ্যাকসিনের সফল ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর এখন চালাচ্ছে ফেইজ-৩ ট্রায়াল। অন্য দিকে, রাশিয়ার গ্যামালেয়া ইনস্টিটিউট তাদের ভ্যাকসিনের কোনো প্রকার ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই জনসাধারণের ওপর প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাশিয়াতে নতুন আইন অনুযায়ী ভ্যাকসিন অনুমোদনের জন্য ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন নেই।
যেখানে অক্সফোর্ড, মর্ডানা, বায়োন্টেক বা ক্যানসিনোবায়ো সবাই তাদের ভ্যাকসিন গবেষণার ফলাফল বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেছে, সেখানে রাশিয়া তাদের ভ্যাকসিনটির কোনো বৈজ্ঞানিক ফলাফল কোনো বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশ করেনি। সম্প্রতি তারা তাদের ওয়েবসাইট স্পুটনিকভ্যাকসিন ডটকমে কিছু তথ্য সংযুক্ত করেছে! তবে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক তথ্যের অনুপস্থিতির কারণেই তাদের ভ্যাকসিনটি নিয়ে বিজ্ঞানীদের ভেতর সৃষ্টি হয়েছে উৎকণ্ঠা।
এমন উৎকণ্ঠা রয়েছে সিনোভ্যাক ভ্যাকসিনটি নিয়েও। এই ভ্যাকসিনটিরও ফেইজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কোনো রিপোর্ট কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এমতাবস্থায় বাংলাদেশে এই ভ্যাকসিনটির ফেইজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানো নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রাশিয়ার ভ্যাকসিনটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে এবং তড়িঘড়ি সর্বসাধারণে প্রয়োগে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। আমেরিকার করোনা মহামারী টাস্কফোর্স প্রধান বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ফাউচি রাশিয়ার ভ্যাকসিনটির যথাযথ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না করেই সর্বসাধারণে প্রয়োগের সিদ্ধান্তকে অবৈজ্ঞানিক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। অনিরাপদ বা অকার্যকর ভ্যাকসিন প্রয়োগের সাথে স্বাস্থ্যহানি বা জীবণনাশের সম্পর্ক রয়েছে।
ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিনের ক্ষতিকর দিক :
পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া তড়িঘড়ি করে উৎপাদিত ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিন বয়ে আনতে পারে বিপর্যয়। যেমনÑ ১৯৫৫ সালে তড়িৎ গতিতে উৎপাদিত কিছু পোলিও ভ্যাকসিনে জীবন্ত পোলিও ভাইরাস ছিল। এই ত্রুটিপূর্ণ ভ্যাকসিন যে ৭০ হাজার শিশুকে দেয়া হয়েছিল তাদের সবার মাংসপেশিতে দুর্বলতা দেখা দিয়েছিল, ১৬৪ শিশু প্যারালাইজ্ড হয়ে গিয়েছিল এবং মৃত্যুবরণ করেছিল ১০ শিশু। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫৫-১৯৬৩ সালে দেয়া ৩০ শতাংশ পোলিও ভ্যাকসিনে জীবন্ত সিমিয়ান ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই ভাইরাসের দূষণটি ঘটে ল্যাবরেটরিতে ভ্যাকসিন প্রস্তুতির সময়। এসব ঘটনার কারণে ইদানীং ভ্যাকসিন উৎপাদনে অত্যধিক সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
শুরুতে করোনাতে মৃত্যুহার বেশি থাকলেও এখন কিন্তু মৃত্যুহার অনেকটা কমে এসেছে। বাংলাদেশে এই হার এখন ১.২ শতাংশ, ভারতে ২ শতাংশ এবং ব্রাজিলে প্রায় ৩ শতাংশ। ভ্যাকসিনও উৎপাদন করতে যাচ্ছে বেশ কয়েকটা নামী কোম্পানি। অতএব স্বাস্থ্যঝুঁঁকির কথা বিবেচনা করে আমাদের উচিত হবে তাদের কাছ থেকে ভ্যাকসিন গ্রহণ করা যারা তা উৎপাদন করেছে যথাযথ নিয়ম মেনে পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে।
লেখক : এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য