ভয়াবহ ফ্লপ মোদির কাশ্মির ‘মাস্টার স্ট্রোক’
ভয়াবহ ফ্লপ মোদির কাশ্মির ‘মাস্টার স্ট্রোক’ - সংগৃহীত
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা ও রাজ্য মর্যাদা বাতিল করে একে দুটি ইউনিয়ন ভূখ-ে বিভক্ত করে। ‘ওয়ান ইয়ার ইন ডিসঅ্যাপেয়ার্ড স্টেট’ নামের এই সিরিজে দি ওয়্যার গত বছর কী বোঝানো হয়েছিল এবং ওই অঞ্চল এখন কেমন দেখাচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করবে।
ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের কাশ্মির ‘মাস্টার স্ট্রোক’ প্রদানের এক বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। আরা ‘গ্রেটেস্ট হিটের’ মতো- নোট বাতিলকরণ, পণ্য ও পরিষেবা কর, লাহোরে ক্রিসমাস ডে অবতরণ, কোডিভ-১৯ ধ্বংসের জন্য রাত ৯টায় ৯ মিনিটের আলোকসজ্জার পরিকল্পনার মতো কাশ্মিরও ফ্লপ করেছে, অবশ্য যদি একে বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করা না হয়।
এটা ঠিক যে জঙ্গি নেতারা নির্মূল হয়ে গেছে, গণবিক্ষোভ আর পাথর নিক্ষেপ প্রতিরোধ করা হয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সত্যিকার অর্থে সহিংসতা হ্রাস পায়নি। সাউথ এশিয়া টেরিরিজম পোর্টালের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, সহিংসতা হ্রাস পেয়েছিল এই দশকের শুরুতে, ২০১২ সালে সর্বনি¤œ অবস্থায় ছিল। ওই সময় বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিল ১৯ জন, নিরাপত্তা সদস্য ১৮ জন ও সন্ত্রাসী/চরমপন্থী নিহত হয়েছিল ৮৪ জন। কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম আট মাসে বেসামরিক নাগরিক ১৭ জন, নিরাপত্তা সদস্য ৩৪ জন ও সন্ত্রাসী/চরমপন্থী নিহত হয়েছে ১৫৪ জন।
এই রাজ্যে সহিংসতা অব্যাহত থাকার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করা সুবিধাজনক। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে ৫ আগস্টের সিদ্ধান্তের ফলে বিচ্ছিন্নতাকামী জঙ্গিদেও মধ্যে স্থানীয় রিক্রুট বেড়েছে। পাকিস্তান যদি কিছু করে থাকে তবে তা হলো অপেক্ষার খেলা খেলে যাওয়া।
কাশ্মিরে যা কিছু ঘটছে, সেটাকে রাজনৈক বর্বরতা ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে বর্ণনা করা কঠিন। ইউনিয়নের অধীনে খুবই কঠিন ও বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে থাকা একটি রাজ্যকে প্রশ্নবোধক আইনিপ্রক্রিয়ায় মর্যাদা খর্ব করা ও টুকরা করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালত এখনো সাড়া দেয়নি। জে অ্যান্ড কে রিঅর্গ্যানাইজেশন অ্যাক্ট, বিভিন্ন নেতাকে আটক করা, ৪জি সার্ভিস প্রত্যাহার করার মতো বিষয়ে আদালতের রায়ের অপেক্ষা করছে সবাই।
কেন এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল তার কোনো জবাব এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যেটা বলা হচ্ছে, তা হলো বিজেপির প্রতিষ্ঠাকালীন মতাদর্শই ছিল অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল। কিন্তু তাই বলে রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে একে কেন্দ্রীয় এলাকা ঘোষণা? এটি কি পুরোপুরি শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নয়? এমনকি বিজেপিপন্থী রাজনীতিবিদ সাজ্জাদ লোন, বিজেপির সাবেক রাজনৈতিক মিত্র মেহবুবা মুফতি ও আবদুল্লাহর মতো রাজনীতিবিদ, যারা চরম কঠিন পরিস্থিতিতেও সেখানে ভারতের পতাকা উড়িয়েছেন, তাদেরকেও বন্দী করা হয়েছে। মাত্র একটি কঠোর সিদ্ধান্তে কাশ্মিরের পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপটকে শত্রু ঘোষণা করা হয়েছে।
আর সবকিছুই হয়েছে রাজ্যটির জনসাধারণের সাথে কোনো ধরনের, কোনো ফোরামেই নয়, আলোচনা না করেই। দিল্লির নিযুক্ত গভর্নরকে রাজ্যেও ৭৫ লাখ লোকের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হাস্যকর ব্যাপার।
নির্বাহী ও বিচার বিভাগ একসাথে মিলে জনসাধারণকে কিভাবে তাদের গণতান্ত্রিক ও অধিকার ও প্রক্রিয়া অনুসরণে বাধা দিয়ে থাকে, তার সর্বশেষ উদাহরণ হলো রাজস্থান। একদিকে আপনার গভর্নর নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভাকে আহ্বান করতে বাধা দিচ্চে, অন্য দিকে দলত্যাগবিরোধী আইন বাস্তবায়নে বাধা দিতে কাজ করছে আপনার বিচার বিভাগ।
তাহলে কেন মোদি এই মাস্টার স্ট্রোকের সিদ্ধান্ত নিলেন? একমাত্র জবাব হলো সংকীর্ণ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল। সন্ত্রাসবাদের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ সব সূচকেরই দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ২০০০-এর দশক থেকেই হ্রাস পাচ্ছে। পাকিস্তানের সাথেও এর কোনো সম্পর্ক নেই। রাজ্যের ওপর পাকিস্তানের প্রভাবও হ্রাস পাচ্ছে।
কিন্তু এর মূল্য কত? এক বছর ধরে পুরো রাজ্যকে কারাগার বানিয়ে রাখা হয়েছে। তাদেরকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, যোগাযোগের আধুনিক উপায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দেয়া হচ্ছে না। বাস্তবে বিক্ষোভ সংযত থাকার কারণ হলো পুরো রাজ্যকে বৃহৎ একটি কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। কাশ্মিরে যা ঘটছে তাতে চীনের জিনজিয়াং নীতির নির্মম সুরই প্রতিফলিত হচ্ছে।
সেখানে সেনাবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতি এখনো রয়েছে। গত আগস্ট থেকে তাদের উপস্থিতি বাড়ানো হয়েছে। মিডিয়া কাজ করছে সেন্সরশিপে, ১৯৯০-এর দশকের প্রথম দিকের চেয়েও কঠিন আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে।
১৯৫০-এর দশক থেকেই অনুচ্ছেদ ৩৭০ ভীতিকর জিনিস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সময়ের পরিক্রমায় নানা রাষ্ট্রপতির নির্দেশ জারি করে এর কার্যকারিতা হ্রাস করা হয়েছিল। এই প্রক্রিয়ায় জম্মু ও কাশ্মির ভারতের সাথে প্রায় মিশেই গিয়েছিল। কিন্তু বিজেপি এটাকে তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তাদের বৈরী নীতির আলোকেই। আর যেসব নীতি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, তার লক্ষ্য রাজ্যের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধ্বংস করা না গেলেও যাতে হ্রাস করা যায়।
অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা একটি নির্মম কৌতুক। অবশ্য এখন সহজেই কোভিড-১৯-এর কথা বলা যায়। বিভিন্ন কোম্পানি উপত্যকায় বিনিয়োগ করার জন্য প্রতিযোগিতা করছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা অলীক কল্পনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে কাশ্মিরে কেউ বিনিয়োগ করবে না, করোনাভাইরাস থাকুক বা না থাকুক।
কাশ্মিরের পুরো রাজনৈতিক শ্রেণীকে একদিকে ঠেলে দেয়ার ফলে সরকারের সামনে এখন নির্যাতন অব্যাহত রাখা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নতুন মাত্রার রাজনৈতিক ধারা নির্মাণের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। বাস্তবতা হলো আমরা উপত্যকায় একটি ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠী পেয়েছি।
যতই অন্তসারশূন্য হোক না কেন, কাশ্মিরিরা অনুচ্ছেদ ৩৭০ দিয়ে কিছু সান্ত¦না পেত। ভারতে বিশেষ মর্যাদা পাওয়া বিশেষ কিছু নয়। উত্তর-পূর্ব এলাকার অনেক রাজ্য অনুচ্ছেদ ৩৭১-এর আওতায় বিশেষ মর্যাদা পেয়ে থাকে।
সত্যিকার অর্থে, এই ইস্যু হলো ভারতের আদর্শবিষয়ক। একদিকে রয়েছে জনগণকে তাদের অনন্যতার আত্মমর্যাদাকে উৎসাহিত করে দেশের বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়া, অন্যদিকে আছে সব পার্থক্য শক্তি প্রয়োগ করে সোজা করে একক হিন্দু ভাষাভাষী হিন্দুত্ববাদী জাতি গড়া যেখানে থাকবে এক ইতিহাস, এক সংস্কৃতি ও এক নেতা যা চায় বিজেপি।
দি ওয়্যার