আর গোপন সম্পর্ক নয়

মাসুম খলিলী | Aug 18, 2020 06:50 pm
আর গোপন সম্পর্ক নয়

আর গোপন সম্পর্ক নয় - ছবি : সংগৃহীত

 

সংযুক্ত আরব আমিরাত-ইসরাইলের চুক্তি সম্পর্কে ইসরাইলের গোয়েন্দা বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান ডেবকাফাইলের বক্তব্যটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর বর্ণনাটি ঠিক এরকম, ‘আরব বিশ্বে প্রচলিত প্রায় একটি ধর্মীয় প্রজ্ঞা ছিল যে ১৯৬৭ সালের পূর্বের সীমান্তের মধ্যে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের আগে ইসরাইলের সাথে কোনো সাধারণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা (পড়–ন স্বীকৃতি) করা যাবে না। ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক সংযুক্ত আরব আমিরাত-ইসরাইল ঐতিহাসিক চুক্তি এটিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ধনী উপসাগরীয় আরব দেশ কোনো শঙ্কা ছাড়াই এই শর্তটি (ইসরাইলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা) বাদ দিয়ে দিয়েছে এবং ইহুদি রাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘকালীন গোপনীয় সম্পর্কের আবরণ তুলে নিয়ে আনুষ্ঠানিকতা প্রদান করেছে।’

ডেবকাফাইল আরো লিখেছে, ‘আরব বিশ্বের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কের যে কোনো আলোচনা হতে পারে, তার আগে নেতানিয়াহুর পূর্বসূরিরা এবং পশ্চিমা শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারীরা ফিলিস্তিনিদের সাথে শান্তির জন্য ইসরাইলকে কতটা মূল্য দিতে হবে তা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হতেন। হঠাৎ করে, আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ (এমবিজেড) এবং প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে দেয়া-নেয়াতে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরের ইহুদি অঞ্চলগুলোতে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব সম্প্রসারণে তার পরিকল্পনা স্থগিত রাখতে রাজি হন, যদিও তিনি নির্বাচনে জনসাধারণকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা আসলে আইন, মানচিত্র বা কোনো টাইমলাইনের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তদুপরি, ফিলিস্তিনি ইস্যুটিকে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব এবং মারাত্মক অর্থনৈতিক পরিণতির কারণে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। অবশ্যই, সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের কাছে ভাজার জন্য আরো বড় মাছ ছিল।

তিনি আবুধাবি, আজমান, দুবাই, ফুজাইরাহ, রাস আল খাইমাহ, শারজাহ এবং উম্মুল কুওয়াইন সমন্বয়ে গঠিত সাত আমিরাতের একটি উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের নেতৃত্ব দেন। মাত্র দশ মিলিয়ন নাগরিক এবং প্রায় নয় মিলিয়ন বিদেশী শ্রমিকের জনসংখ্যার সংযুক্ত আরব আমিরাত একসময় ব্যাকওয়াটার হিসেবে বিশ্বের অন্যতম উন্নত অর্থনৈতিক কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক মিডিয়া হাব এবং একটি আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বহু বছর ধরে, এর সরকার ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা সম্পর্ক আর মোসাদ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সের সাথে গোয়েন্দা সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দুটি দেশ ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে শিয়া ইরান এবং এই অঞ্চলে এর সম্প্রসারণবাদী হস্তক্ষেপের গভীর সন্দেহ করে। আবুধাবি এবং তেহরানের মধ্যে উপসাগরীয় কয়েকটি দ্বীপ নিয়ে বিতর্কও রয়েছে।’

ডেবকাফাইল আরো বলেছে, ‘ইসরাইলের সাথে আমিরাতের চুক্তি এই অঞ্চলে গভীর ধর্মীয়-রাজনৈতিক বিভাজনকে তীব্র করে তুলেছে। বাহরাইন আর ওমানের মতো মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি আরব আমিরাতের ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেবার চুক্তিকে এই অঞ্চল ও শান্তির পক্ষে মঙ্গলজনক বলে অনুমোদন করেছে। অন্য দিকে তুরস্ক ও ইরান এর নিন্দা জানিয়েছে। রাষ্ট্রপতি রজব তৈয়ব এরদোগান বলেছেন, তিনি আবুধাবিতে তুরস্কের দূতাবাস বন্ধ করা, এর রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার ও সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে বিবেচনা করছেন। মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং বেশির ভাগ উপসাগরীয় আরব সরকার ইরানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময়ও মুসলিম ব্রাদারহুডকে অস্বীকার করে। অন্য দিকে তুরস্ক তাদের সমর্থন করে এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তার অফসুট হামাসকে সমর্থন করছে। ইয়েমেনে, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব যৌথভাবে একটি জোটের নেতৃত্ব দেয় যা ইরান-সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি অমীমাংসিত যুদ্ধে লড়াই করে আসছে। এমবিজেডের (পড়–ন : ইসরাইল অনুমোদিত) আঞ্চলিক আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংযুক্ত আরব আমিরাত দক্ষিণ ইয়েমেনের দিকে একা অগ্রসর হচ্ছে। গত জুনে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাহিনী লোহিত সাগরের আন্তর্জাতিক শিপিং লেনকে উপেক্ষা করে কৌশলগত ইয়েমেনী দ্বীপপুঞ্জ সোকোত্রা দখল করে। এই বাহিনী দ্বীপপুঞ্জ থেকে সরে এসে একটি ছোট সামরিক ঘাঁটি রেখে গেছে।’

