কমলা কেন ভারতীয়, সোনিয়া কেন ইতালিয়ান?
কমলা কেন ভারতীয়, সোনিয়া কেন ইতালিয়ান? - ছবি : সংগৃহীত
একেবারে ভিন্ন ভিন্ন কারণে ভারতীয় ও মার্কিন রক্ষণশীলেরা সিনেটর কমলা হ্যারিসের ভারতীয় উত্তরাধিকারের ওপর গুরুত্বারোপ করতে চায়। বিষয়টি পুরোপুরি বিস্ময়কর নয়। ভারতীয়রা সবসময়ই তাদের সফল প্রবাসী সদস্যদের দ্রুততার সাথে নিজেদের বলে গ্রহণ করে নেয়। আর ডানপন্থী ভাষ্যকারেরা এবং এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ ছড়াতে চাইছেন এই বলে যে তার মা ভারতীয় ও বাবা জ্যামাইকার উত্তরাধিকারী। কিন্তু বাস্তবে হ্যারিস পুরোপুরি আমেরিকান।
ভারতীয় সমাজ এখনো মোটামুটিভাবে বিশ্বাস করে যে ব্যক্তির পছন্দ ও কার্যক্রমের চেয়ে তার জন্ম ও পরিবারের মাধ্যমেই বেশি করে তার পরিচিতি নির্ধারণ করে দেয়। বিশেষ করে বলা যায় ভারতের বিপুলসংখ্যক রক্ষণশীল অংশের জন্মের মাধ্যমে নির্ধারিত বর্ণ ও ধর্ম যখন বদলানো যায় না, তখন বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেউ প্রায়োগিকভাবে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে পারে না। আর বিয়ের মাধ্যমে বজায় রাখা বর্ণব্যবস্থার ফলে সামাজিক পরিবর্তন বেগবান না করাটা নিশ্চিত করে। ভারতে জন্ম লটারিই সবকিছু।
ফলে হ্যারিস ও অন্যান্য মার্কিন রাজনৈতিক নেতারা, যেমন ববি জিন্দাল ও নিক্কি হ্যালে, সবসময়ই ‘ভারতীয়’ হিসেবে দাবি করেন, যদিও তারা আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী এবং তাদের কার্যক্রম প্রায় পুরোপুরি আমেরিকার জন্য নিবেদিত। অন্যদিকে সোনিয়া গান্ধীর, তিনি ৫ দশকেরও বেশি সময় ভারতে কাটিয়েছেন এবং জাতয়ি ন্যাশনাল কংগ্রেসের মতো দলের হয়ে দুটি জাতীয় নির্বাচনে সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, মতো অনেককে প্রায়ই বলা হয় ‘ইতালিয়ান-বংশোদ্ভূত’ বা ‘বিদেশী।‘ সোনিয়া যদি ভারতের ‘ফার্স্ট ফ্যামিলি’কে বিয়ে না করতেন, তবে তার রাজনৈতিক উত্থান হতো অসম্ভব।
তার মানে এ কথা বলা হচ্ছে না যে হ্যারিসের ভারতীয় শিকড় তাকে মৌলিকভাবে গড়ে দেয়নি। তার মা শ্যামলা গোপালান ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং একটি তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি বেড়ে ওঠেন। আর তা তার জন্য শ্বেতাঙ্গ সুবিধার ভারতীয় সমমানের সুবিধা দিয়েছে। তার ব্রাহ্মণ সুবিধার কারণে শ্যামলার (ও আমার) মতো পরিবারগুলোর কয়েক প্রজন্ম ধরে এমন এক দেশে কলেজ গ্রাজুয়েট সৃষ্টি করেছে, যে দেশ এখনো ১০০ ভাগ মৌলিক সাক্ষরতায় পৌঁছেনি।
স্বাভাবিকভাবেই ‘মা-ভ্রাম’ পরিবারের সদস্য হিসেবে শ্যামলা ও তার সন্তানেরা উন্নত গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভের জন্য উৎসাহ পেয়েছেন। শ্যামলার ক্ষেত্রে এই সুযোগটি ছিল বার্কলেতে পড়াশোনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ব্যবস্থা, ভারতীয়-আমেরিকান এলিটদের (যাদেরকে বিশেষজ্ঞরা ‘আদার ওয়ান পারসেন্ট হিসেবে অভিহিত করেন) সাথে যোগদানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়া। এই শিক্ষার ভিত্তিই পরে আমেরিকান এলিটদের মধ্যে হ্যারিসের নিজস্ব পরিচিতি সৃষ্টিতে বেশ সহায়ক হয়।
