কয়েকটি ঐতিহাসিক মসজিদের অবস্থা
ডোম অব রক - ছবি : সংগৃহীত
ক. বায়তুল মুকাদ্দাস : বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের অবস্থানের কারণে ১৯৪৭ সালে জাতিসঙ্ঘের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জেরুসালেমকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মালিকানায় দিয়ে জাতিসঙ্ঘের প্রশাসনিক আওতাধীন রাখা হয়। কিন্তু ইহুদিবাদী ইসরাইল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর থেকে জেরুসালেমে অবৈধ দখলদারিত্ব কায়েম করতে শুরু করে। ১৯৮০ সালে তারা আন্তর্জাতিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জেরুসালেমকে তাদের রাজধানী ঘোষণা করে। কিন্তু বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান যেখানে হজরত মুহাম্মদ সা: সব নবীর নামাজে ইমামতি করেছেন এবং এই মসজিদ থেকেই তাঁর মিরাজের যাত্রা শুরু করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে ইসরাইল জর্দানের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, এই মসজিদের ভেতরটি মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে এবং বাইরের নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকবে ইসরাইলের। আর শুধু মুসলমানরাই এখানে নামাজ আদায় করতে পারবে। অন্য ধর্মাবলম্বীরা শুধু পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর বিভিন্ন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এ মসজিদে প্রবেশ করতে বাধা সৃষ্টি করছে। একটি নির্দিষ্ট বয়সের বেশি বয়স্ক মুসলমানদেরকেই তারা শুক্রবারের নামাজ পড়ার অনুমতি দিচ্ছে। বাকিদের ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নামাজ পড়তে আসার জন্য অনুমতি নিতে হয়। ২০১৫ সালে একদল ইহুদি তাদের ‘জাতীয় ছুটি উদযাপনের জন্য’ মসজিদে প্রবেশের চেষ্টা চালায়। ২০১৬ সালে আরেক দল ইহুদি রমজানের শেষ ১০ দিন মুসলমানদের ইতেকাফকালে অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করে মুসলমানদের ইবাদত বন্দেগিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এমনকি ইসরাইলি মন্ত্রীরা মসজিদের নিচের টানেলে পূর্ব জেরুসালেম দখলের অর্ধশত বছর উদযাপন এবং পুরো জেরুসালেম দখলের পরিকল্পনা করার জন্য সভার আয়োজন করেন। সবচেয়ে ভয়ানক হলো, ইহুদিরা চুক্তি ভঙ্গ করে মসজিদের ভেতর প্রার্থনা করার প্রয়াস পাচ্ছে। তারা তিন হাজারের বেশি নিরাপত্তা বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যকে বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের আশপাশে মোতায়েন করে রেখেছে।
খ. আল আহমার মসজিদ : অন্যদিকে উত্তর ফিলিস্তিনের ত্রয়োদশ শতাব্দীর আল আহমার মসজিদটিকে ইসরাইলের সাফাদ নগর কর্তৃপক্ষ পানশালা ও কমিউনিটি সেন্টারে পরিণত করেছে। ১৯৪৮ সালে ওই এলাকা দখল করার পর থেকে সেখানে মুসলমানদের নামাজ পড়া নিষিদ্ধ রয়েছে (নয়া দিগন্ত : ১৫ জুলাই ২০২০)।
গ. উইঘুর : সাম্প্রতিককালে উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীন সরকারের নির্যাতনের খবর সবারই জানা। ১৩ মিলিয়ন জাতিগত উইঘুর মুসলমানের কমপক্ষে এক মিলিয়ন মানুষকে ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারের নামে বন্দিশালায় আটক করে রাখা হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের প্রতিটি শহর, বন্দর ও গ্রামের শতকরা ৪০ ভাগ ধর্মীয় স্থাপনা (মসজিদ, মাজার, পাঠাগার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান) পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান উইকলির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- গবেষকরা বিশ্বাস করেন, জিনজিয়াং প্রদেশে হাজার হাজার মসজিদ বুলডোজার দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে একজন প্রতিবেদক কুমুলের পূর্বাঞ্চল পরিদর্শন করে দেখতে পান, সেখানে ৮০০ মসজিদের মধ্যে ২০০টি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
ঘ. বাবরি মসজিদ : ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্র্রষ্টা প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর ১৫২৮ সালে উত্তর ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এই মসজিদে নামাজ আদায় করে আসছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে মূলত হিন্দু অধ্যুষিত দেশ হিসেবে ভারত জন্ম লাভের পর ১৯৪৯ সালেই এই মসজিদের অভ্যন্তরে হিন্দুরা দেবতা রামের মূর্তি স্থাপন ছাড়াও এই মসজিদ রামের জন্মস্থান ও রামমন্দিরের স্থানে নির্মাণ করা হয়েছিল বলে দাবি করে। পরে ১৯৮৬ সালে ভারত সরকার ওই মসজিদে মুসলমানদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সাধারণ হিন্দুদের প্রবেশের অনুমোদন দেয়। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ভারতীয় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক, মসজিদটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে ফেলে। এতে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ (প্রধানত মুসলমান) প্রাণ হারান। এটিকে কেন্দ্র করে বর্তমান ভারত সরকারের কার্যকলাপ আরো সাম্প্রদায়িক, আরো অমানবিক হয়ে ওঠে। গত ৯ নভেম্বর, ২০১৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত চূড়ান্ত রায়ের মাধ্যমে বাবরি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের ওপর রামমন্দির নির্মাণের আদেশ দেন। এই রায়ে মসজিদ ভাঙায় অংশগ্রহণকারীদের ব্যাপারে কোনো কিছু না বলে ধ্বংসাত্মক ওই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে আদালতের মাধ্যমে সমর্থন করা হয়েছে। বিচারকরা স্পষ্টত হিন্দু ধর্মবিশ্বাসের ওপর ভর করেই রায় দিয়েছেন বলে উচ্চারণ করেছেন। ওই বিতর্কিত বিশ্বাসের কাছে সাক্ষ্য-প্রমাণ পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করেছে। বিচারকদের কাছে ওই স্থানটিতে রামের জন্মস্থান ও রামমন্দিরের অস্তিত্বে¡র কোনো প্রতœতাত্ত্বিক ও ইতিহাসভিত্তিক সত্যের প্রমাণ নেই। অতি সম্প্রতি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেসি শর্মা ওলি দাবি করেছেন, রাম নেপালের রাজপুত্র ছিলেন এবং অযোধ্যা হলো নেপালের বীরগঞ্জের পশ্চিমের একটি গ্রাম। ওই গ্রামেই রাম জন্মেছিলেন। তার মতে, সীতা এবং রাম দু’জনেই ছিলেন নেপালি।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় রয়েছে যেখানে মুসলমানদের, তাদের মসজিদের ওপর ও অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনার ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। তখন আমরা বিশ্ব মোড়লদেরকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর আঘাত করা হচ্ছে’ বলে বিলাপ করতে দেখিনি। বরং মনে মনে তারা খুশিই হয়েছেন বলে মনে হয়েছে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৯৩ সালে লাখেরাজ সম্পত্তি জবরদখল করে একদিনে এক লাখ মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছিল এই উপমহাদেশে। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ফার্দিনান্দ রাজা ও রানী ইসাবেলা স্পেনের মুসলমানদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করে শত শত মসজিদকে গির্জায় পরিণত করেছিলেন। হাজারো মুসলমানকে মসজিদে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে তাতে আগুন ধরিয়ে হত্যা করা হয়। সোভিয়েত রাশিয়ায় ৭০ বছরের সমাজতান্ত্রিক শাসনের নামে শত শত মসজিদ বন্ধ করে সেগুলোতে সিনেমা হল, থিয়েটার বা জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছিল। নিকট অতীতে বসনিয়ায় মুসলিম জাতিগত নিধনের প্রক্রিয়া এখনো পাশ্চাত্যের দ্বারা মানবাধিকার ছিনতাই করার ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ১৯৯৫ সালের ১১ জুলাই বসনিয়ার সেব্রেনিকায় জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যে ডাচ ব্যাটালিয়নের সৈন্যদের তত্ত্বাবধানে সার্বীয় বাহিনী অবাধে গণহত্যা চালিয়ে ৮ হাজার ৩৭২ জন মুসলমানকে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং পিএইচডি গবেষক
E-mail: maksud2648@yahoo.com