আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে ভারতের যুদ্ধ পরিকল্পনা
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে ভারতের যুদ্ধ পরিকল্পনা - ছবি : সংগৃহীত
শনিবার লাল কেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেছেন, ভারতের ১,৩০০ দ্বীপের মধ্যে কিছু দ্বীপের ‘উন্নয়নে’ অগ্রাধিকার দেয়া হবে। আর, আগামী ১,০০০ দিনের মধ্যে লাক্ষাদ্বীপে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক সংযোগ দেয়া হবে।
যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে সেটা অর্থনৈতিক, সামরিক, নাকি একসাথে দুটোই-স্পষ্ট করেননি মোদি। তবে উন্নয়নটা সামরিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি দুটো কারণে: প্রথমত, আন্দামান আর নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ (এএনআই) এবং লাক্ষাদ্বীপের বিরাট কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। দ্বিতীয়ত, ২০১৭ সালে সরকার এএনআই-তে পর্যটনের উন্নয়নের যে পরিকল্পনা নিয়েছিল, সেটা ব্যর্থ হয়েছে। হিন্দু বিজনেস লাইন - এর (২১ জানুয়ারি, ২০২০) মতে, প্রাইভেট খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা দেখেছেন যে, দ্বীপে ৪-স্টার হোটেল নির্মাণ করতে প্রতিটির জন্য ব্যয় হবে ৪.২ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেখানে অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় হোটেলগুলো লাভজনক হবে না।
আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একদিকে ডানকান প্যাসেজ, অন্যদিকে টেন ডিগ্রি চ্যানেল। প্রেপারিস চ্যানেল আর সিক্স ডিগ্রি চ্যানেলের অবস্থান দ্বীপের সারির উত্তরে আর দক্ষিণে। নয়াদিল্লীর মনোহার পারিকার ইন্সটিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের (আইডিএসএ) ডিরেক্টর জেনারেল সুজান চিনোইয়ের মতে, এই চ্যানেল আর প্যাসেজগুলো দক্ষিণপূর্ব ও পূর্ব-এশিয়ামুখী জাহাজ পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য রুট।
আইডিএসএ জার্নালে ২০২০ সালের ২৬ জুন প্রকাশিত এক নিবন্ধে চিনোই লিখেছেন, “এএনআই-এর ৫৭২টি দ্বীপের মধ্যে মানববসতি রয়েছে ৩৮টিতে। ভারতের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের (ইইজেড) মধ্যে ৩০ শতাংশই রয়েছে এই দ্বীপগুলোতে। আন্দামান সাগরের সিক্স ডিগ্রি আর টেন ডিগ্রি চ্যানেলগুলো দিয়ে মালাক্কা প্রণালীতে যাওয়া যায় এবং এই চ্যানেলগুলো বৈশ্বিক বাণিজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই পথ দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে জ্বালানি পরিবহনসহ অন্যান্য বাণিজ্য চলে। এএনআই-এর অবস্থান ভারত মহাসাগর আর দক্ষিণ চীন সাগরের সংযোগ স্থলে, এবং প্রশান্ত মহাসাগরের আরও ভেতরে ইন্দো-প্রশান্ত কৌশলগত ধারণার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্যও এটা গুরুত্বপূর্ণ”।
তিনি উল্লেখ করেন, এএনআইকে প্রায়ই পূর্ব ভারত মহাসাগর অঞ্চলে ভারতের ‘বিমানবাহী রণতরী’ হিসেবে মন্তব্য করা হয়, যেটা কখনও ডুববে না। চীনের সমুদ্রপথে পরিবাহিত বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই এই পথ দিয়ে চলাচল করে। তিনি আরও বলেন, চীনের এই পরিবহনের উপরে বাধা সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কার কারণে চীনের ‘মালাক্কা সঙ্কট’ আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এ থেকেই বোঝা যায় চীন কেন ভারত মহাসাগর অঞ্চলে তাদের তৎপরতা