এ দেশে কেউ এসে কঠোর পরিশ্রম করলে তার ভাগ্য বদলে ফেলতে পারে বলে যে কথাটি বলা হয়, তা এখনো আমেরিকায় প্রযোজ্য। আর সামাজিক গতিশীলতা নির্দিষ্ট কিছু জনসংখ্যার মধ্যে সীমিত। জন্মের দুর্ঘটনাটি বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে কম গুরুত্ব বহন করে। আমেরিকান স্বপ্ন এখনো লালিত ব্যক্তিগত ও নীতিগত লক্ষ্য হিসেবে বিরাজ করছে।
কমলা হ্যারিসকে সত্যিকার অর্থে আলাদা করেছে তার বর্ণ বা জাতিগত অবস্থান নয়, বরং তার মায়ের সিদ্ধান্ত। ১৯ বছর বয়সে শ্যামলা যখন তুলনামূলক তরুণ ছিলেন, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনগুলোতে খুবই সক্রিয় ছিলেন। এখানেই তিনি আরেক অভিবাসী ডোনাল্ড জে হ্যারিসের সাথে তার পরিচয় ঘটে ও তাকে তিনি বিয়ে করেন। ডোনাল্ড এখন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিরি প্রফেসর এমেরিটাস।
শ্যামলা গোপালন তার বর্ণ ও গোত্রের বাইরে বিয়ে করেছিলেন। এটি ১৯৬০-এর দশকে চরমভাবে অস্বাভাবিক বিষয় ছিল।আরো লক্ষণীয় বিষয় হলো, তিনি কয়েক বছরের মধ্যে তালাকও নেন। আমার মনে হয় না, এটি সহজ পছন্দ ছিল।চেন্নাইয়ের উপকণ্ঠে থাকা বেসান্ত নগরের ব্রাহ্মণেরা এখন গোপালনদের সাথে সম্পর্ক থাকার দাবি করে থাকেন। খুব সম্ভবত স্বামী পছন্দ করার ক্ষেত্রে শ্যামলার সিদ্ধান্তে এদের পূর্বপুরুষেরা লজ্জা পেয়েছিলেন। এই সাম্প্রতিক সময়েও আরেক তামিল ব্রাহ্মণ, প্রখ্যাত ক্লাসিক্যাল ভোকালিস্ট সুধা রাঘুনাথন, তার মেয়ের আফ্রিকান-আমেরিকান লোককে বিয়ে করায় ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন।
হ্যারিস তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, তার মা জানতেন যে তিনি যে দেশে এসেছেন সেখানে তাকে ও তার বোন মায়াকে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ে হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। তবে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন এটা নিশ্চিত করতে যে, তার মেয়েরা যেন কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে আত্মবিশ্বাসী হয়। দুই বালিকা একটি ব্ল্যাক চার্চের কোয়ারে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিল, স্থানীয় চাইল্ডকেয়ার সেন্টারে কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের সাথে পরিচিত হয়েছিল। কমলা নিজে আইভি লিগ স্কুলে না গিয়ে ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এটা তাকে কম বা বেশি ‘ভারতীয়’ করেছিল কিনা তা অপ্রাসঙ্গিক। পরিচিতি একটি জটিল বিষয়। এমনকি অভিবাসন, মিশ্র মা-বাবা, ভিন্ন সমাজে বিয়ে করার বিষয়গুলো না থাকলেও।কমলা অনেক দিক থেকে একই রকম, আবার অনেক দিক থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি অন্যান্য ব্রাহ্মণ অভিবাসীর মতো সুশিক্ষিত, পেশাগতভাবে দুর্লভ অবস্থান সৃষ্টি করেছেন, আর্থিকভাবে খুবই সফল। কিন্তু ‘গোপালন’ হিসেবে তার কাছ থেকে যে প্রত্যাশা করা হয়েছিল তার বিপরীতে হ্যারিস শূকরের চপ উপভোগ করেন। তাছাড়া তিনি তার জ্যামাইকান পিতার অসন্তোষ নিয়ে গর্ব করেন। হ্যারিস পট-স্মোকিং জ্যামাইকানদের নিয়ে কৌতুক করেন।
সন্দেহ নেই যে হ্যারিস বুঝতে পারবেন যে তিনি কখনো অনেক আফ্রিকান-আমেরিকানের মতো কৃষ্ণাঙ্গ নন, বা অনেক ভারতীয় ও ভারতীয় আমেরিকানের মতো পর্যাপ্ত ভারতীয়ও নন। কিন্তু দুই সফল অভিবাসীর কন্যা হিসেবে তিনি এখন এই মাটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেনেছেন। তিনি এর চেয়ে বেশি আমেরিকান হতে পারবেন না।
সূত্র : ব্লুমবার্গ