ইসরাইল-আমিরাত চুক্তি কেন ফিলিস্তিনিদের জন্য বিপর্যয়কর?
ইসরাইল-আমিরাত চুক্তি কেন ফিলিস্তিনিদের জন্য বিপর্যয়কর? - ছবি : সংগৃহীত
‘একটি ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প কেবলই আঘাত হেনেছে মধ্যপ্রাচ্যে।’ নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান এভাবেই বর্ণনা করেছেন ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণাকে। কেন তিনি এটিকে ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প বলছেন, নিজের লেখায় সেটি ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। টমাস এল ফ্রিডম্যান বলেন, ‘আনোয়ার সাদাতের জেরুসালেমে যাওয়ার মতো কোনো ঘটনা এটি নয়Ñ কারণ আরব ও ইসরাইলিদের মধ্যে প্রথম সম্পর্ক খুলে যাওয়ার সেই বড় ঘটনার সমকক্ষ আর কিছুই হতে পারে না।
হোয়াইট হাউজের লনে আইজ্যাক রবিনের সাথে ইয়াসির আরাফাতের করমর্দনের সাথেও এর তুলনা চলে না। কারণ ইসরাইলি আর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রথম প্রকাশ্য সমঝোতার সমান আর কিছুই হতে পারে না।’ টমাস এল ফ্রিডম্যানের মতে, ইসরাইল আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই ঘটনা ওপরের দু’টি ঘটনার খুবই কাছাকাছি। এ ধরনের ঘটনার স্কোর কার্ডে এটির অবস্থান তিন নম্বরে। ইসরাইলের সাথে এর আগে কেবল মাত্র দুটি আরব রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক হয়েছে। প্রথমটি মিসরের সাথে ১৯৭৯ সালে। এই চুক্তি করার পরিণামে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছে। দ্বিতীয়টি জর্ডানের সাথে ১৯৯৪ সালে।
আকস্মিক ঘোষণা :
গত বৃহস্পতিবার যেভাবে ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ঘোষণাটি এসেছিল, তা সবাইকে হতচকিত করেছে। এতে মধ্যস্থতা করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনিই প্রথম এক বিবৃতিতে এই ঘটনা জানান। পুরো আলোচনাটি চলছিল বেশ গোপনে। এতটাই গোপনে যে, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত নাকি এ বিষয়ে কিছু জানতেন না। ট্রাম্প ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যে এই চুক্তিকে এক ‘ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বলে বর্ণনা করেছেন।
ওভাল অফিসে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বিষয়টি নিয়ে উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন ইসরাইল ঘেঁষা পরিচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘বরফ যেহেতু গলেছে এখন আমি আশা করবো আরো অনেক আরব এবং মুসলিম দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতকে অনুসরণ করবে।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই ঘোষণা দেয়ার পরপরই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু হিব্রুতে টুইট করেন, ‘এক ঐতিহাসিক দিন।’
যেসব বিষয়ে সমঝোতা : সামনের দিনগুলোতে ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিনিধি দল নিয়মিত মিলিত হবে নানা বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করতে। এর মধ্যে বিনিয়োগ, পর্যটন, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি ফ্লাইট, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ, দুই দেশে পরস্পরের দূতাবাস স্থাপন থেকে কিছুই বাদ থাকছে না। দু’টি বন্ধুপ্রতিম দেশের মধ্যে যত রকমের সম্পর্ক থাকার কথা, তেমন এক সম্পর্কের দিকেই যাচ্ছে দুই দেশ। এক যুক্ত বিবৃতিতে ইসরাইল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত জানিয়েছে, ‘মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গতিশীল দু’টি সমাজ এবং অগ্রসর দু’টি অর্থনীতির মধ্যে এই সরাসরি সম্পর্কের সূচনা পুরো অঞ্চলকে বদলে দেবে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ত্বরান্বিত হবে এবং মানুষে-মানুষে সম্পর্ক তৈরি হবে।’
