কঠিন সমস্যায় সু চি
সু চি - ছবি : সংগৃহীত
মিয়ানমারে শান্তি অনেক দিন ধরেই মরীচিকা হয়ে আছে। ৭০ বছর ধরে দেশটি গৃহযুদ্ধ আর সহিংসতায় বিপর্যস্ত হয়ে রয়েছে। তবে ৯ বছর ধরে দীর্ঘ ও তীব্র আলোচনার পর, শুরু করেছিলেন প্রেসিডেন্ট থিন সিন এবং তার পর ২০১৬ সালে স্টেট কাউন্সিলর হওয়ার পর তা এগিয়ে নেন আং সান সু চি, নতুন সংবিধানের মূল ভিত্তি হিসেবে গণতান্ত্রিক ও ফেডারেল মূলনীতি প্রশ্নে একটি সমঝোতার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
তবে চোরাগর্ত আছে অনেক। গত সোমবার নেপিতাওয়ে শুরু হওয়া চতুর্থ দফার ‘পাঙ্গলঙের’ (শান্তি প্রক্রিয়া) বিশৃঙ্খলভাবে শেষ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
যদিও শান্তিপ্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের সরকার, সামরিক বাহিনী, বিভিন্ন বিদ্রোহী জাতিগত গ্রুপ অংশগ্রহণ করছে, কিন্তু তবুও তা অন্তর্ভুক্তমূলক নয়।
মিয়ানমারের যুদ্ধরত জাতিগত গ্রুপগুলো যারা ন্যাশনাল সিজফায়ার (এনসিএ) সই করেছে ও করেনি, এমনভঅবে বিভক্ত। যারা সই করেনি, তাদেরকে শান্তিপ্রক্রিয়া থেকে বাদ রাখা হয়েছে। আবার কেউ অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তবে শান্তিপ্রক্রিয়াটি অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্য এটি সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তমূলক হওয়া দরকার।
সম্মেলনের ব্যাপারে সরকার না বুঝেই উৎসাহিত বলে মনে হচ্ছে। তবে নভেম্বরের নির্বাচনের আগে এটাই হবে শেষ সম্মেলন। ফলে অনেক জাতিগত নেতা অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে ইতস্তত করছে এই আশঙ্কায় যে এটি হবে স্রেফ প্রতীকী। গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যাপারেই সমঝোতা হবে না। তারা আরো আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে সীমান্ত এলাকাগুলোতে তীব্র যুদ্ধ চলতে থাকায় আলোচনা করার জায়গাই থাকবে না।
শান্তিপ্রক্রিয়ায় এখন ১০টি সশস্ত্র গ্রুপ সম্পৃক্ত রয়েছে। তারা সবাই এনসিএতে সই করেছে। এগুলো হলো অল বার্মা স্টুডেন্টস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট, আরাকান লিবারেশন পার্টি, চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট, ডেমোক্র্যাটিক কারেন বেনেভোলেন্ট আর্মি, কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ), কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি পিস কাউন্সিল, পা-ও ন্যাশনাল লিবারেশন অর্গ্যানাইজেশন, রেস্টোরেশন কাউন্সিল অব শান স্টেট (আরসিএসএস), নিউ মন স্টেট পার্টি, ও লাহু ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন।
তবে ওয়া ও কচিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহী সেনাবাহিনীতে এতে অন্তর্ভুক্ত নয়। এছাড়া আরো অন্তত ছয়টি গ্রুপ বাদ পড়েছে। এগুলোর অন্যতম হলো আরাকান আর্মি। এই দলটিকে সামরিক বাহিনী স্বীকৃতি দেয়নি। চলতি বছরের প্রথম দিকে এসব গ্রুপকে সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করা হয়।
অবশ্য, সরকার সবসময় এসব সই না করা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে শান্তিপ্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা ও এনসিএতে সই করানো।
কিন্তু জাতীয় নির্বাচন এগিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে এসব গ্রুপের এনসিএতে সই করার প্রতি আগ্রহ খুবই কম।
