ইসলাম, বিজ্ঞান ও ভবিষ্যদ্বাণী

ইসলাম, বিজ্ঞান ও ভবিষ্যদ্বাণী - ছবি : সংগৃহীত
বিজ্ঞানীরা যুগে যুগে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সেসবই ছিল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানভিত্তিক যা ফলপ্রসূ হয়ে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে প্রমাণ করেছে মহাবিশ্ব সুপরিকল্পিত বা সুনিয়ন্ত্রিত হলেই কেবল এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবে ঘটতে পারে। মহাবিশ্ব তাহলে নিঃসন্দেহে সুনিয়ন্ত্রিত এবং সুপরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে। অবশ্যই অপরিকল্পিত সৃষ্টিতে কখনো ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।
আজকের প্রচলিত বিজ্ঞান মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে কী বলে? একটা কালের অস্তিত্ব ছিল যার নাম দেয়া হয়েছে বৃহৎ বিস্ফোরণ (বিগ ব্যাং)। তখন ছিল অসীম ক্ষুদ্র মহাবিশ্ব এবং এর ঘনত্ব ছিল অসীম।
এ পরিস্থিতিতে বিজ্ঞানের সব জানা বিধিই ভেঙে পড়ে। সুতরাং ভেঙে পড়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতাও।
কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণই বিপরীত। মহাবিশ্বের বৃহৎ বিস্ফোরণ আর দূরাপসারণ গতির সব ব্যাপারই শুধু সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হলেই যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীদের সব ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হতে পারে। এটি আমরা ধারাবাহিকভাবে দেখতে পাই। অন্য দিকে তাপ গতিবিদ্যার প্রথম সূত্র বলছে : ‘এরূপ যন্ত্র তৈরি করা একেবারেই অসম্ভব, যেটি শূন্য থেকে শক্তি বানাতে পারবে এবং অবিরাম চলবে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতেই থাকবে।’ মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিকাশ পরিকল্পিত বিধায় এর যেকোনো বিষয়ে/পরিস্থিতিতে এটা একেবারেই অসম্ভব যে, কোনো কিছু শূন্য থেকে শক্তি উৎপন্ন করতে পারবে এবং সুনিয়ন্ত্রিত ও সুপরিকল্পিতভাবে অবিরাম চলবে বা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতেই থাকবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঘুরে ফিরে যে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে : বাস্তবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিকাশ পরিকল্পিত বিধায় কেবল এর যেকোনো ব্যাপারেই কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হতে পারে।
বিশিষ্ট প্রাণ-পদার্থবিজ্ঞানী পাল কায়েন্স ইবারসোল্ডের মতে : ‘এই মহাবিশ্বের জন্ম সম্পর্কে বিজ্ঞান আপাত দৃষ্টিতে খুব মহাপ্লাবনিক একটি তত্ত্ব দাঁড় করাতে পারে। তারই ফলে ছায়াপথ ও নক্ষত্রের সৃষ্টি হয়েছে বলে উল্লেখ করতে পারে। কিন্তু কোথা থেকে এই সৃষ্টির জন্য জড়পদার্থ ও শক্তি এসেছে এবং কেনই বা এই মহাবিশ্বটি এমনিভাবে গঠিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ, সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা বিজ্ঞানে জুটবে না।’
প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আমাদের কাছে স্পষ্ট। ভরশক্তির অবিনাশিতাবাদ তত্ত্ব বলছে, নতুন করে যেকোনো কিছু সৃষ্টি করা যেমন কখনো বিজ্ঞানে সম্ভব নয়। তেমনি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে, এমনকি তুচ্ছ কোনো কিছুর বিনাশও একেবারেই অসম্ভব। শুধু আছে বস্তু-শক্তির রূপান্তর, নতুন করে নেই কোনো সৃষ্টি, ধ্বংস বা বিনাশ। মহাবিশ্বের বর্তমান অস্তিত্ব প্রমাণ করে, এটি সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত বিধায় বাস্তবে বিজ্ঞান ও যুক্তি নির্ভরশীল ভবিষ্যদ্বাণী কার্যত ফলপ্রসূ হতে দেখা যায়।
(@) বৈজ্ঞানিক মেন্ডেলিফ ১৮৬৯ সালে বিজ্ঞানের সূক্ষ্মতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে পিরিয়ডিক টেবিলে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের অস্তিত্ব, ধর্ম, আণবিক ওজনসহ প্রভৃতির বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যেগুলোর অস্তিত্বের কোনো রকম ধারণাই ওই সময় পর্যন্ত কারো বিন্দুমাত্র ছিল না। বর্তমান সময় পর্যন্ত সেসব মৌলিক পদার্থ ঠিকই আবিষ্কৃত হয়েছে আর সবাই হতবাক ও বিস্মিত হয়েছে এটা দেখে যে, এই মৌলিক পদার্থগুলোর ধর্ম, গুণাবলি এবং আণবিক ওজন হুবহু মিলে যায় মেন্ডেলিফের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে : মেন্ডেলিফ রাসায়নিক পদার্থের আণবিক ওজনের জন্য শতাধিক বছরেরও বহু আগে যে পদ্ধতি তৈরি করেছেন, তার জন্য একই প্রকার ধর্মের অধিকারী মৌলিক পদার্থের সংগঠনের পর্যায়বৃত্তি বা পিরিয়ডিক টেবিলকে কেউ কি যুক্তিসম্মতভাবে শুধু আকস্মিক ব্যাপার অথবা নিছক অপরিকল্পিত বিগ ব্যাং অর্থাৎ সেই মহাবিস্ফোরণ নামের দুর্ঘটনার মতো কিছু বলে মেনে নিতে পারে?
(@) তেমনি নিউট্রিনো কণিকার অস্তিত্বের ঘোষণা দিলেন বৈজ্ঞানিক পাউলি। তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে বিটা কণিকা নির্গমনের বিষয় নিয়ে পরীক্ষা করতে কতগুলো সমস্যার উদয় হলো, যার সমাধান কোনো প্রকারেই হচ্ছিল না। এ কারণে পাউলি প্রস্তাব করলেন, বিটা নির্গমন প্রক্রিয়ায় ইলেকট্রনের সাথে নিউক্লিয়াস থেকে আরো একটি তড়িৎবিহীন ক্ষুদ্র কণিকার নির্গমন যদি ধরে নেয়া হয় তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। তিনি ১৯৩০ সালে ওই কণিকার নাম দিলেন নিউট্রিনো। তবে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় ১৯৫০ সালে, যখন পারমাণবিক চুল্লিগুলো নানা ধরনের কণা উৎপাদন শুরু করেছিল। এত দিন ধারণা করা হতো, নিউট্রিনো ভারবিহীন একটি কণা। কিন্তু ২০১৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী দুই বিজ্ঞানী নিউট্রিনোর রহস্য ভেদ করে প্রমাণ করেন নিউট্রিনোর ভর আছে। নোবেল কমিটি ঘোষণা দিয়েছে, কণা সম্পর্কিত পদার্থবিজ্ঞান ও মহাবিশ্ব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে এই তাকাকি ও আর্থারের গবেষণা বড় ধরনের সাফল্য এনেছিল।
(@) একই ভাবে ঘটনাপ্রবাহে ভারবিহীন কণা ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ এর অস্তিত্বের ভবিষ্যদ্বাণীর ৮৫ বছর পর ২০১৫ সালে আবিষ্কার করা হলো। ১৯২৯ সালে হারম্যান ভাইল নামের এক বিজ্ঞানী এমন একটি কণার অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। এরপর পরীক্ষাগারে চলে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ। অবশেষে ৮৫ বছরের মাথায় বাংলাদেশী তরুণ বিজ্ঞানী জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে একদল পদার্থবিজ্ঞানীর নিরন্তর প্রচেষ্টায় সেই কণা পরীক্ষাগারে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। ভাইল ফার্মিয়ন কণার ভর নেই। এটি ইলেকট্রনের মতো পথ চলতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। এই আবিষ্কারের পর শুধু তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানই পাল্টে যায়নি, ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার দুনিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
(@) ফরাসি পদার্থবিদ ডি ব্রোগলি ১৯২৪ সালে বিশ্বের বিজ্ঞানী সমাজের কাছে সনির্বন্ধ আবেদন জানিয়েছিলেন : আলোক রশ্মি হচ্ছে তরঙ্গ। কিন্তু এটা যখন পদার্থের শক্তি এবং ভরবেগ সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, তা হলে একই যুক্তিতে আলোক রশ্মির মতো পদার্থ রশ্মিও কেন এই একই ধরনের আচরণ দেখাবে না? ওই সময় এটি ছিল তার এক যুগান্তকারী ভবিষ্যদ্বাণী। আলো তরঙ্গ, জলতরঙ্গ, বায়ু তরঙ্গ অর্থাৎ অন্য সব তরঙ্গের মতোই পদার্থও একই ‘ধর্ম’ প্রদর্শন করবে। তিন বছর পর ১৯২৭ সালে পদার্থের তরঙ্গায়িত রূপটি সর্বপ্রথম চোখে পড়ে ডেভিসন ও গারমানের পরীক্ষায়। বর্তমান সময় পর্যন্ত সব পদার্থের অণু-পরমাণুর তরঙ্গ ধর্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। আজকের কোয়ান্টাম বিজ্ঞান বলছে : কণিকা ও তরঙ্গের মধ্যে দ্বিত্ব রয়েছে। পদার্থ কার্যত তরঙ্গের স্বচ্ছ রূপ মাত্র।
ওদিকে হাজার বছরেরও অনেক আগে সূরা আন নূরের আয়াত ৩৫ বলছে, নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল তথা মহাবিশ্বের সব কিছুই তরঙ্গ (নূর) বা আলো দিয়ে গঠিত।
শেষ কথা হচ্ছে, সমগ্র সৃষ্টি সুপরিকল্পিত এবং সুনিয়ন্ত্রিত বিধায় ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়া যুক্তিসম্মত। বিজ্ঞান সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক হওয়ার একমাত্র কারণ মহাবিশ্বের সব কিছুই একটি নিয়ম এবং পরিকল্পনার আওতাধীন হওয়ায় এর বিশ্লেষণ করে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া সম্ভব। কিন্তু অন্যসব ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষেত্রে এই যুক্তি যথেষ্ট হতে পারে না। কিভাবে সেসব বলা বা উদঘাটন সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞান এর ব্যাখ্যা দিতে পারে না। এসব ভবিষ্যদ্বাণী ফলপ্রসূ হওয়ার পরেই এসব কিছু আসলে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী, সে কথা বলা যায়।
তবে স্বভাবতই দুই হাজার বছর আগে করোনাভাইরাসের ঘোষণা কল্পনার চোখকেও হার মানায়। এ ব্যাখ্যা এভাবেই সম্ভব হতে পারে। সৃষ্টির শুরু এবং শেষ প্রতিটি মুহূর্তের সব ঘটনাপ্রবাহ সংরক্ষিত রয়েছে। যিনি সব কিছুর স্রষ্টা, তার কাছে এটি নেহায়েত মামুলি বিষয়। এমনকি মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়ার পরও কে কী করবে, বলবে এবং কোথায় কখন কী ঘটবে/সংঘটিত হবে সবই সৃষ্টিকর্তার নখদর্পণে, সবই কিন্তু লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত। এর পরেও প্রশ্ন থেকে যায় সৃষ্টিকর্তার জ্ঞান সব কিছুর ওপর থাকা স্বাভাবিক মেনে নেয়ার পরেও যে প্রশ্নটির সমাধান সহজ নয় : ২০২০ সালে গোটা পৃথিবী যে মহামারীর কবলে পড়বে, সেই পূর্বাভাস কিভাবে দেয় প্রাচীন তুর্কি ক্যালেন্ডার যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ২০৯ বছর আগে ভাগে। এ ঘটনার বিশ্লেষণে বলা যায় : প্রকৃতির মধ্যে এমন কিছু নিদর্শন ও ইঙ্গিত মহান স্রষ্টা লুকিয়ে রেখেছেন যার রহস্য উদঘাটনের ফলেই কেবল ২০০০ বছর আগেই এই রোগের ভবিষ্যদ্বাণী কার্যত দেয়া সম্ভব হয়েছে। অন্য কোনো ব্যাখ্যা আমাদের আজকের বিজ্ঞানে ও দর্শনে কিন্তু নেই।
বিজ্ঞান পরিমণ্ডলে যেসব ভবিষ্যদ্বাণী ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা, বাস্তবে বিজ্ঞানীরা এসব ভবিষ্যদ্বাণী করেন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং তাত্ত্বিক চুলচেরা সব বিশ্লেষণের মাধ্যমে। অকাট্য বৈজ্ঞানিক যুক্তি/প্রমাণ না থাকলে এ ধরনের ভবিষ্যদ্বাণী দেয়া কখনো সম্ভব না। বাস্তব দুনিয়ায় আমরা তখনই কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার বিষয় বা ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম, যদি মূল ঘটনা বা বিষয়টি সুপরিকল্পিত ও সুনিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। এ ছাড়া ভবিষ্যদ্বাণী করার প্রশ্নই ওঠে না।