ইসরাইলের ছায়াযুদ্ধ
ইসরাইলের ছায়াযুদ্ধ - সংগৃহীত
ইসরাইল ১৯৭৩ সালের আরবদের সাথে সর্বশেষ যুদ্ধের পর প্রত্যক্ষ যুদ্ধের চেয়েও প্রক্সি বা ছায়া যুদ্ধকে কৌশল হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেয়। এ জন্য আরব দেশসমূহের মধ্যে পারস্পরিক সঙ্ঘাত লাগিয়ে রাখা এবং শক্তিমান দেশগুলোকে দুর্বল করার প্রচেষ্টাকে দেশটির ঘোষিত ইনোন কৌশলের একটি অংশ করে নেয়া হয়। এর ধারাবাহিকতায় ইসরাইল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে কিছু দেশের বৈরিতাকে নিষ্ক্রিয় করার কৌশল গ্রহণ করে। আবার কিছু রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের সামনে হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়।
চলতি দশকের শুরুর দিকের আরব জাগরণ এবং এর পরবর্তী গৃহযুদ্ধ ও আন্তঃরাষ্ট্র সঙ্ঘাতের পেছনে এই কৌশলের প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হয়। এই সঙ্ঘাতে সিরিয়া ও কুর্দি ইস্যুতে তুরস্ক সম্পৃক্ত হয়ে পড়লেও তাতে দেশটির সক্ষমতায় বড় কোনো আঘাত করা সম্ভব হয়নি। এমনকি সর্বশেষ ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার ফলে তুরস্ককে আঞ্চলিকভাবে নিষ্ক্রিয় করার আরো একটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর পর লিবিয়ার ইস্যুটি সামনে আসার পর অরেকবার প্রক্সিযুদ্ধে তুরস্ককে জড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে। যার সাথে আরব দেশগুলোকে সরাসরি সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
ইসরাইলের সামনে আরেক শক্তিধর প্রতিপক্ষ হলো পাকিস্তান। দু’টি দেশ প্রায় কাছাকাছি সময়ে স্বাধীনতা লাভ করে। ইসরাইল গঠিত হওয়ার পর প্রথম সংসদেই ভাষণ দেয়ার সময় তদানীন্তন ইসলাইলি প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, ইসরাইলের এক নাম্বার শত্রু কিন্তু কোনো আরব দেশ নয়, এক নাম্বার শত্রু হলো পাকিস্তান। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পর এ ধারণা ইসরাইলের নীতিনির্ধারকদের ওপর আরো গভীরভাবে ভর করে। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান বিভক্তির প্রস্তাব নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সাথে ইসরাইলের নেতাদের গোপনভাবে কাজ শুরু করার কথা এখন পুরনো অনেক তথ্যে প্রকাশ হচ্ছে।
দু’টি দেশই ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। যদিও তাদের মধ্যে কোনো কূটনৈতিক বন্ধন নেই। মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান ইসরাইলকে কখনো রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করেনি। বহিঃবিশ্বের কাছে ইসরাইল ও পাকিস্তান পরস্পর শত্রু দেশ হিসেবে পরিচিত। ‘দি এশিয়ান এজ’-এর সাংবাদিক আদ্রেয়ান লেভি ও ক্যাথরিন স্কট ক্লার্কের বইয়ে বলা হয় যে, ইসরাইল ১৯৮০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের গুজরাটের জামনগর বিমানঘাঁটি ব্যবহার করে পাকিস্তানের কাহুতা নিউক্লিয়ার স্থাপনায় হামলা চালাতে চেয়েছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিজেদের সীমানার খুব কাছে তিনটি দেশের এমন সম্ভাব্য পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় পরিকল্পনাটি রদ করে দেন।
’৮০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান দখলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত করা এবং এতে পাকিস্তানকে জড়ানোর মাধ্যমে দেশটির ওপর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা বোঝা চাপানো হয়। সর্বশেষ টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটোর অভিযানে তালেবান সরকারের পতন ঘটানোর মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম লক্ষ্যবস্তু ছিল। তালেবান পতনের পর নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের যে সরকার আফগানিস্তানে গঠিত হয় তার সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, বেসামরিক প্রশাসন- সবকিছুর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারতের বিশেষ প্রভাব সৃষ্টি হয়। আর এরপর পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তর্ঘাতী তৎপরতায় আফগান সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনকে নানাভাবে ব্যবহার করার তথ্য আসতে থাকে।
আফগানিস্তানে আমেরিকার অভিযান কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর এখন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে কাশ্মির ফ্রন্টকে। ঠিক এক বছর আগে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা ও স্বায়ত্তশাসনসংবলিত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর থেকে সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সাথে ইসরাইলের প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা বিভিন্ন বৈশ্বিক গণমাধ্যম সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে।
ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক নির্মাণে ইসরাইলের স্বার্থের একটি হলো তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষাসামগ্রী বিক্রি করা। আর দ্বিতীয়টি হলো ইসরাইলের কৌশলগত তিন শত্রুর একটি পাকিস্তানকে দুর্বল করা অথবা সম্ভব হলে আরো খণ্ড বিখণ্ড করা।