চীন-ইরান চুক্তি পাকিস্তানের জন্য বিপদ আনবে?

মোহাম্মদ তৈয়ব সফদার ও যশুয়া জাবিন | Aug 17, 2020 04:50 pm
চীন-ইরান চুক্তি পাকিস্তানের জন্য বিপদ আনবে?

চীন-ইরান চুক্তি পাকিস্তানের জন্য বিপদ আনবে? - ছবি : সংগৃহীত

 

চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ মাত্রা ও ব্যাপ্তি উভয় দিক দিয়েই সম্প্রসারিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও ইরানের মধ্যে সই হওয়া ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তির বিস্তারিত বিবরণ সামনে এসেছে, এবং তা ইরানের নেটিজেনদের মধ্যে ক্রুদ্ধ বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। পরিকল্পনাটিতে আগামী ২৫ বছরের জন্য টেলিকমিউনিকেশন (৫জি), অবকাঠামো, ব্যাংকিং, মুক্ত বাণিজ্য জোন এবং সেইসাথে বিতর্কিতভাবে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় ও অস্ত্র পরিকল্পনসহ সামরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে। ইরান থেকে ব্যাপক আলোচনা হলেও এ ব্যাপারে চীনা পক্ষ সন্দেহজনক মাত্রায় নীরবতা পালন করছে। সম্ভবত তেহরান থেকে ফাঁস হওয়া নতিপত্রের বৈধতা দেয়ার আগে বেইজিংয়ের থেকে আনুষ্ঠানিক নিশ্চয়তার জন্য অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

বেইজিং ও তেহরানের মধ্যকার এই মিত্রতা দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এক পথ, অনেক দরজা
চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) হলো সিল্ক রোড অর্থনৈতিক বেল্টের (এসআরইসি) অনেক করিডোরের একটি। সিপিইসি হলো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী ও সবচেয়ে উন্নত অংশ। চীনা নীতিনির্ধারকেরা একে বিআরআইয়ের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেছে।

২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর পর থেকে সিপিইসি পাকিস্তানের দীর্ঘ দিন অবকাঠামো চাহিদা ও বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের প্রয়াস চালাচ্ছে। গত ৫ বছরে চীন দেশটিতে অনেক রাস্তা নির্মাণে বিনিয়োগ করেছে, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগ করছে। দীর্ঘ মেয়াদে রাস্তা, পাইপলাইন, রেললাইন পাকিস্তানের বেলুচিস্তানকে চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলের কাশগড়কে সংযুক্ত করবে। এতে করে বাণিজ্যের নতুন নতুন অ্যাভেনিউ খুলবে।পরিবহন অবকাঠামো নির্মাণ একটি ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ। কারণ রুটটি বিশ্বের সবচেয়ে বৈরী অঞ্চল দিয়ে এগিয়েছে।

চীন ও পাকিস্তান উভয়েই সিপিইসিকে উইন-উইন বিনিয়োগ প্যাকেজ হিসেবে মনে করছে। ভূরাজনীতিও আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। চীনের জ্বালানি চাহিদা দ্রুত বাড়ছে, চীনা নীতিনির্ধারকেরা আশঙ্কা করছে, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী মধ্যপ্রাচ্য থেকে তার তেল সরবরাহ বিঘ্নিত করতে পারে।বিশেষ করে যুদ্ধের সময় এ ধরনের বিঘ্নতার ক্ষেত্রে চীনের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে। এ দিকটি বিবেচনা করে বলা যায়, চীনের মালাক্কা দোটানা নিরসন করতে পারে সিপিইসির গোয়াদর-কাশগর পাইপলাইন প্রকল্প। এই নির্ভরযোগ্য স্থল রুটটি চীনের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণে কার্যকর হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সাম্প্রতিক উত্তেজনা আরো বিকল্প রুটটি নির্মাণের গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

সিপিইসির স্বাভাবিক বিকাশ মনে হয়েছিল সীমিত হয়ে পড়ছে ইরানের চাবাহার প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগের উদ্যোগে। গোয়াদর থেকে মাত্র ১৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চাবাহার বন্দরটি ভারতের কাছে চীনের দক্ষিণ এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত ‘মুক্তার মালায়’ বাধা দেয়া ও সিপিইসির বিকাশের পথ রুদ্ধ করার প্রকল্প। অবশ্য চীন-ইরান প্রস্তাবিত চুক্তি এবং চাবাহার রেলওয়ে প্রকর্প থেকে ভারতের অনানুষ্ঠানিক বিদায়ের ফলে দিল্লির কৌশলগত অবস্থানের সমাপ্তি। চাবাহার না থাকলে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ভারতের মূল চালিকাশক্তিই হারিয়ে ফেলবে। লাদাখ থেকে ইরান পর্যন্ত ভারত তার কৌশলগত স্বার্থগুলো অবরোধের মুখে দেখছে। এসব ঘটনা সন্দেহাতীতভাবে পাকিস্তানের জন্য সুবিধা এনে দেবে।

অবশ্য, সিপিইসি নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করার জন্য ইসলামাবাদকে আরো অপেক্ষা করতে হবে। ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ইরান-চীন অংশীদারিত্ব থেকে পাকিস্তানের সুবিধা লাভকে সীমিত করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ইরানের সুন্নি শত্রুরা ইরানকে অর্থনৈতিক লাইফলাইন দিতে চীনকে সুযোগ দিতে চাইবে না। মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া-সুন্নি বিরোধ চনি ও পাকিস্তানকে বেশ সমস্যায় ফেলবে। এ কারণেই সিপিইসিতে ইরানের অন্তর্ভুক্তিই পাকিস্তানকে মধ্যপ্রাচ্য, তুরস্ক ও ইউরোপ এবং চীনকে সংযুক্তকারী বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত করবে না। ইরান কি ওই লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হবে না বাধা হয়ে ওঠবে, তা বলার সময় এখনো আসেনি।

অসম সম্পর্ক : সিপিইসি ও পরিবর্তনশীল গতিশীলতা
চীনের সাথে ইরানের সম্পর্কের মতো চীন-পাকিস্তান সম্পর্কও অসম। অবশ্য চীন-ইরান সম্পর্ক এই অবস্থা থেকে রক্ষা করতে পারে। তবে ইরান থেকে বেলুচিস্তান হয়ে জিনজিয়াংয়ে জ্বালানি সরবরাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হতে পারে। তবে প্রকল্পগুলো কতটা কার্যকর হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
চীন-ইরান চুক্তি ইরানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কও মেরামত করতে কাজে লাগত পারে। বিদ্রোহী হামলার রেশ ধরে অবশ্য দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে। আবার চীনা কোম্পানিগুলোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার সরাসরি প্রভাব পড়তে পারে সিপিইসি প্রকল্পগুলোতে। সিন্ধুর থর কয়লা প্রকল্পটি পাকিস্তানকে বিদ্যুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ করবে বলে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। আর ওই প্রকল্পটির প্রযুক্তিগত সহায়তায় রয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান জেনারেল ইলেকট্রিক। এই কোম্পানির চীনা অংশীদারের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে প্রকল্পটি অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। আবার ইরান যখন গত সপ্তাহে সিপিইসিতে যোগ দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে, তখনই এ ব্যাপারে সৌদি আগ্রহের সমাপ্তি ঘটেছে বলে ধারণা করা যায়।

চীন-ইরান চুক্তিটি সব পক্ষের জন্যই স্বাভাবিক অংশীদারিত্ব। চীন পাবে সস্তা ইরানি তেল। আর ইরান পাবে আর্থিক লাইফলাইন। পাকিস্তান হতে পারে চীনের মধ্যপ্রাচী বাণিজ্য ও জ্বালানি সরবরাহের ট্রানজিট হাব। আর ভারত সব পক্ষের চাপে থাকবে। ভারতের আঞ্চলিক কৌশলগত উচ্চাভিলাষ আবারো ভণ্ডুল হয়ে গেল। সিপিইসি আন্তর্জাতিক বিষয়ে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো চীন ও ইরানকে সংযুক্ত করার ফলে যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, পাকিস্তান ওই পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে কিনা।পাকিস্তান যদি তার কৌশলগত অবস্থানটি ব্যবহার করে চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশগুলোর জন্য পেছনের দরজায় পরিণত হতে পারে, তবে জবাব অবশ্যই হবে হ্যাঁ।

দি ডিপ্লোম্যাট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us