বছরখানেক ধরে এমনকি আনুষ্ঠানিক শান্তিপ্রক্রিয়াও থমকে আগে, প্রায় পতনের মুখে রয়েছে। জাতিগত সশস্ত্র গ্রুপগুলোর মধ্যে যারা এনসিএতে সই করেছিল, তাদের সাথে আলোচনায় অগ্রগতি হয়নি। আবার প্রধান দুটি গ্রুপ কেএনইউ ও শান আরসিএসএস অংশগ্রহণ থেকে বিরত রয়েছে। অবশ্য অনেক দফায় অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হলেও কোভিড-১৯-এর কারণে স্থগিত হয়ে যায় আবারো।
এসব বাধা সত্ত্বেও সম্মেলনের প্রস্তুতি এগিয়ে চলছে। তবে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৩০০-এর মধ্যে সীমিত করা হতে পারে। আগেরবার এক হাজারের বেশি ছিল অংশগ্রহণকারী।
পর্দার অন্তরালে এনসিএ সইকারীদের বেশির ভাগই সন্দীগ্ধ ও নিমরাজি রয়েছে। একজন মন্তব্য করেছেন, প্রতিটি প্যাঙ্গলং সভায় দেখা গেছে, আগেরটির চেয়ে পরেরটিতে কাজ হয়েছে কম। কিছু অংশগ্রহণকারীর বিবৃতির মধ্যেই সীমিত থাকছে।
আর সামরিক বাহিনী ঠিক এটিই চায়। শান আরসিএসএস গ্রুপ অব্যাহতভাবে অভিযোগ করে আসছে যে তাতমাদাও, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী, এমনকি ২০১২ সালে একক যুদ্ধবিরতি চুক্তিটিও পালন করতে নারাজ।
এদিকে সেনাবাহিনীর সাথে আরসিএসএস ও কেএনইউর লড়াই অব্যাহত আছে। তাছাড়া কচিন ও শান এসএসপিপির সাথেও লড়াই চলছে। আরাকান আর্মির সাথেও প্রচণ্ড যুদ্ধ হচ্ছে।
অবশ্য এই সম্মেলনে কয়েকটি চুক্তি হতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রথম দুটি চুক্তি হবে এই মর্মে যে ২০২০ সালের নির্বাচনের পরও শান্তিপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে। এনসিএ বাস্তবায়নের কাঠামো নিয়েও একটি চুক্ত আছে। এতে সামরিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ইস্যুসহ আটটি বিভিন্ন ক্যাটাগরি স্থান পেয়েছে।
গণতান্ত্রিক ও ফেডারেল মূলনীতি নিয়ে বেশ কয়েকটি চুক্তিও হতে পারে। গত অক্টোবরে তৃতীয় সম্মেলনে সু চি এসব প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ফেডারেল ট্রাইব্যুনাল, ক্ষমতার ভাগাভাগি, ইউনিয়ন ও রাজ্যের মধ্যে সম্পদ ও রাজস্ব বণ্টন, রাজ্য ও অঞ্চলগুলোর সমান অধিকার থাকা, জনগণের মৌলিক অধিকার থাকার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ৫ দফার একটি রোড ম্যাপও আলোচনায় থাকছে। সমঝোতা হলে এগুলো পরে ইউনিয়ন অ্যাকর্ডে স্থাপন পারে এবং তা পার্লামেন্টে অনুমোদন করার জন্য উপস্থাপন করা হবে।
তবে বর্তমান সম্মেলনে এসব মূলনীতির ভিত্তিই কেবল স্থাপন করা হতে পারে। সু চি বলেছেন, খসড়া সংবিধান প্রণয়নের আগে আমাদেরকে বিস্তারিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
তবে এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে। পরিভাষা নিয়ে ইতোমধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে গেছে। সামরিক বাহিনী স্টেট কনস্টিটিউশন শব্দটির ব্যাপারে আপত্তি করে জানিয়েছে, এটি হতে পারে স্টেট বেসিক ল।
জাতিগত অনেক নেতা আশঙ্কা করছেন, আসন্ন নির্বাচন শান্তিপ্রক্রিয়াকে ছায়াপাত করবে। ফলে বর্তমান সম্মেলন আড়ালে চলে যাবে। অনেক নেতা আশঙ্কা করছেন, সাবেক ক্ষমতাসীন দল ইউনিয়ন সলিডারিটি ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) জয়ী হলে শান্তিপ্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যেতে পারে।
জাতিগত এক নেতা বলেন, তবে শান্তিপ্রক্রিয়ার সবচেয়ে খারাপ ফলাফল হবে ইউএসডিপি সামরিক জোট।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর