পবিত্র কোরআনে যে ৫ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে
পবিত্র কোরআনে যে ৫ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে - ছবি : সংগৃহীত
কুরআন মাজিদ বিশ্ব জগতের মালিক আল্লাহ তায়ালার নাজিল করা সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থ। কুরআন মাজিদের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য, অপূর্ব ধ্বনিব্যঞ্জনা, শব্দের লালিত্য, বর্ণনার বলিষ্ঠতা, প্রকাশভঙ্গির প্রাঞ্জলতা, রসবোধ ইত্যাদি গুণাবলি আরব পণ্ডিতদের ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। মরিস বুকাইলির ভাষায় কুরআন মাজিদ বিজ্ঞানের জন্য একটি বিজ্ঞান গ্রন্থ, ভাষাবিদদের জন্য একটি শব্দকোষ, ব্যাকরণবিদদের জন্য একটি ব্যাকরণগ্রন্থ, কবিদের জন্য একটি ছন্দ সংহিতা এবং আইনজ্ঞদের জন্য একটি ল’বুক।
কুরআন মাজিদের আলোচ্য বিষয় : কুরআন মাজিদে পাঁচ প্রকারের বিষয় আলোচিত হয়েছে।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, মহানবী সা: বলেন- কুরআন মাজিদ পাঁচটি বিষয় সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে। ১. হালাল ২. হারাম ৩. মুহকাম ৪. মুতাশাবিহ ও ৫. আমসাল বা উপমা। অতএব, তোমরা হালালগুলো মেনে চলো, হারাম থেকে বিরত থাকো, মুহকামের অনুসরণ করো, মুতাশাবিহের প্রতি বিশ্বাস রাখো এবং আমসাল বা উপমা থেকে উপদেশ গ্রহণ করো। (বায়হাকি)
১. হালাল : হালাল বলতে বোঝানো হয়েছে ওইসব নির্দেশিকা সংবলিত আয়াত, যাতে করণীয় কাজের আদেশ করা হয়েছে। এগুলো চার ভাগে বিভক্ত। ক. ঈমান ও আমলবিষয়ক খ. অন্যের হক ও অধিকারবিষয়ক গ. আখলাক ও নৈতিকতা বিষয়ক ঘ. আদব ও শিষ্টাচারবিষয়ক।
২. হারাম : হারাম বলতে বোঝায় যেসব কাজ করতে আল্লাহ তায়ালা নিষেধ করেছেন। কুরআন মাজিদে হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়গুলোকে বিভিন্ন গুণবাচক শব্দ ব্যবহার করে বোঝানো হয়েছে। যেমন- মুনকার : অসৎ কাজ। ফাহশা বা অশ্লীলতা, সাইয়্যিয়া বা মন্দকর্ম, খাতা বা ভুল, অপছন্দনীয়, মাকরুহ বা ত্রুটি, ইছম বা পাপ, উদওয়ান বা বাড়াবাড়ি ইত্যাদি। হারাম বা নিষিদ্ধ কাজগুলো প্রধানত দুই প্রকার। ১.কবিরা ও সগিরা।
হালাল বা আদিষ্ট কাজগুলো সাধ্যমতো করতে হবে। আর হারাম ও নিষিদ্ধ কাজগুলো সম্পূর্ণরূপে বর্জন করতে হবে। মহানবী সা: বলেছেন- আমি যখন তোমাদের কোনো কাজের আদেশ করি তোমরা তা সাধ্যমতো করবে, আর কোনো কাজ করতে বারণ করি, তবে তা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করবে।
৩. মুহকাম : মুহকাম অর্থ সুস্পষ্ট, বোধগম্য, মজবুত ইত্যাদি। মুহকাম আয়াতসমূহকে আল্লাহ তায়ালা উম্মুল কিতাব তথা কুরআনের আসল বিষয় বলেছেন। কেননা, এসব আয়াতই সমগ্র শিক্ষার মূল ভিত্তি।
৪. মুতাশাবিহ : অর্থাৎ অস্পষ্ট ও রূপক। যেমন- কিয়ামত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, দাজ্জাল বের হওয়ার কথা, কুরআন মাজিদের সূরার প্রথমে বর্ণিত বিচ্ছিন্ন অক্ষরগুলো ইত্যাদি। এসব আয়াতের উদ্দেশ্য অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। এগুলো আল্লাহ তায়ালা ও তদীয় রাসূল সা:-এর মধ্যকার গোপন রহস্য। এগুলোর প্রকৃত অর্থ সম্পর্কে সর্বসাধারণ অবগত হতে পারে না বরং এসব শব্দের তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া বৈধ নয়। এগুলোর মমার্থ আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ জানে না, তবে না জানলেও এগুলোর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা ফরজ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- তিনি আপনার প্রতি কিতাব নাজিল করেছেন। তাতে কিছু আয়াত রয়েছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের মূল। আর অন্যগুলো রূপক। সুতরাং যাদের অন্তরে কূটিলতা রয়েছে তারা তন্মধ্যকার রূপকগুলোর অনুসরণ করে ফিৎনা বিস্তার ও অপব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে। (সূরা আলে ইমরান-৭)
৫. আমসাল : আমসাল শব্দটি মাসাল-এর বহুবচন। অর্থ উপমা, উদাহরণ, প্রবচন, আদর্শ, সাদৃশ্য, নিদর্শন, দৃষ্টান্ত ইত্যাদি। আল-মাওয়ারদি বলেন, ইলমুল আমসাল ইলমুল কুরআনের অন্যতম বৃহৎ অংশ, অথচ মানুষ তা থেকে সম্পূর্ণ গাফিল। মানুষ এগুলোর নিগূঢ় অর্থ বুঝে তা থেকে ফায়দা হাসিল করছে না। ইমাম শাফেয়ী রহ: বলেন- উলূমুল কুরআন সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করা কুরআন গবেষকের জন্য ওয়াজিব।
উপমার উদাহরণ :
১. আল্লাহ তায়ালা নিঃসন্দেহে মশা বা তদূর্ধ্ব বস্তু দ্বারা উপমা উপস্থাপনে লজ্জাবোধ করেন না। (সূরা বাকারা-২৬)
২. আর কাফিরদের উদাহরণ এমন, যেন কেউ এমন কোনো জীবকে আহ্বান করছে যা হাঁক-ডাক আর চিৎকার ছাড়া কিছুই শোনে না। (সূরা বাকারা-১৭১)
৩. আপনি তাদের কাছে সে জনপদের অধিবাসীদের দৃষ্টান্ত বর্ণনা করুন, যখন সেখানে রাসূলগণ আগমন করেছিলেন। (সূরা ইয়াসিন-১৩)
কুরআন মাজিদে মোট ১৭৯টি উপমা রয়েছে (মুজামুল মুফহারিসলি আল ফাজিল কুরআন- মুহাম্মদ ফুআদ আবদুল বাকী)। এসব উপমা ও উদাহরণের উপকারিতা হলো- উপদেশ দান, উৎসাহিত করা, ভীতি প্রদর্শন, দৃষ্টান্ত পেশ করা, আসল ভাব উদ্ধার করা, মূল বিষয়ের প্রতিচ্ছবি চিত্রিত করা ইত্যাদি। তা’ছাড়া কুরআন মাজিদের উপমাগুলো প্রশংসা, নিন্দা, বিনিময়, শক্তি, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা কিংবা তুচ্ছ করা ইত্যাদি নানাবিধ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী