পুরুষরা কেন মাস্ক পরতে চায় না?
পুরুষরা কেন মাস্ক পরতে চায় না? - ছবি : সংগৃহীত
"মাস্ক পরি না তার একটা কারণ, আমার গরম লাগে" - বলছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার বনানী এলাকার একজন মুদি দোকানদার - "এই গরমে মাস্ক পরে আমি থাকতে পারি না।"
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তার দোকান খোলা থাকে - এবং এই পুরো সময়টাই তিনি মাস্ক না পরে দোকানদারি করেন, প্রতিদিন কয়েক শ' ক্রেতার সাথে কথা বলেন।
"প্রতি মিনিটে আমাকে ক্রেতাদের সাথে কথা বলতে হয়। মাস্ক পরা থাকলে তারা আমার কথা বুঝতে পারে না। আর গরম তো আছেই, এসব কারণেই মাস্ক পরি না" - বিবিসিকে বলছিলেন এই দোকানী।
বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর প্রায় ৬ মাস পার হতে চলেছে। এখনো মাস্ক পরেন না এই দোকানদার।
তিনি কি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ভয় করেন না? শুরুর দিকে তার ধারণা ছিল - তার কিছু হবে না। এখনও হয়তো "আমার কিছু হবে না", এই ধারণা পাল্টায়নি তার।
প্রকাশ্য স্থানে মাস্ক পরার জন্য সরকারি নির্দেশনা থাকলেও বাংলাদেশে তা মানা হচ্ছে কমই।
"মাস্ক পকেটে থাকে, কিন্তু মানুষ পরে না" - সোমবার সরকারের এক বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের এ উক্তি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে বের হয়।
বিশেষত ঢাকার খোলা বাজারগুলোতে - যেখানে প্রচুর জনসমাগম হয় - সেখানে বহু লোককেই মাস্ক ছাড়া কেনাবেচা করতে দেখা যাচ্ছে, এমন খবর বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে বেরুচ্ছে প্রতিনিয়ত ।
এসব খবরে দেখা যায়, ঢাকার বস্তি এলাকাগুলোর কোন কোন বাসিন্দা বলেন, করোনাভাইরাস "বড়লোকদের রোগ," - গরিব মানুষের এতে কিছু হবে না।
এ নিয়ে কথা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসরিন সুলতানার সাথে।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, বাংলাদেশে মাস্ক পরার প্রবণতা কম হওয়ার একটা বড় কারণ সচেতনতার অভাব।
তার মতে, দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের শিক্ষার স্বল্পতার কারণে তারা এই রোগের ঝুঁকির মাত্রা উপলব্ধি করতে পারে না।
"অনেকেই মনে করে যে মাস্ক না পরলেও তার কিছু হবে না" - বলছিলেন অধ্যাপক নাসরিন সুলতানা।
তিনি একথাও বলেন যে অপেক্ষাকৃত নিম্নবিত্ত ও স্বল্প-শিক্ষিতদের মধ্যে মাস্ক পরার ব্যাপারে আগ্রহ বা সচেতনতা - দুটোই কম।
কোলকাতায় কী হচ্ছে?
বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোলকাতা শহরে ঘরের বাইরে মাস্ক পরার জন্য কড়া প্রশাসনিক নির্দেশ আছে।
কিন্তু তার পরও তা অমান্য করার দৃষ্টান্ত আছে অনেক।
সংবাদদাতারা বলেন, কোলকাতা শহরে অনেককেই দেখা যায়, মুখে মাস্ক থাকলেও তা নামিয়ে রাখা আছে থুতনির নিচে। কারো মাস্কটা দেখা যাচ্ছে এক পাশ থেকে খোলা, কান থেকে ঝুলছে।
অভিযোগ আছে যে এরা অনেকেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোক দেখলে চট করে মাস্কটা ঠিকমত পরে নেন।
সরকারি তথ্য বলছে, শুধু কোলকাতা শহরে গত ৮ই জুলাই থেকে তিন দিনে মাস্ক না পরার জন্য ১,২৫৩ জনকে গ্রেফতার বা জরিমানা করা হয়েছে।
বাংলাদেশে মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের উদ্যোগ
বাংলাদেশে মাস্ক না পরার জন্য কারো শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায় না।
তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবারই সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, প্রকাশ্য স্থানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক।
লোকে যাতে এ নির্দেশ মেনে চলে - সে জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালতের মত পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে , বলেন তিনি।
লোকে মাস্ক পরতে চায় না কেন?
করোনাভাইরাস চীন থেকে শুরু হবার পর গত সাত মাসে পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে, এ ভাইরাসে সংক্রমিত হবার পর সারা পৃথিবীতে মোট ৭ লক্ষেরও বেশি লোক মারা গিয়েছেন।
করোনাভাইরাস মহামারি সংক্রান্ত যেকোনো খবরের জন্য একটি দারুণ প্রতীকী ছবি হচ্ছে মাস্ক পরা কোন মানুষের মুখ।
কিন্তু তার পরও অনেকে মাস্ক পরতে চায় না। কেন?
এর একটা কারণ শারীরিক অস্বস্তি। অনেকের জন্য মাস্ক পরে থাকলে কথা বলতে বা অন্যের কথা বুঝতে অসুবিধা হয়।
অনেকের চশমা ঘোলা হয়ে যায় বলে তাদের দেখতে অসুবিধা হয়।
কিন্তু এ ছাড়াও অনেক কারণ আছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহু লোকই প্রকাশ্য স্থানে মাস্ক পরতে চান না। এমনকি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেও দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে এমনকি জনসভাতেও মাস্ক পরেননি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের অনেককে ফেস মাস্ক না পরা অবস্থায় দেখার পর স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি কিছুদিন আগেই হুঁশিয়ারি দেন যে কোন সদস্য অধিবেশন কক্ষে মাস্ক না পরলে তাকে বের করে দেবেন তিনি।
কিন্তু অনেক আমেরিকান মনে করেন, বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরার নির্দেশটি তারা কি পরবেন-না-পরবেন সেই স্বাধীনতার প্রতি একটা হুমকি।
আমেরিকার বহু জায়গায় মাস্ক পরার নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হয়েছে।
ব্রিটেনে বা ইউরোপেও যে এর ঢেউ লাগেনি তা নয়।
ব্রিটেনের একজন লেখক ও কলামিস্ট পিটার হিচেন্স রক্ষণশীল দি ডেইলি মেইল পত্রিকায় এক নিবন্ধে লেখেন - মুখে ঢাকনা দেয়াটা তার ভাষায় "আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের" চিহ্ন এবং এর মাধ্যমে পৃথিবীর অন্যতম মুক্ত একটি দেশে মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে।
তার মতে, মাস্ক পরার অর্থই হচ্ছে আপনি এই সামাজিক পরিবর্তনকে মেনে নিচ্ছেন।
তবে সাধারণভাবে পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের লোকেরা মাস্ক পরাটাকে অনেক বেশি মেনে নিয়েছে বলা যায়।
গবেষণা : পুরুষরা মাস্ক পরতে চায় না?
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে মহামারির সময় ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই ) বা মাস্ক পরার ক্ষেত্রে জেণ্ডার একটা ভূমিকা পালন করে।
দেখা যায়, মেয়েদের তুলনায় পুরুষরা মাস্ক পরতে বেশি অনাগ্রহী।
অতি সম্প্রতি ব্রিটেন ও কানাডার দুজন বিজ্ঞানী - মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যালেরিও কাপরারো, এবং বার্কলির ম্যাথমেটিকাল সায়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হেলেন বারচেলো - আড়াই হাজার লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়েছেন।
তারা বলছেন, গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষরা ফেসমাস্ক পরতে চান না কারণ তারা এটাকে লজ্জাজনক, গেঁয়ো এবং দুর্বলতার লক্ষণ বলে মনে করেন।
অন্য কিছু জরিপে দেখা গেছে, পুরুষরা মেয়েদের তুলনায় হাত ধোয়ার ব্যাপারেও কম আগ্রহী।
যদিও এটা এখন অনেকেই জানেন যে করোনাভাইরাসে গুরুতর আক্রান্ত বা মারা যাবার ঝুঁকি পুরুষদেরই বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ঝোঁকও এ ক্ষেত্রে একটা ভূমিকা পালন করছে।
দেখা গেছে, ডেমোক্রাটিক পার্টির সমর্থকদের ৭৬ শতাংশই ঘরের বাইরে বেশিরভাগ সময় মাস্ক পরেন। অন্যদিকে রিপাবলিকানদের মধ্যে মাস্ক পরেন মাত্র ৫৩ শতাংশ।
গবেষকরা বলছেন, পুরুষরা তুলনামূলক ভাবে অতি-আত্মবিশ্বাসী এবং অসতর্ক (কেয়ারলেস) এবং এটা তাদের মাস্ক না পরার প্রবণতায় একটা ভূমিকা রাখে।
মাস্ক পরা নিয়ে মত পরিবর্তন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, শুধু মাত্র অসুস্থ এবং অসুস্থদের সেবার সাথে জড়িত ব্যক্তিদেরই মাস্ক পরা উচিত, সুস্থ মানুষের এটা পরার প্রয়োজন আছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
তবে জুন মাসে এই নির্দেশনা পরিবর্তন করে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা।