একটি আরব রাষ্ট্রের সাথে এই সম্পর্কের বিনিময়ে ইসরাইল নতুন করে পশ্চিমতীরের যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা দখলের পরিকল্পনা করছিল, তা আপাতত(!) স্থগিত রাখবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আনওয়ার গারগাশ বলেছেন, ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে তার দেশ সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে ইসরাইল এগোচ্ছিল, সেই ‘টাইম বোমা’ থামিয়ে দেয়া গেছে। তবে ইসরাইল বলছে, ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর দখলের পরিকল্পনা বাদ দেয়া হয়নি। এটি স্থগিত রাখা হয়েছে মাত্র।
‘আমাদের পিঠে ছুরিকাঘাত’ :
ফিলিস্তিনিরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই পদক্ষেপকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এর নিন্দা করে বলেছেন, ‘এটি জেরুসালেম, আল-আকসা এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা।’ একজন ঊর্ধ্বতন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা হানান আশরাউই এই সমঝোতার নিন্দা করে বলেছেন, ইসরাইলের সাথে আমিরাত তলে তলে যেসব গোপন লেনদেন আর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছিল, সেটা এবার প্রকাশ হয়ে গেল। তিনি আবুধাবির প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘নিজের বন্ধুর দ্বারা কেউ যেন এভাবে বিক্রি হয়ে না যান।’
সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ফিলিস্তিনি দূতকে এরই মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বলেছে, এটি ফিলিস্তিনি জনগণের পিঠে ছুরিকাঘাত। খুব কঠোর ভাষায় এই সমঝোতার নিন্দা জানিয়েছে ইরান। ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে ‘বিপজ্জনক’ এবং ‘বোকামি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তেহরান।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে বরাবরই সোচ্চার তুরস্ক। দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ সহ্য করা যায় না। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করারও হুঁশিয়ারি দিয়েছে তুরস্ক। এ দিকে ইসরাইলের মিত্র মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ আল-সিসি এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। ইসরাইলের আরেক মিত্র জর্দানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি বলেছেন, এই চুক্তির পর থমকে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা নতুন করে শুরু হতে পারে।
সৌদি-আমিরাতের আরেক মিত্র বাহরাইন এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। এই চুক্তিতে ভূমিকা রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেও ধন্যবাদ জানিয়েছে দেশটি। সৌদি-আমিরাত বলয়ের আরেক দেশ ওমানও এই চুক্তির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সৌদি-আমিরাত বলয়ের প্রায় সবক’টি দেশই এ চুক্তিকে স্বাগত জানালেও রিয়াদের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির বিজয়?
বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, উভয়েই অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই সমঝোতা থেকে কিছু ফায়দা তুলতে পারেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটিকে তার পররাষ্ট্রনীতির এক বিশাল বিজয় হিসেবে দেখাতে চাইবেন। নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তার ভাবমূর্তিকে চাঙ্গা করতে এ রকম কিছু একটা দরকার। আর প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে যে বিপদের মধ্যে আছেন, সেখান থেকে মানুষের মনোযোগ অন্য দিকে সরানোর জন্য এটিকে কাজে লাগাতে পারবেন।
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের বিরাট অংশ ইসরাইলের দখলে নেয়ার পরিকল্পনাও নেতানিয়াহুর মাথা থেকেই এসেছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে যে রকম চাপের মুখে পড়তে হচ্ছিল ইসরাইলকে, তাতে কাজটা নেতানিয়াহুর জন্য কঠিন হয়ে পড়েছিল। এখন খোদ আমিরাতের মতো একটি মুসলিম দেশই ইসরাইলের পায়ে পায়ে হাঁটছে। এই আমিরাত আবার সৌদি আরবের মিত্র হিসেবে পরিচিত। কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে সৌদির সাথে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
সূত্র : বিবিসি ও আলজাজিরা