বাড়াচ্ছে। চিনোই উল্লেখ করেন, “চীন ধারাবাহিকভাবে ভারত মহাসাগরে তাদের নৌ উপস্থিতির সম্প্রসারণ করেছে এবং এটা করতে গিয়ে তারা অব্যাহতভাবে নৌসেনা মোতায়েন করেছে, অস্ত্র বিক্রি করেছে, ঘাঁটি ও অ্যাকসেস ফ্যসিলিটি গড়েছে, সামরিক কূটনীতি জোরদার করেছে, বিভিন্ন উপকূলবর্তী দেশের সাথে বিশেষ রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করেছে, এবং কৌশলগত বিবেচনা থেকে বিপুল পরিমাণ উন্নয়ন সহায়তা বণ্টন করেছে। জলদস্যু প্রতিরোধের যুক্তিতে তারা এডেন উপসাগরে তাদের উপস্থিতির বাড়িয়েছে, এবং ভারতের হুমকির বিষয়টি সেখানে তারা বিবেচনায় নেয়নি”।
আরও আগ বাড়িয়ে তিনি বলেন : “আরেকটি জোরালো উদাহরণ হলো সাবমেরিন মোতায়েন, যেটা ২০১৪ সালে শ্রীলংকার কলম্বোতে নোঙ্গর করেছিল। চীন একই সাথে ভারত মহাসাগরে তাদের অপারেশনাল টার্নঅ্যারাউন্ডের (ওটিআর) মাত্রা বাড়িয়েছে এবং গোয়াদার ও জিবুতিসহ নতুন ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। আন্দামান সাগর ও বঙ্গোপসাগরেও চীনের উপস্থিতি বেড়েছে, যেখানে চীনের নৌবাহিনী এবং জরিপ জাহাজগুলো মাঝে মাঝে কোন ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ভারতের ইইজেড এলাকায় প্রবেশ করছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বঙ্গোপসাগর/পূর্ব ভারত মহাসাগর অঞ্চলে উপকূলবর্তী দেশ বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যাণ্ড ও মালয়েশিয়ার সাথে চীনের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সংশ্লিষ্টতা বৃদ্ধির বিষয়টিও নজরে পড়ে”।
কূটনীতিক থেকে গবেষক বনে যাওয়া চিনোই বলেন যে, এএনআই এবং অস্ট্রেলিয়ার কিলিং (কোকোস) দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে মালাক্কা, সুন্দা, লোম্বোক, এবং ওমবাই ওয়েটার প্রণালীর উপর সমন্বিত নজরদারির পরামর্শও এসেছে। একই সাথে, ভারত মহাসাগর এলাকায় যৌথভাবে সাবমেরিন-বিরোধী যুদ্ধের প্রচেষ্টার ব্যাপারেও সুপারিশ এসেছে, যেখানে এএনআই-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে।
স্মৃতি চৌধুরী ২০২০ সালের ২৯ জুলাই একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছেন, যার শিরোনাম হলো ‘লাদাখ টু আন্দামানস – হাউ ইন্ডিয়া ইজ বুস্টিং ইটস ডিফেন্স ক্যাপাবিলিটিজ ইন আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর আইল্যাণ্ডস টু থর্ট চায়না?’। এই নিবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন, উত্তর এএনআই-এর শিবপুরের আইএনএস কোহাসা নৌ বিমান স্টেশানে যে রানওয়ে রয়েছে, সেটিকে আরও বাড়ানো হয়েছে, যাতে বড় বিমানগুলো অবতরণ করতে পারে।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালে, ভারত আর জাপান দ্বীপপুঞ্জে অবকাঠামো উন্নয়নে যৌথ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেছিল। এর মধ্যে সাউন্ড সার্ভেইলেন্স সেন্সরস (সোসাস) চেইন স্থাপনের বিষয়টিও ছিল, যাতে ভারতের পানির নিচের সচেতনতা আরও বাড়ে। পরিকল্পনা ছিল ভারতের সাগরতলের সেন্সর চেইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্র-জাপানের ‘ফিশ-হুক’ সোসাস নেটওয়ার্ককে যুক্ত করা। মূলত দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের পিপলস লিবারেশান আর্মি-নেভির সাবমেরিন চলাচলের তৎপরতাকে পর্যবেক্ষণেই জন্যই এই আলোচনা হয়েছিল।
লাক্ষাদ্বীপের কৌশলগত গুরুত্ব
ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় রাজ্য কেরালা থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে লাক্ষাদ্বীপের অবস্থান। ৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপপুঞ্জের ২০,০০০ বর্গকিলোমিটার জলসীমা রয়েছে ভারতের এবং এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) রয়েছে প্রায় ৪০০,০০০ বর্গকিলোমিটার।
লাক্ষাদ্বীপে ভারতের এখন যে নৌ আউটপোস্ট রয়েছে, সেটাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ আভিযানিক ঘাঁটিতে রূপ দিতে চায় ভারত। এর মাধ্যমে ভারত তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়, সাগরে অন্যদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বিশেষ করে পাকিস্তান, মরিশাস, সেশেলস ও মালদ্বীপের সাথে সম্পর্কিত বিষয়ে তারা এই নিয়ন্ত্রণ অর্জন করতে চায়। ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট ফিউচার ডিরেকশান্সে প্রকাশিত নিবন্ধে বালাজি চন্দ্রমোহান এই তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, এই দ্বীপগুলোর অগ্রবর্তী বিমান ঘাঁটিগুলো ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে। বিমানগুলোকে এটা একটা বড় যুদ্ধক্ষেত্র বলয় তৈরি করে দেবে। “অ্যানড্রোথ দ্বীপে নেভাল ডিটাচমেন্ট (ন্যাভডেট) শুরুর মাধ্যমে ভারতীয় নৌবাহিনীর নজরদারি মিশনের গতি বেড়ে গেছে। এই দ্বীপের অবস্থান লাক্ষাদ্বীপগুলোর মধ্যে। ন্যাভডেট অ্যানড্রোথে ভারতীয় নৌবাহিনীর উপস্থিতিকে বাড়িয়ে দেবে, একটা যোগাযোগ নেটওয়ার্ক উপহার দেবে এটা যেটার মাধ্যমে মূল ভূখণ্ডের সাথে দ্বীপপুঞ্জ সংযুক্ত থাকবে।
চন্দ্রামোহান বলেছেন যে, আগে থেকেই ভারত, শ্রীলংকা ও মালদ্বীপের মধ্যে ত্রিদেশীয় নৌ নিরাপত্তা সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে। মালদ্বীপের বিভিন্ন দ্বীপে যে ২৬টি রাডার স্থাপন করা রয়েছে, সেগুলো লাক্ষাদ্বীপের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যুক্ত হবে ভারত এবং এটা আবার ভারতের সাউদার্ন কমান্ডের সাথে যুক্ত থাকবে।
তিনি বলেন, এর উদ্দেশ্য হলো পূর্ব ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌ তৎপরতাকে সীমিত রাখা। “ভারত মহাসাগরের ব্যাপারে চীনের অতি আগ্রহ, যেটা তাদের ক্রমবর্ধমান নৌ উপস্থিতি এবং জিবুতিতে তাদের প্রথম সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে – এতে লাক্ষাদ্বীপের কাভারাট্টিতে ভারতের সামরিক কৌশল ঢেলে সাজানোর গুরুত্ব আরও বেড়েছে।
ইউনিভার্সিটি অব উলোনগংয়ের অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল সেন্টার ফর ওশান রিসোর্সেস অ্যান্ড সিকিউরিটির (অ্যাঙ্করস) প্রকাশ গোপাল সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একক নিরাপত্তা প্রদানকারী হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনীকে ১৫ বছরের মধ্যে ২০০ জাহাজের যে বহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে তা নয়াদিল্লীর ধারাবাহিকতাহীন নীতির কারণে ব্যর্থ হতে পারে।
গোপাল বলেন, “বেশ কিছু দেশী প্রকল্প কাটছাটের খবর প্রকাশের পর, ভারতীয় ফার্মগুলোর অবস্থান নিয়ে অবশ্যই আরও অনিশ্চয়তা তৈরি হবে। দেখতে আকর্ষণীয় মনে হলেও, অধিকাংশ ফার্মই এখানে বিনিয়োগ করতে স্বস্তি পাবে না কারণ এই খাতটি লালটেপের দৌরাত্ম, সরকারের অনীহা, এবং ধারাবাহিকতাহীন নীতি দিয়ে জর্জরিত। ভারতের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা প্রস্তুতির জন্য এটা খুব একটা ইতিবাচক হবে না”।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর