যৌবনকাল সম্পর্কে ইসলাম যা বলে

ড. মো: আবদুল কাদের | Aug 12, 2020 06:07 pm
যৌবনকাল সম্পর্কে ইসলাম যা বলে

যৌবনকাল সম্পর্কে ইসলাম যা বলে - ছবি : সংগৃহীত

 

কবির ভাষায়, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার’। মানব মাত্রই শৈশব ও কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পদার্পণ করে। এ সময় শক্তি-সামর্থ্য চিন্তা-চেতনায় মানুষ অনেক বেশি নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। যেকোনো ইচ্ছা ও কামনা-বাসনা পূরণে তার ভূমিকা থাকে অপরিসীম। সভ্যতা-সংস্কৃতির যেকোনো উত্থান-পতনে তাদের অবদান হয় অনস্বীকার্য। মূলত ১৫ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত সময়কালকে যৌবনকাল বলা হয়। জাতিসঙ্ঘ ১৯৯৮ সাল থেকে ১২ আগস্টকে আন্তর্জাতিক যুব দিবস ঘোষণা করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ এবং বাংলাদেশের তিন ভাগের এক ভাগ যুব জনতা।

মানবজীবনে যৌবনকাল হলো মধ্যবর্তী সময়। শিশুকালে মানুষ থাকে দুর্বল, আর বৃদ্ধকালে হয় পরনির্ভরশীল। মাঝের সময়টুকুই শক্তি ও বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে দ্বিপ্রহরের সূর্যের মতো প্রখর। আল কুরআনে এসেছে ‘আল্লাহ, তিনি দুর্বল অবস্থায় তোমাদের সৃষ্টি করেন। দুর্বলতার পর শক্তিদান করেন, শক্তিমত্তার পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান’ (সূরা আল রুম : ৫৪)।

যৌবনের উদ্যমতা ও শক্তিমত্তাকে যদি সঠিক পন্থায়, সঠিক কাজে ব্যয় করা হয়, তাহলে সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গড়ে উঠে। কারণ এই যুবকরাই জাতির মেরুদণ্ড। এরা সুসংহত হলে গোটা জাতি সুসংহত হয়। এরা পথ হারালে গোটা জাতিই পথ হারায়।

যুবক বয়সের বেশির ভাগ নারী-পুরুষই দুনিয়া অর্জন তথা ধন-সম্পদ, বাড়ি-গাড়ি ও চাকচিক্যময় জীবন-যাপন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পরকালের কথা বেমালুম ভুলে যায়। অনাগত পরকালের সীমাহীন জীবনের সুখ-শান্তির কথা মনে থাকে না। দুনিয়ার চাকচিক্য ও সৌন্দর্য তাকে পেয়ে বসে। এ ছাড়া মানুষের প্রকাশ্য দুশমন বিতাড়িত শয়তান দুনিয়াতে যুবক-যুবতীদের পরস্পরের সামনে সুমিষ্ট ও সুশোভিত করে তুলে।
সমাজে নানা ধরনের অন্যায়-অবিচার-অশ্লীলতা ও বেহায়াপনার জন্য সর্বাগ্রে যুবকরাই দায়ী। তাদের বেপরোয়া ভাব ও অনৈতিকতার কারণেই সব অপকর্মের জন্ম। আল্লøাহ তায়ালা এসবকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘বলো, আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন সব প্রকার অশ্লীলতা। তা প্রকাশ্য হোক আর অপ্রকাশ্য হোক’ (সূরা আল আরাফ : ৩৩)।

আল্লøøাহ তায়ালার কাছে যুবক বয়সের ইবাদত-বন্দেগির মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা তখন মানুষ বেশির ভাগই সুস্থ থাকে এবং সব ইবাদত যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়। নবী-রাসূলগণ আল্লøাহর পক্ষ থেকে যে রিসালাতপ্রাপ্ত হয়েছেন তা ছিল যৌবন বয়সে। ইবনু আব্বাস রা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সমস্ত নবীদের যৌবনকালে নবুয়ত দান করেছেন, যৌবনকালেই আলেমদের ইলম প্রদান করা হয়।’ আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তিনি (মূসা আলাইহিস সালাম) যখন পূর্ণ যৌবনে পৌঁছিলেন, তখন তাকে প্রজ্ঞা ও ব্যুৎপত্তি দান করলাম’ (সূরা আল কাসাস : ১৪)।

আসহাবে কাহাফের সাত ব্যক্তিও ছিল যুবক। যারা এক আল্লাহর ইবাদতে বিশ্বাসী ছিলেন। যাদেরকে শত্রুর হাত থেকে আল্লাহ তায়ালা রক্ষা করেছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘(হে রাসূল!) আপনার কাছে তাদের ইতিবৃত্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করেছি। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। তারা তাদের পালনকর্তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছিলাম’ (সূরা আল কাহাফ : ১৩)।
ইসলামে প্রবিষ্ট হওয়ার দিক থেকেও যুবকরা ছিল অগ্রণী। মূসা আ:-এর অনুসারীদের মধ্য থেকে যুবকরাই সর্বপ্রথম ঈমান এনেছে। মুহাম্মদ সা:-এর দাওয়াতে সর্বপ্রথম শতাধিক যুবক ইসলাম গ্রহণ করেছেন।

আর তাদের বেশির ভাগ ছিলেন ১৫ থেকে ৪০ বছর বয়সের। ইমাম ইবনু কাসির রহ: বলেছেন, ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আহ্বানে সাড়া দানকারীরা বেশির ভাগই ছিল যুবক। আর কুরাইশদের বুড়োরা তো তাদের বাপ-দাদার ধর্মেই অটল ছিল। এদের খুব অল্পসংখ্যকই ঈমান এনেছিল।’

যৌবনকালকে আল্লাহর ইবাদতে ব্যয় করা আরশের ছায়াতলে আশ্রয় পাওয়ার মাধ্যম। হাদিসে এসেছে, সাত শ্রেণীর মানুষকে হাশরের মাঠে আল্লাহ তায়ালা তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবেন, যেদিন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে অন্যতম হলো ওই যুবক, যার যৌবন কেটেছে আল্লাহর ইবাদতে (বুখারি : ৬৬০)।

পুরো জীবনকালের ব্যাপারে যদিও আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে, কিন্তু যৌবনকালের ব্যাপারে বিশেষভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। রাসূল সা: বলেছেন, ‘কিয়ামত দিবসে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আদম সন্তানের পদদ্বয় আল্লাহ তায়ালার কাছ থেকে এক কদমও সরতে পারবে না: তার জীবনকাল সম্পর্কে, কিভাবে তা অতিবাহিত করেছে; তার যৌবনকাল সম্পর্কে, কী কাজে তা ব্যয় করেছে...’ (তিরমিজি : ২৪১৭)।

আল কুরআনে মহান আল্লাহ সময়ের কসম খেয়েছেন, মানুষকে ক্ষতি থেকে বাঁচানোর জন্য সময়কে গুরুত্ব দিতে তিনি আদেশ করেছেন। তা ছাড়া হাদিসে এসেছে, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের আগে সুবর্ণ সুযোগ মনে করো। তোমার যৌবনকে কাজে লাগাও বার্ধক্য আসার আগে...’ (হাকিম, মুস্তাদরাক : ৭৮৪৬)।

আবু বকর রা: বলেন, ‘যৌবনের ইবাদত বৃদ্ধ বয়সের ইবাদতের চেয়ে অনেক বেশি দামি। আবার বৃদ্ধ বয়সের পাপ যৌবনের পাপের চেয়ে অনেক বেশি জঘন্য।’ শেখ সাদী রহ: বলেছেন, ‘দুনিয়া ও পরকালের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা এ যৌবনকালেই সংগ্রহ করো।’

বর্তমান সময়ে যুবসমাজের সার্বিক অবক্ষয়ের বড় কারণ হলো- সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার যথাযথ তদারকির অভাব। সমাজের অনেক পিতা-মাতা, নিজ সন্তানের চলাফেরা ও গতিবিধির প্রতি লক্ষ্যই রাখেন না। তা ছাড়া, ছোটবেলা থেকে নৈতিক শিক্ষা, নামাজ, রোজা ও কুরআন-সুন্নাহর বিধিবিধানের প্রতি উদাসীন থাকা সন্তানকে যুবক বয়সে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে গাফেল রাখে।

পরিশেষে বলা যায়, যৌবনকাল মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এ সময়ের ইবাদতের মর্যাদাও বেশি। অতএব, যুবক-যুবতী যৌবনের উচ্ছলতায় বিবেক, বুদ্ধি হারিয়ে ভুল পথে যাতে পা না বাড়ায়; সে দিকে আগে থেকেই অভিভাবকদের যেমন সতর্ক থাকা জরুরি, তেমনি যুবক-যুবতীর উচিত কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা।

লেখক : অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us