এক চৌবাচ্চায় ৪৯ পদ্মগোখরো ও গোখরো!
গোখরো - ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশে সাপ লালন পালন বা খামার করা অবৈধ ও আইনত দণ্ডনীয় হলেও বিভিন্ন জেলায় ছোট বড় আকারে সাপের খামার গড়ে উঠেছে বলে অভিযোগ করেছেন বন্যপ্রাণী গবেষকরা।
বন্যপ্রাণী গবেষকরা জানান, বাংলাদেশের নাটোর, রাজশাহী, গাজীপুর, পটুয়াখালী ও বরিশালে একাধিক সাপের খামার গড়ে তোলা হলেও এগুলো তুলে নেয়ার ব্যাপারে প্রশাসনকে কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৯টি বিষধর সাপ, ৩৬টি ডিম এবং সাপ লালন পালনের কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করে ভ্রাম্যমান আদালত।
অবৈধভাবে সাপের খামার গড়ে তোলার অপরাধে খামার মালিক শাহাদাত হোসেনকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা সেইসঙ্গে খামারটি সরিয়ে নিতে সাত দিনের সময় বেঁধে দেয়া হয়।
বুধবার বিকেলে উপজেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে বৈদ্যবেলঘরিয়া চৌধুরী পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, একটি আখের ঘের ও ঝোপঝাড়ের মাঝখানে নিচু ভূমিতে টিনশেড দেয়া আধপাকা বাড়িতে সাপের খামার গড়ে তোলা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন ভেতরে দেখতে পান একটি শুকনো চৌবাচ্চার মতো স্থানে ছোট বড় অসংখ্য বিষধর সাপ ছেড়ে রাখা হয়েছে।
পরে ভ্রাম্যমান আদালতের সঙ্গে থাকা সাপ বিশেষজ্ঞ, পরীক্ষা করে দেখেন যে সেখানে পদ্মগোখরো ও গোখরো, এই দুই প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে।
কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ, পূর্ব অভিজ্ঞতা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া এতোগুলো সাপ পালনের ঘটনায় পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
গত ছয় মাস ধরে অবৈধভাবে ওই খামার পরিচালনা করা হচ্ছিল বলে জানা গেছে।
সম্প্রতি স্থানীয় কয়েকজন এলাকাবাসী এবং পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিষয়টি জানতে পেরে রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেন।
সেখান থেকে গোপনে একজনকে পরিদর্শনে পাঠানো হয়। তিনি সাপের খামার থাকার খবরটি নিশ্চিত করলে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে যৌথভাবে অভিযানে নামে রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ।
সেখানে বিভাগীয় পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবিরসহ ছিলেন, বন কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম, সাপ বিশেষজ্ঞ রোমন, নাটোর জেলা বন কর্মকর্তা সত্যনাথ সরকার, ওয়ার্ল্ড লাইফ জুনিয়র স্কাউট মিমনুর রহমান, বাংলাদেশ জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ফজলে রাব্বি।
অভিযান প্রসঙ্গে পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, " আমরা দেখলাম আখের ঘেরের মাঝখানে টিনশেডের একটা ঘর। সেটার ভেতরে ইট দিয়ে বাধানো চৌবাচ্চায় সাপ রাখা হয়েছে। কোথাও নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থা নেই। বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। তার মধ্যে দুই প্রজাতির সাপই অনেক বিষধর। পরে সাপ, ডিম, সাপ ধরার সব সরঞ্জাম জব্দ করা হয়, সাপের খামারিকে কৌশলে ডেকে তাকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।"
খামার মালিক শাহাদাত হোসেন এই খামার গড়ে তোলার বিষয়ে ভ্রাম্যমান আদালতকে জানিয়েছেন যে, সাপের বিষ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ বেশ লাভজনক হওয়ায় তিনি গত কয়েক মাস আগে ৪/৫টি সাপ নিয়ে একটি ছোট খামার গড়ে তোলেন।
পরে প্রাকৃতিক নিয়মে সাপগুলো বংশবিস্তার করে এবং তিনিও বিভিন্ন স্থান থেকে সাপ সংগ্রহ করে খামারের পরিধি বাড়াতে থাকেন।
অথচ পুরো খামারটি অস্বাস্থ্যকর ও অবৈজ্ঞানিক উপায়ে পড়ে তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন।
এ ধরণের বিষধর সাপ লালন-পালন করা কিংবা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়া বিষয়ে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ, পূর্ব অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান ওই খামার মালিকের ছিল না বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এ ব্যাপারে পরিদর্শক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, "এই সাপগুলো কিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কোন তাপমাত্রায় রাখতে হয়, কিভাবে বিষ সংগ্রহ করতে হয়, সাপে কাটলে তৎক্ষণাৎ কী ব্যবস্থা নিতে হয়, সে বিষয়ে কোনো জ্ঞান বা পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এমনকি নিরাপত্তামূলক প্রয়োজনীয় কোন সরঞ্জাম পর্যন্ত নেই।"
বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং ইউটিউবে সাপের লালন পালন আর বিষ সংগ্রহের ভিডিও দেখে এমন খামার গড়ে তোলা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
পরে রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ ওই ৪৯টি সাপ উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়ার কথা জানায়।
তবে ডিমগুলো এখনো তাদের জিম্মায় আছে। সেগুলো প্রকৃতিতে রেখে আসবেন নাকি ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়ার পর ছেড়ে আসবেন সে নিয়ে এখনও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
সাধারণত সাপের ডিম পাড়া থেকে বাচ্চা বেরিয়ে আসতে ৬০ দিনের মতো সময় লাগে।
এদিকে বিষধর সাপের খামারটি এলাকাবাসীর জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতো বলে উদ্বেগ জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী বলতে বোঝানো হয় যেসব প্রাণী প্রকৃতি থেকে খাবার সংগ্রহ করে শিকার করে খায়। যাদের অন্যের উচ্ছিষ্ট বা তৈরি করা খাবারের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
এক্ষেত্রে বাংলাদেশের আইনানুযায়ী শুধুমাত্র তিন ধরণের বন্যপ্রাণী লাইসেন্সসহ লালন পালনের বা খামার করার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
সেগুলো হলো চিত্রা হরিণ, হাতি এবং লোনা পানির কুমির।
যথাযথ নীতিমালার আওতায় সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে এই প্রাণীগুলো লালন পালন করা যায়। এবং প্রতিবছর এই লাইসেন্স নবায়ন করতে হয়।
এর বাইরে সব ধরণের প্রাণী ধরা, শিকার করা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, লালন পালন অবৈধ ও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ বলে জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ আদনান আজাদ।
সেক্ষেত্রে বছরের পর বছর যারা সাপ লালন পালন করে আসছিলেন তার সবই হয়েছে অবৈধ ও বেআইনিভাবে। সাপ লালন পালনের বিষয়ে বৈধতা দিতে মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানানো হলেও এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত আসেনি বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ অনুযায়ী, সাপ সংগ্রহ ও মেরে ফেলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
এই আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী, বন্যপ্রাণী সংগ্রহ বা শিকার করা হলে সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাইলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান আছে।
তবে নাটোরের সেই সাপের খামারিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
এর কারণ হিসেবে জাহাঙ্গীর বলেন, অপরাধী মৌখিকভাবে এমনটি আর করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সেটা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অপরাধের মাত্রা ও অপরাধীর বাস্তব অবস্থা এবং করোনাভাইরাস কালীন দুর্যোগ সাপেক্ষে জরিমানা কমিয়ে রাখেন।
বাংলাদেশে সাপের খামার প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা অনেক কম খরচ হওয়ায় এবং ভুল খবরের লোভে পড়ে মানুষ এতে আকৃষ্ট হচ্ছে বলে মনে করেন বন্য প্রাণী গবেষক আদনান আজাদ।
তিনি বলেন, "মানুষ বিভিন্ন খবরে দেখতে পান যে ১০ কোটি টাকার/২০ কোটি টাকার সাপের বিষ আটক। এরকম ভুল তথ্য দেখে মানুষের মধ্যে ধারণা হয় যে সাপের বিষের ব্যবসা খুব লাভজনক। কিন্তু এই ব্যবসা করতে গেলে যে জ্ঞান থাকা লাগে, সেটা কারও নেই।"
"তাদের মাথায় একটা বিষয়ই থাকে যে সাপকে মাসে একবার দুবার ইঁদুর/ ব্যাঙ খাওয়ালেই চলে। শীতকালে সেটাও খাওয়াতে হয় না। এতো কম খরচে লাভজনক ব্যবসা হওয়ার আশায় তারা ঝুঁকে পড়ছে। অথচ এর পরিণতি কতো ভয়াবহ হতে পারে। সেই ধারণাও তাদের নেই।"
বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৮০টি প্রজাতির সাপ রয়েছে।
সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংস্থা বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির প্রধান অধ্যাপক এমএ ফায়েজ বলেছেন, দেশে যেসব সাপ রয়েছে, তার মধ্যে সাত থেকে আট প্রজাতির অত্যন্ত বিষধর। এদের কামড়ে বেশি মানুষ মারা যায়।
সাপে কাটার ঘটনা গ্রামাঞ্চলে এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট এলাকায় বেশি ঘটে থাকে। স্থলভূমিতে থাকা সাপ পায়ে বেশি দংশন করে।
সূত্র : বিবিসি