গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি থেকে সতর্কতা
গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি থেকে সতর্কতা - ছবি : সংগৃহীত
আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে অগণিত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। নবী-রাসূল পাঠানোর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে এক আল্লাহর পথে ডাকা, কালেমার দাওয়াত দেয়া, তাওহিদের বাণী প্রচার করা, মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসা। কিন্তু মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যখনই নবী-রাসূলরা তাদের স্বজাতির কাছে দাওয়াত নিয়ে এসেছেন তখনই তারা তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে; মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া। তারা নবী-রাসূল ও আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রদর্শন, একগুঁয়েমি ও পেশিশক্তির প্রভাব দেখাত। শিরক-কুফরি থেকে শুরু করে যাবতীয় অন্যায়, পাপ ও জুলুম-অত্যাচারে লিপ্ত থাকত। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের পাপরাশির কারণে তাদের (প্লাবনে) ডুবিয়ে মারা হয়েছিল। অতঃপর তাদের (কবরের) অগ্নিতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের জন্য আল্লাহর মোকাবেলায় কাউকে তারা সাহায্যকারী পায়নি।’ (নুহ ৭১/২৫)
যুগে যুগে আল্লাহ তায়ালা অনেক শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর জাতি গোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন তাদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, অবাধ্যতা ও পাপের কারণে। এরকম আল্লাহর গজবে ধ্বংসপ্রাপ্ত বিশ্বের প্রধান ছয়টি জাতি হলো- ‘কাওমে নুহ’, ‘কাওমে আদ’, ‘কাওমে ছামুদ’, ‘কাওমে লুত’, ‘আহলে মাদইয়ান’, ‘কাওমে ফিরআউন’। এসব জাতি গোষ্ঠীকে আল্লাহ তায়ালা সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের মাধ্যমেই পৃথিবীবাসী সর্বপ্রথম বিগত যুগের এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতির খবর জানতে পেরেছে। আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী ছিলেন হজরত নুহ আ:। তিনি তাদের মধ্যে পঞ্চাশ কম এক হাজার বছর অবস্থান করেছিলেন। ‘কাওমে নুহ’ ছিল অত্যাচারী, অবাধ্য জাতিগোষ্ঠী। শিরক-কুফর থেকে শুরু করে যাবতীয় অন্যায়, পাপ-পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত ছিল তারা। নুহ আ:-এর আহ্বানে তারা কোনো কর্ণপাত করেনি বরং তারা তাকে অস্বীকার করেছে। ফলে আল্লাহ তায়ালা ভয়াবহ প্লাবনের মাধ্যমে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিলেন।
নুহ আ:-এর যুগের প্লাবন ইতিহাসের স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ প্লাবন। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সাগরতলে সঙ্ঘটিত ভূমিকম্পের সুনামিতে উত্থিত ৩৩ ফুট উঁচু ঢেউ নুহের তুফানকে স্মরণ করিয়ে দেয়। নুহ আ:-এর মতো মহান আল্লাহ তায়ালার আরেকজন নবী হজরত হুদ আ: যিনি ‘আদ’ জাতির প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন। ‘কাওমে আদ’ ছিল অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও প্রখর শক্তিশালী। ‘আদ’ সম্প্রদায়ের ১৩টি পরিবার বা গোত্র ছিল। আম্মান হতে শুরু করে হাজরামাউত ও ইয়ামান পর্যন্ত তাদের বসতি ছিল। তাদের ক্ষেত-খামারগুলো ছিল অত্যন্ত সজীব ও শস্যশ্যামল। তাদের প্রায় সব ধরনের বাগ-বাগিচা ছিল। তারা ছিল সুঠামদেহী ও বিরাট বপু সম্পন্ন। তারা আল্লাহর ইবাদত পরিত্যাগ করে মূর্তি পূজা ও শিরকে লিপ্ত হয়েছিল। ফলে ধীরে ধীরে তাদের ওপর আল্লাহর গজব নেমে আসে। ‘কাওমে আ’দের অমার্জনীয় হঠকারিতার ফলে প্রাথমিক গজব হিসেবে উপর্যুপরি তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে।
তাদের শস্যক্ষেতসমূহ শুষ্ক বালুকাময় মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও তারা শিরক ও মূর্তি পূজা ত্যাগ করেনি। কিন্তু অবশেষে তারা আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করে। হজরত হুদ আ: বৃষ্টির জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আকাশে কালো মেঘ জমা হলে লোকেরা তাকে স্বাগত জানিয়ে বলে, ‘এটি আমাদের বৃষ্টি দেবে’। জবাবে হুদ বললেন, ‘তার পালনকর্তার আদেশে সে (মেঘমালা) সবকিছুকে ধ্বংস করে দেবে।’ (আহকাফ ৪৬/২৫) ফলে অবশেষে পরদিন ভোরে আল্লাহর চূড়ান্ত গজব নেমে আসে। সাত রাত ও আট দিনব্যাপী অনবরত ঝড়-তুফান বইতে থাকে। মেঘের বিকট গর্জন ও বজ্রপাতে বাড়িঘর সব ধ্বংস হয়ে যায়। প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে গাছপালা সব উপড়ে যায়, মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে জমিনে পতিত হয়। আল্লাহ বলেন, ‘আর আদ গোত্রকে ধ্বংস করা হয়েছিল এক প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবায়ু, যা তিনি প্রবাহিত করেছিলেন তাদের ওপর সাত রাত ও আট দিন পর্যন্ত অবিরাম। আপনি তাদের দেখতেন যে, তারা অসার খর্জুর কাণ্ডের মতো ভূপাতিত হয়ে রয়েছে। আপনি তাদের কোনো অস্তিত্ব দেখতে পান কি? (হাককাহ ৬৯/৬-৮)
এভাবেই শক্তিশালী ও সুঠাম দেহের অধিকারী বিশাল বপু ‘আদ’ জাতি সম্পূর্ণরূপে নিচিহ্ন হয়ে যায়। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা এমন ফাসাদ থেকে বেঁচে থাকো যা বিশেষত শুধু তাদের ওপর আপতিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে জালেম এবং জেনে রেখো যে, আল্লাহর আজাব অত্যন্ত কঠোর।’ (আনফাল ৮/২৫) তারা আল্লাহর অনুগ্রহসমূহের অবমূল্যায়ন করেছিল। তারা অযথা উঁচু স্থানে সুউচ্চ টাওয়ার ও নিদর্শনসমূহ নির্মাণ করত, যা একান্তই অপচয় ব্যতীত কিছুই ছিল না। তারা দুর্বলদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে আঘাত হানত এবং মানুষের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাত।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে করোনার বিস্তার তা আমাদের প্রত্যেকের হাতে কামাই করা পাপের ফসল ভিন্ন অন্য কিছু না। আল্লাহ চাইলে আমাদের এর চেয়ে ভয়াবহ রোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আসমানি ও জমিনি বালা দিয়ে পূর্বেকার জাতিগোষ্ঠীর ন্যায় এক নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের গৃহবন্দী করে রাখতে পারেন। কেননা আল্লাহর পাকড়াও বড়ই কঠিন। তাই আমাদের প্রত্যেককে সতর্ক হওয়া উচিত। অতীতে সঙ্ঘটিত পাপকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে যেন ওই ধরনের কাজ আর না করি এভাবে মনস্থির করে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে তাওবা করা উচিত। মৃত্যু আসার আগে যাবতীয় পাপকর্ম ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া উচিত। নচেত পরকালের ভয়াবহ শাস্তি তো বিদ্যমান রয়েছে আমাদের জন্য।
লেখক : এমফিল গবেষক