মহররমের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও ফজিলত
মহররমের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও ফজিলত - ছবি : সংগৃহীত
আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী দ্বীন প্রচারে প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করে মাদিনায় হিজরত করেন। যাকে কেন্দ্র করেই আজকের হিজরি সন। যা মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে আলোকবর্তিকা হিসেবে আজো জাগরিত আছে। মূলত রাসূল সা:-এর হিজরতের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হিজরি সনের শুভ সূচনা হয়। ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, খ্রিষ্টানদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি লিপিবদ্ধ করার জন্য রাসূল সা: চুক্তিপত্রের নিচে হিজরতের পঞ্চম বর্ষ উল্লেখ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ চুক্তি রচনাকারী ছিলেন আলী রা:। সম্ভবত এ কারণেই ইবনে আসাকের বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে হিজরি সনের সূচনা হয়েছিল রাসূল সা:-এর আমলেই। মুসলিম মিল্লাতের বৃহত্তম ঐক্যের স্থায়ী প্রতীক চান্দ্রবর্ষপঞ্জী বা হিজরি সনের প্রবর্তক খোলাফায়ে রাশেদার দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবন খাত্তাব রা:।
হিজরি বছরের প্রথম মাস মহররম। ইসলামে নববর্ষ উদযাপনের কোনো বিধান নেই। চার সম্মানিত মাসের প্রথম মাস মহররম, যাকে আরবের অন্ধকার যুগেও বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার চোখে দেখা হতো। শরিয়তের দৃষ্টিতে মহররম মাসটি অনেক তাৎপর্যপূর্ণবহ। এই মাসে সঙ্ঘটিত ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণও অনেক দীর্ঘ। মহররম মাস শুধু কারবালার ঘটনা স্মরণ করার মাস নয়। এ মাস গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার মাস। ত্যাগের মাস, ভালো কাজ করার মাস। মুসলিম বিশ্বকে নতুন করে গড়ে তোলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার মাস।
যদিও অনেকেই না বুঝে ভ্রান্ত প্ররোচনায় পড়ে আশুরার ঐতিহ্য বলতে রাসূল সা:-এর প্রিয়তম দৌহিত্র, জান্নাতের যুবকদের সরদার হুসাইন রা:-এর শাহাদাত ও নবী পরিবারের কয়েকজন সম্মানিত সদস্যের রক্তে রঞ্জিত কারবালার ইতিহাসকেই বুঝে থাকেন। তাদের অবস্থা ও কার্যাদি অবলোকন করে মনে হয়, কারবালার ইতিহাসকে ঘিরেই আশুরার সব ঐতিহ্য। বাস্তবিকভাবে সঠিক ইতিহাস এর সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং কুরআন ও সুন্নাহ এবং ইসলামের ইতিহাস বলে আশুরার ঐতিহাসিক স্বীকৃতি প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে। হুসাইন রা:-এর মর্মান্তিক শাহাদাতের ঘটনার অনেক আগ থেকেই আশুরা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ও রহস্যঘেরা দিন। কারণ কারবালার যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয় ৬১ হিজরির ১০ মহররম। আর আশুরার রোজার প্রচলন ইসলাম আবির্ভাবেরও বহুকাল আগ থেকে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, আবহমানকাল থেকে আশুরার দিনে সঙ্ঘটিত বিভিন্ন ঘটনা যেমন অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি হিজরি ৬১ সনে আশুরার দিন কারবালার ময়দানের দুঃখজনক ঘটনাও মুসলিম জাতির জন্য অতিশয় হৃদয়বিদারক ও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর আশুরা আমাদের এই দুঃখজনক ঘটনাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
মহররম সম্পর্কে (যা আশহুরে হুরুমের অন্তর্ভুক্ত তথা নিষিদ্ধ মাস) মহান আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস ১২টি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। আর মুশরিকদের সাথে তোমরা যুদ্ধ করো সমবেতভাবে, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আর মনে রেখো, আল্লাহ মুত্তাকিনদের সাথে রয়েছেন।’ (সূরা তওবা : ৩৬)
তাফসিরে ফাতহুল কাদিরে হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধের সূচনা করা যাবে কিনা এ নিয়ে দু’টি মত ব্যক্ত হয়েছে।
১. হারাম মাসে যুদ্ধ করার যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা রহিত হয়ে গেছে। কেননা আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : তোমরা তার মধ্যে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না’ আবার আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার নির্দেশও দিচ্ছেন। আয়াতের পূর্বাপর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে বিষয়টি ব্যাপক। যদি হারাম মাসে যুদ্ধ করা নিষেধ থাকত তাহলে তা শর্তযুক্ত করে দেয়া হতো। তাছাড়া নাবী করিম সা: শাওয়াল মাসে হাওয়াযেন গোত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। (সহিহ বুখারি-৪৩২৫০)
২. হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধ করা হারাম। এ বিধান রহিত হয়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সম্মানিত মাসই সম্মানিত মাসের বদলা। আর সম্মান রক্ষা করারও বদলা রয়েছে। বস্তুত যারা তোমাদের ওপর জবরদস্তি করেছে, তোমরা তাদের ওপর জবরদস্তি করো, যেমন জবরদস্তি তারা করেছে তোমাদের ওপর। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং জেনে রাখো, যারা পরহেজগার, আল্লাহ তাদের সাথে রয়েছেন।’(সূরা বাকারাহ -১৯৪) রাসূল সা: বলেন : ঘুরেফিরে পুনরায় যুগ সেই অবস্থাতে এসে গেছে যে অবস্থাতে যখন আল্লাহ তায়ালা আকাশ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তখন ছিল। এটি হলো ১২ মাসে এক বছর। যার মধ্যে চারটি হলো নিষিদ্ধ মাস, তিনটি ধারাবাহিক জিলকদ, জিলহজ ও মুহাররাম। আর চতুর্থটি হলো রজব যা জুমাদাল আখির ও শাবানের মাঝে। (সহিহ বুখারি: ৪৬৬২)
মহররমের ১০ তারিখে রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে সহিহ হাদিস রয়েছে। জাবের রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: আমাদের আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিতেন এবং এর প্রতি উৎসাহিত করতেন। এ বিষয়ে নিয়মিত তিনি আমাদের খবরাখবর নিতেন। যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো, তখন আশুরার রোজার ব্যাপারে তিনি আমাদের নির্দেশও দিতেন না এবং নিষেধও করতেন না। আর এ বিষয়ে তিনি আমাদের খবরাখবরও নিতেন না। (সহিহ মুসলিম শরিফ : ১১২৮)
এই হাদিসের আলোকে আশুরার রোজার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতীয়মান হয়। এমনকি ওই সময়ে তা ফরজ ছিল। বর্তমানে এই রোজা যদিও নফল, তবে অন্যান্য নফল রোজার তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
ইবন আব্বাস রা: হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা: আশুরা ও রমজানের রোজা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনো রোজা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্বারোপ করতেন না। (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)
ইসলাম ও মুসলমানের জন্য এ মাসের রয়েছে অনেক শিক্ষণীয় ও পালনীয় বিষয়। তাই এ মাসের ৯, ১০ ও ১১ তারিখে রোজা রাখা উত্তম।
ইবন আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, ‘মহানবী সা: যখন আশুরার দিনে রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ প্রদান করেন, তখন সাহাবিরা অবাক হয়ে বলেন, ইয়া রাসূল সা:! ইহুদি-নাসারারা তো এই দিনটিকে বড়দিন মনে করে। আমরা যদি এই দিনে রোজা রাখি, তাহলে তো তাদের সাথে মিল হবে। তাদের প্রশ্নের উত্তরে রাসূল সা: বললেন, ‘তারা যেহেতু এই দিন একটি রোজা পালন করে, আগামী বছর ইনশা আল্লাহ আমরা এই ১০ তারিখের সঙ্গে ৯ তারিখ মিলিয়ে দুই দিন রোজা পালন করব। (সহিহ মুসলিম : ১১৩৪)
আবু হুরায়রা রা: হতে বর্ণিত, নবী করিম সা: বলেন, যে ব্যক্তি আশুরার দিনে আপন পরিবার-পরিজনের মধ্যে পর্যাপ্ত খানাপিনার ব্যবস্থা করবে, আল্লাহ পাক পুরো বছর তার রিজিকে বরকত দান করবেন। (তাবরানি : ৯৩০৩)
উল্লিখিত হাদিস সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল জাওজিসহ অনেক মুহাদ্দিস আপত্তিজনক মন্তব্য করলেও বিভিন্ন সাহাবি থেকে এই হাদিসটি বর্ণিত হওয়ায় আল্লামা জালালুদ্দিন সুয়ুতিসহ অনেক মুহাক্কিক আলেম হাদিসটিকে গ্রহণযোগ্য ও আমলযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন। (জামিউস সগির : ১০১৯)
মহররম মাস মানবতাকে ইসলামের সুমহান আদর্শ ও ত্যাগের দিকেই আহবান করে। আশুরা মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণ ও মুক্তির জন্য নিবেদিত হোক। আমরা বিগত দিনের অন্যায় ও গোনাহ থেকে মুক্তি লাভ করি। যে মহান উদ্দেশ্যকে স্মরণ করতে হিজরি সন শুরু হয়েছিল, আল্লাহ তায়ালা সমগ্র মুসলিম উম্মাহকে মহররম মাসে সে স্মরণ, মর্যাদা ও কল্যাণের প্রতি লক্ষ রাখার, আমলি জিন্দেগি যাপন করার তাওফিক দান করুন। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। আমিন।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইসলামী গবেষক