ইরানের দুই প্রতিপক্ষ

মাসুম খলিলী | Aug 04, 2020 10:32 pm
ইরানের দুই প্রতিপক্ষ

ইরানের দুই প্রতিপক্ষ - সংগৃহীত

 

ইসরাইলের কৌশলগত এই তিন প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার ব্যাপারে দেশটির প্রধান নীতি থাকে প্রক্সি তৈরি করে তাদের দিয়ে মোকাবেলা করা। এ ক্ষেত্রে ইরানের বিপ্লব রফতানি ও শিয়া মতাদর্শ প্রচারের সাথে সংশ্লিষ্ট বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডকে রাজতান্ত্রিক আরব দেশগুলোর সামনে নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়। ইসরাইলের নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য থাকে এক দিকে কোনোভাবেই ইরানকে প্রবল শক্তিমত্তা বা সক্ষমতা অর্জন করতে না দেয়া, আবার দেশটির অবস্থা যেন এমন নাজুক না হয় যাতে আরব প্রতিপক্ষগুলো দেশটিকে হুমকি ভাবতে না পারে। ইরানের প্রভাবকে ইরাক সিরিয়া হয়ে সৌদি সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া, অন্য দিকে ইয়েমেনের হুতিদের মাধ্যমে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি করা এ সব ইসরাইলের সার্বিক কৌশলের অংশ হিসেবে ঘটছে বলে অনেকের ধারণা।

ধারণা করা হয় যে, ইরানের কৌশলবিদদের সামনে দুই প্রধান শত্রুর একটি হলো ইসরাইল অন্যটি সৌদি রাজতন্ত্র। ইসরাইল ইরানি হুমকি মোকাবেলার জন্য সবসময় সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্র দেশগুলোকে সামনে নিয়ে আসে।

ইরানের ব্যাপারে ইসরাইলের যে কৌশল একই কৌশল কিছুটা ভিন্নভাবে তুরস্কের ওপরও প্রয়োগ করা হয়। ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি হিসেবে তুরস্কের সাথে ইসরাইলের বৈরিতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিছুটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশটির রাজনীতি ও ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করার যে কৌশল কয়েক দশক ধরে ইসরাইল অনুসরণ করে আসছিল সেটি এখন সেভাবে কাজ করছে না। এখন উসমানীয় খেলাফতের সময়কার কেন্দ্রীয় প্রশাসনের সাথে আরব জাতীয়তাবাদীদের সঙ্ঘাতের ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। আর আঙ্কারার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলের স্যাটেলাইট মুসলিম দেশ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিসরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তুরস্কের বৈরী প্রতিবেশী অন্য দেশকেও এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হচ্ছে।

২০২৩ বা ২০২৪ সালে লুজান চুক্তি শেষ হওয়ার পর তুরস্ক নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর যে প্রয়াস নিচ্ছে সেটিকে তুর্কি খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হিসাবে তুলে ধরে এসব দেশের সাথে তুর্কি শাসকদের শত্রুতা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও তুরস্কের ঘোষিত নীতির লক্ষ্য হলো বর্তমান রাষ্ট্রিক সীমানা বহাল রেখেই মুসলিম দেশগুলোর সাথে সহযোগিতা এবং সাধারণ শক্তি অর্জন ও সক্ষমতা সৃষ্টিতে সহায়তা করা। এ ক্ষেত্রে তুর্কি শাসকদের বক্তব্যে অতীত ঐতিহ্য জাগিয়ে তোলার প্রচেষ্টা থাকলেও অতীত মানচিত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনো হঠকারী বক্তব্য বা ইঙ্গিত কোনো সময় মেলে না।
এখন সর্বব্যাপী চাপের মধ্যে থাকা ইরান ও পাকিস্তান তুরস্কের সাথে মিলে একটি শক্তিমান বলয় তৈরির লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে বলে মনে হয়। এর মধ্যে পাকিস্তান ও তুরস্ক যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যের সাথে সরাসরি সঙ্ঘাতে না গিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নিয়ে রাষ্ট্রিক অখণ্ডতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে চাইছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক বৈরিতার মোকাবেলায় রাশিয়ার পাশাপাশি চীনের সাথে কৌশলগত অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করতে চাইছে ইরান।

যেভাবেই হোক না করোনাভাইরাসের আগের যে পৃথিবী ও বিশ্বব্যবস্থা ছিল সেটি করোনা-উত্তরকালে আর সেভাবে থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। এই সময়ের মধ্যে যে বড় ব্যবধান সেটি হলো ভারসাম্যের পরিবর্তে দুই প্রধান পক্ষের মধ্যে সরাসরি সঙ্ঘাত সৃষ্টি হওয়া। এই মেরুকরণে ইসরাইল ও ভারত সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বলয়ের সাথে চলে যাচ্ছে। কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে ভারতের যে সঙ্ঘাত সম্প্রতি দেখা দিয়েছে তাতে ভারতের পাশে তেলআবিবের একাত্ম ভূমিকা পালনের পাল্টা প্রতিক্রিয়াও এখন দেখা যাচ্ছে। এতে করে দীর্ঘকাল ধরে ইরানের সাথে ভারতের যে একধরনের কৌশলগত অংশীদারিত্ব ছিল তা ভেঙে পড়ছে। আর চীনের সাথে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও সামরিক অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ইরানের।
অন্য দিকে চীনের সাথে ইসরাইলের যে দীর্ঘ সময়ের বাণিজ্য ও বেসামরিক প্রযুক্তি বিনিময়ের অংশীদারিত্ব ছিল সেটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইসরাইলে চীনা কূটনীতিকের রহস্যজনক মৃত্যু, ভারতে চীনা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছিন্ন করতে সহযোগিতা প্রদান আর কাশ্মীরে চীনকে মোকাবেলায় দিল্লির প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিং পিংয়ের ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান আয়া সোফিয়ার পর একসময় আল আকসা জয়ের যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন তা অর্জনে এটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

সম্ভবত করোনা-উত্তর ২০২১ সালে চীন-রাশিয়া ও মিত্র বলয়ের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র শক্তির সর্বাত্মক যে স্বার্থ সঙ্ঘাত শুরু হতে যাচ্ছে তাতে ইসরাইল ও তার প্রতিপক্ষ তিন মুসলিম রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্র্ণ ভূমিকা থাকবে। সেই সঙ্ঘাতের আগে ও পরে এসব দেশের নিজস্ব সামরিক-বেসামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে লক্ষ্য অর্জনের কথা ওআইসি ও অন্যান্য মুসলিম ফোরামে উচ্চারিত হয়েছে তা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হবে। আর এ সময় ইসরাইলের মিত্র শক্তির বিপরীতে যে পাল্টা একটি মুসলিম শক্তির অভ্যুদয় ঘটছে সেটি হতে পারে মুসলিম জনগণের জন্য আশার গুরুত্বপূর্ণ বাতিঘর।

mrkmmb@gmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us