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার বিসর্জন
সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের চুক্তির সবচেয়ে বড় দিকটি হলো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে শর্ত ছিল সেটিকে বিসর্জন দেয়া। এক দিকে মিসর, জর্দান ও সিরিয়া এবং অন্য দিকে ইসরাইলের মধ্যে ১৯৬৭-এর ইসরাইল-আরব যুদ্ধের পরে আরব দেশগুলো জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ২৪২ প্রস্তাবকে বাস্তবায়নে চাপ দেয়। নিরাপত্তা পরিষদের এই প্রস্তাবকে (ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দুটি রাষ্ট্র পাশাপাশি থাকা) বছরের পর বছর ধরে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছিল আরব এবং ইসরাইল মধ্যে আলোচনার। এই প্রস্তাবের মূল উপাদান হলো ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় দখল করা সব অঞ্চল ইসরাইল ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিরিয়ে দেবে। ইসরাইল এই অঞ্চলগুলোকে সমর্পণ না করা পর্যন্ত আরব লীগ একমত হয়েছিল যে ইসরাইল রাষ্ট্রের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠা, স্বীকৃতি দান বা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে কোনো আলোচনা হবে না। তবে মিসর ও জর্দান ১৯৭৭ এবং ১৯৯৪ সালে ইসরাইলের সাথে আলোচনা এবং পরে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে দেশটির সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

২০২০ সালের ১৩ আগস্ট ইসরাইলের সাথে সংযুক্ত আরব আমিরাত তৃতীয় আরব দেশ হিসেবে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে এবং সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এই ঘোষণা দেয়ার সময় অনেকে অবাক হন। ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন যে, ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর ও ধুমধামের ঘটনা ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হবে।
ট্রাম্পের মতে, ইসরাইল নিজ মানচিত্রে পশ্চিম তীরের সংযোজন স্থগিত করতে সম্মত হয়েছে। আরব লীগের সদস্য রাষ্ট্রের এই সর্বশেষ পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের লড়াইয়ে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করল এবং আরব লীগকে এটি নিঃসন্দেহে আরো দুর্বল করে দেবে। ফিলিস্তিনিদের সাথে সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানে ইসরাইলকে চাপ দেয়া এখন আরো কঠিন হবে। আরব লিগের অন্যতম উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল আরব দেশগুলোর মধ্যে একটি সুসঙ্গত আঞ্চলিক পররাষ্ট্রনীতি প্রতিষ্ঠা করা। এই প্ল্যাটফর্মে ঐকমত্য হয় কম। এখন বিভাজনটা আরো বেড়ে গেল।

আরো দেশ লাইনে!
ইসরাইল এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য ইস্যুতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাম্প্রতিক বিদেশী নীতি অন্য কয়েকটি দেশ সম্ভবত অনুসরণ করার ক্ষেত্রে আদর্শ হয়ে উঠবে। সৌদি আরব ইতোমধ্যে ইসরাইলের সাথে নিয়মিত সংযোগ বজায় রাখার মধ্য দিয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। জেরুসালেমের আল-আকসা কম্পাউন্ডে ইসলামিক ওয়াকফ কাউন্সিলের সৌদি প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ইসরাইল ও সৌদি আরব গত ডিসেম্বরের পর থেকে গোপন বৈঠক করেছে।

ফিলিস্তিনিরা দু’দেশের সম্পর্কের সাম্প্রতিক স্বাভাবিকতাকে ঘৃণা করেছে। তদুপরি, দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ বা যোগাযোগের অর্থ হলো ফিলিস্তিনের ওপর অব্যাহত বোমা হামলা ও অবরোধকে সমর্থন করা। ইসরাইল গাজায় বোমা হামলা চালিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ট্রাম্পের আমিরাত ঘোষণা আসে। একই সাথে ফিলিস্তিন অঞ্চল থেকে অব্যাহতভাবে উচ্ছেদ অভিযানও চালানো হচ্ছে। ইসরাইল গাজা উপত্যকায় হামাসের লক্ষ্যবস্তুতে বৃহস্পতিবারও আক্রমণ করেছিল। আর ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুসালেমের বিতর্কিত স্বীকৃতিটিকে গ্রহণ করে নেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us