দখল নয়, আয়া সুফিয়া কিনে নিয়েছিলেন সুলতান
আয়া সুফিয়া, ইনসেটে সুলতান দ্বিতীয় মোহাম্মদ - ছবি : সংগৃহীত
গত ১০ জুলাই তুরস্কের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক ‘আয়া সোফিয়া’কে পুনরায় মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের আদেশ দিয়েছেন। তুরস্কের বেশির ভাগ মানুষ এতে সন্তোষ প্রকাশ করলেও পশ্চিমা বিশ্বে তা সমালোচিত হয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এই আদেশ কার্যকর করা তুরস্কের সার্বভৌম অধিকার এবং এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে জানিয়েছেন। ২৪ জুলাই জুমার নামাজ আদায়ের মাধ্যমে এই আদেশ কার্যকর হবে বলে তুরস্কের ধর্ম সম্পর্কিত পরিচালকের দফতর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল আগেই। গ্রিস, যুক্তরাজ্য, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ইত্যাদি দেশ তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ‘মানবাধিকার ও ধর্মনিরপেক্ষতার অভিভাবক’ হিসেবে। সর্বোচ্চ ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস দুঃখ প্রকাশ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের এই প্রতিক্রিয়ার যৌক্তিক, নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি ইতিহাসের আয়নায় আলোচনা করা দরকার।
গোড়ার কথা : বাইজেন্টাইন শাসক প্রথম কন্স্টানটাইন ৩২৫ সালে একটি পৌত্তলিক মন্দিরের ভিতের ওপর গির্জা নির্মাণের আদেশ দেন। পরে দ্বিতীয় কন্স্টানটাইন ৩৬০ সালে ‘আয়া সোফিয়া’ নামক অর্থোডক্স গির্জা উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে অর্থোডক্স এবং ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে ৪০৪ সালে প্রথম ‘আয়া সোফিয়া’ ধ্বংস হয়। রাজা থিওডোসিয়াস-২ দ্বিতীয় ‘আয়া সোফিয়া’ ৪০৫ সালে উদ্বোধন করেছিলেন। এটি ৫৩২ সালে পুনরায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সম্রাট জাস্টিনিয়ান ২৬ ডিসেম্বর ৫৩৭ সালে তৃতীয় ‘আয়া সোফিয়া’ উদ্বোধন করেন। ১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় ‘আয়া সোফিয়া’ লুটের শিকার হয়েছিল। ওই ক্রুসেডে খ্রিষ্টান ক্যাথলিকরা কন্স্টানটিনোপল জয় করে ‘আয়া সোফিয়া’কে ক্যাথলিক গির্জায় পরিণত করে। ১২৬১ সালে অর্থোডক্স খ্রিষ্টানরা ক্যাথলিকদের পরাজিত করে পুনরায় এটিকে অর্থোডক্স গির্জায় রূপান্তরিত করে।
মুসলমানদের গির্জা ক্রয় : অটোমান সুলতান মেহমেত-২ বা দ্বিতীয় মোহাম্মদ ১৪৫৩ সালে কন্স্টানটিনোপল জয় করেন যার বর্তমান নাম ইস্তাম্বুল। জয় করার পর তিনি যাজকদের কাছে আয়া সোফিয়া বিক্রি করার জন্য আবেদন জানান। যাজকরা রাজি হলে তিনি ব্যক্তিগত অর্থের বিনিময়ে গির্জাটি ক্রয় করে নেন। এরপর সুলতান মেহমেত আয়া সোফিয়ার কোনো ক্ষতি না করে এর সৌন্দর্য বহুগুণে বৃদ্ধি করেন এবং এতে মিনার ও মিম্বার সংযোজন করেন। তিনি এর ভেতরে অবস্থিত খ্রিষ্টানদের উপাসনার ছবিগুলো সম্মানে ঢেকে রাখেন, সেগুলো বর্তমানেও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। সেই সাথে গির্জাটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করে এতে মহান আল্লাহর ইবাদত করার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। পরে মহামতি সোলায়মান আয়া সোফিয়াতে ঝর্ণা, ক্যালিগ্রাফিক রাউন্ডেলস, পাঠাগার ইত্যাদি স্থাপন করে এটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলেন। এভাবে প্রায় ৫০০ বছর মুসলমানরা ‘আয়া সোফিয়া’কে সসম্মানে প্রার্থনার স্থান হিসেবে ব্যবহার করে আসছিলেন। কিন্তু ১৯৩৪ সালে তুরস্কের শাসক কামাল আতাতুর্ক উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতার আবরণে এই মসজিদটিকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। এভাবে প্রায় ৫০০ বছর ধরে চলে আসা একটি সম্মানিত স্থাপনাকে অসম্মানিত করা হয়েছিল। পরে ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটাকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্থাপনা বলে ঘোষণা দেয়। এমতাবস্থায় ২০০৫ সালে তুরস্কের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন আতাতুর্কের জাদুঘর করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। কারণ, সুলতান মেহমেত স্থাপনাটি ব্যক্তিগত অর্থে ক্রয় করে মসজিদের জন্য ওয়াকফ্ বা দান করেছিলেন। আদালত ২০০৮ সালে মামলাটি খারিজ করে দেন। বাদিপক্ষ পুনরায় আদালতের শরণাপন্ন হলে ২০২০ সালের ১০ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত আলোচিত রায় ঘোষণা করেন।
লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং পিএইচডি গবেষক
E-mail: maksud2648@yahoo.com