ভারতকে কি ম্যাসেজ দিলো চীন?
মোদি ও শি - ছবি : সংগৃহীত
এখন ভারতের থিঙ্কট্যাঙ্ক জাতীয় বিদ্বানের কিভাবে চীনের বিরুদ্ধে খোঁচাখুঁচি লাগানো যায় তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্কবিতর্কে তাদের দিন যাচ্ছে। এতে সবচেয়ে উপরের জনপ্রিয় আলাপটা হলো, চীনের একচীন নীতি বা তিব্বত বা হংকং নীতি ভারত ভাঙলে চীন কেমন শায়েস্তা হবে- এই হলো তাদের আলোচনার ফল। অর্থাৎ এদেরকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো ট্রট বা আচরণ করা বা মর্যাদা দেয়া। কিন্তু এতে প্রধান ভায়োলেশনটা হবে, চীন যেকোনো দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক পাতানোর পূর্বশর্ত হলো- এগুলো কোনো স্বাধীন ভূমি নয়, চীনেরই অংশ বলে গণ্য করতে রাজি হতে হবে। অর্থাৎ এই বিদ্বানেরা বলতে চাইছেন; তারা মোদির ভারতকে পরামর্শ দিচ্ছেন- মোদি যেন চীনের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কিন্তু এত দূর পরিণতি কী তারা মেপে কথা বলছেন? আমরা নিশ্চিত নই।
যাই হোক, উপরে ভারতের চীনা রাষ্ট্রদূতের কথা বলছিলাম। তিনি ওই আলাপে এ প্রসঙ্গগুলো নিজে এনে পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকা বোঝাবুঝি রেখে কাজ করতে বলেছেন। ভদ্র ও বক্তব্য নরম রাখতে বলেছেন। উভয় পক্ষেরই উচিত হবে পরিস্থিতি সম্পর্কে উভয় পক্ষ (মানে চীনা পক্ষও) যেন ভালো আর পুরো বোঝাবুঝি করে এরপর পদক্ষেপ নেয়। তবে সীমান্ত নিয়ে তিনি কিছু সোঝা ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেটির প্রসঙ্গে বলেই আজকের লেখা শেষ করব।
কথাগুলো অনেকটা দুষ্ট সন্তানকে সামলাতে মায়েরা অনেক সময় শর্ত দিয়ে কথা বলেন। বলেন যে, পায়েস তিনি আজ রেঁধেছেন, তুলেও রেখেছেন বাটিতে। কিন্তু শান্ত ও বুঝমান সন্তানের মতো আচরণ যারা করবে তারাই কেবল ওই পায়েসের বাটির হকদার হবে। ঠিক সে কথা মনে রাখলে আমরা চীনের পদক্ষেপগুলোর অর্থ বুঝতে পারব।
চীনের সাথে ভারতের এবারের সঙ্ঘাত মূলত লাদাখ অঞ্চলে। কিন্তু এখানেই কেন? কারণ ভারত গত বছর ৫ আগস্ট এই লাদাখেরই স্ট্যাটাস বদলিয়েছে। কেন? ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মির ভারতেরই অঙ্গীভূত করে নেয়ার সময়। এতে বিজেপির হাতে পড়ে কাশ্মির মোদির কাছে জাস্ট একটা হিন্দু পোলারাইজেশন ঘটিয়ে ভোট পাওয়ার ইস্যু। যাতে মোদি ব্যাপারটাকে ‘হিন্দুজাতির বীরত্ব’ হিসেবে দেখিয়ে আরো বেশি ভোট পেতে পারেন। এতে কাশ্মিরিদের কী হবে অথবা পড়শিদের কাছে কী ম্যাসেজ যাবে এ নিয়ে তিনি পুরো বেপরোয়া থাকবেন।
যেমন ম্যাসেজ কী গেছে?
চীন-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬২ সালে। ওই যুদ্ধের আগে ও পরে লাদাখ অঞ্চলের বহু অংশই চীন দখলে নিয়ে নিয়েছিল। পরে আস্তে আস্তে সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে শুরু করলে ১৯৯৩-৯৬ ভারতের জন্য ছিল খুবই নির্ধারক। এ সময়কালেই লম্বা সময় ধরে আলোচনা চলেছিল। পুরনো ১৯৫৮-৬০ সালের সেই এলএসি দেখিয়ে চীন যেসব ভূখণ্ড দাবি করত সেসব দাবির বড় বড় অংশ ১৯৯৩-৯৬ সালের আলাপের সময় (যেটি চীনা ভাষায় শান্ত ও প্রশান্তির কামনা ও আকাক্সক্ষায় দুই দেশের সীমান্ত আলাপে এগিয়ে আসা ছিল) চীন ভারতকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু গত বছর কাশ্মির ও লাদাখের স্ট্যাটাস মোদির খেয়ালি একক ইচ্ছায় বদলানো এটা ওই ১৯৯৩-৯৬ আলোচনার সময়ে তৈরি হওয়া যে পারস্পরিক বোঝাবুঝি তা পুরো উপেক্ষা ও ভেঙে ফেলা হয়েছে বলেই চীন এখন ১৯৫৮-৬০ সালের দাবির এলএসি ধারণাতে ফিরে গেছে। তাই চীন এখানে পরামর্শে ও ইঙ্গিতে বোঝাতে চায় যে, ভারত যদি ফের শান্তি চায় আর যেসব বিষয়ে পারস্পরিক বোঝাবুঝিতে সম্পর্কের অনেক অগ্রগতি হয়েছিল তা ফিরিয়ে আনে, তবেই একমাত্র চীন ১৯৯৩-৯৬ সালের এলএসিতে আবার ফিরে যাবে। ভারতকে ভূখণ্ড ছাড় আবার দেবে। আর যদি উল্টা ভারত আমেরিকার কোলে গিয়ে উঠে আর এক-চীন নীতি ভাঙাসহ নানা হুমকি দিতে থাকে তবে সীমান্ত ১৯৫৮-৬০ সালেরটাই বহাল থাকবে। শান্তি চাওয়া সৎ প্রতিবেশী হলে একরকম আর উল্টাটা হলে আরেক রকম।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com