সংস্থাটি এখন বলছে, মাস্ক পরলে 'জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট' থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে গবেষণায় দেখা গেছে। তাই করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামাতে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা উচিত।
এই নির্দেশনার পর যেসব দেশ আগে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে নি, যেমন ব্রিটেন - তারাও প্রকাশ্য স্থানে, গণপরিবহনে এবং দোকানপাটের ভেতরে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে।
ফ্রান্সে যেসব প্রকাশ্য স্থানে লোকের ভিড় হয় সেখানে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
কতটা সুরক্ষা দেয় মাস্ক
এটা সবাই বলেন যে মাস্ক করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানো প্রতিরোধের ক্ষেত্রে কিছুটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে - তবে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
হাঁচি বা কাশি থেকে ভাইরাসের সংক্রমণের ঝুঁকি কিছুটা কমাতে সাহায্য করতে পারে এই মাস্ক। আর হাত থেকে মুখের সংক্রমণের বিরুদ্ধেও কিছু সুরক্ষা এটা দেয় - বিবিসিকে এ কথা বলেন ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের সেন্ট জর্জেসের ড. ডেভিড ক্যারিংটন ।
তবে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক বায়ুবাহিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে যথেষ্ট নয়, বলে ড. ক্যারিংটন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিকতম নির্দেশনা হলো : যেসব জায়গায় দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব নয় - যেমন গণপরিবহন, শরণার্থী শিবির, জনবহুল দোকানপাট - সেখানে ঘরে তৈরি করা মাস্ক পরলে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে।
যাদের বয়স ষাটের ওপর এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, তারা আরো উন্নত মেডিকেল গ্রেডের মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন।
নতুন গবেষণা বলছে, মাস্ক সংক্রমণের মাত্রা কমাতে পারে
অথচ করোনাভাইরাস সংক্রমণ সম্পর্কে এখন নতুন যে সব তথ্য জানা যাচ্ছে তাতে প্রকাশ্য স্থানে ফেস মাস্ক পরার গুরুত্ব আরো বেড়ে যায় ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমিত মানুষদের ৪০ শতাংশের দেহেই কোন উপসর্গ দেখা যায় না।
তার মানে, তারা যদি প্রকাশ্য স্থানে অন্য মানুষদের সংস্পর্শে আসেন - এবং বাস-মিনিবাস-ট্রেনের মত গণপরিবহনে যাতায়াত করার সময় অন্যদের কাছাকাছি আসেন - তাহলে অন্যদের সংক্রমিত হবার ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।
কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, ফেসমাস্ক পরলে শরীরের ভেতর হয়তো অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ করোনাভাইরাস ঢুকতে পারে - এবং সেক্ষেত্রে হয়তো তার উপসর্গ হবে খুবই মৃদু বা আদৌ কোন উপসর্গ দেখা যাবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় সংক্রামক-ব্যাধি-বিশেষজ্ঞ ড. এ্যান্টনি ফাউচি বলেছেন, একজন মানুষের সংক্রমণ কতটা গুরুতর তা জানার ক্ষেত্রে তার দেহে কি পরিমাণ ভাইরাস ঢুকেছে তা একটি "গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্ভাব্য নির্ণায়ক হতে পারে এটা প্রায় নিশ্চিত।"
তবে তিনি এ-ও বলেন যে এ ক্ষেত্রে অনেক অজানা বিষয় রয়েছে।
মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্টের এক রিপোর্ট বলছে, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক যে উপাত্ত পেয়েছেন তা থেকে মনে করা হচ্ছে - যেসব এলাকায় লোকে মাস্ক বেশি পরছে সেসব এলাকাতেই কোন-উপসর্গ-নেই এমন সংক্রমিত লোকের অনুপাত বেশি।
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মনিকা গান্ধী বলছেন, করোনাভাইরাস মহামারির প্রথম দিকে - যখন বেশিরভাগ লোকই মাস্ক পরতেন না - তখন উপসর্গবিহীন সংক্রমিত লোকের অনুপাত ঝিল মাত্র ১৫ শতাংশ।
কিন্তু পরের দিকে যখন লোকে মাস্ক পরা শুরু করলো - তখন উপসর্গবিহীন সংক্রমিত লোকের অনুপাত বেড়ে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশে উঠে যায়।
মিজ গান্ধী বলছেন, এতে মনে হয় - মাস্ক পরলে তা যে শুধু অন্যদেরকেই সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে তা নয়, যিনি মাস্ক পরছেন তিনিও সুরক্ষা পাচ্ছেন।
সূত্র : বিবিসি