রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা ভারতের জন্য ক্ষতির কারণ হবে?
রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা ভারতের জন্য ক্ষতির কারণ হবে? - সংগৃহীত
হিমালয় অঞ্চল থেকে চীনকে সরাতে হিমশিম খাচ্ছে ভারত। অন্যদিকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ার ব্যাপকভাবে সৃষ্ট ধারণাও নাকচ করে দিয়েছেন। গত মাসের শেষ দিকে জয়শঙ্কও বলেছেন, ভারত কখনো কোনো জোটব্যবস্থার অংশ হবে না। তারপর তিনি বলেন, ভারত জোটের ঊর্ধ্বে ওঠা শিখেছে। আরো সাম্প্রতিক সময়ে তিনি বলেন, চীনের উচিত হবে না ভারতকে আমেরিকান লেন্স দিয়ে দেখা।
কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, জয়শঙ্করের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল চীনকে আশ্বস্ত করার জন্য। নয়া দিল্লির একটি ক্রমবর্ধমান লবি মনে করতে শুরু করেছে যে হিমালয় অঞ্চলে চীনের সাম্প্রতিক আগ্রাসী অবস্থানের অন্যতম কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের ক্রমাগত জোরালো সম্পর্ক।
তবে আরেকটি উপাদানও এখানে কাজ করছে। তা হলো রাশিয়া।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত তার ¯œায়ুযুদ্ধকালীন জড়তা কাটানোর চেষ্টা করছে এবং তা হচ্ছে ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকে পড়ার দিকে। চলতি বছরের জুন মাসের শেষ দিকে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং তিন দিনের সফরে মস্কো দিয়েছিলেন রাশিয়ার ভিক্টোরি ডে প্যারেডে অংশ নিতে। এরপর নয়া দিল্লি আরো আগ্রাসীভাবে মস্কোর অনুকূলে কথা বলতে শুরু করে। একপর্যায়ে রাািশয়ায় নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ইন্দো-প্যাসিফিকে রুশ অংশগ্রহণের আইডিয়াও উত্থাপন করেন।
রাশিয়ার সাথে ভারতের হৃদতাপূর্ণ সম্পর্ক চীনকে মোকাবেলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দৃঢ় অংশীদারিত্ব গড়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু নয়া দিল্লি অন্য হিসাব কষছে। একটি হলো, রাশিয়া হলো ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিরক্ষা অংশীদার, যদি রাশিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসুরী বিবেচনা করা হয়। দ্বিতীয় কারণ হলো, রুশ-চীন সম্পর্কে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে ভারত, এটা ১৯৭০-এর দশকে নিক্সনের সোভিয়েত-চীন ভাঙনের সাথে বৈসদৃশ্যপূর্ণ নয়।
কিন্তু দুটি দিক থেকেই ভারত মারাত্মক কৌশলগত ভুল করছে। প্রতিরক্ষা সম্পর্কের কথাই ধরা যাক। সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভারতের সাথে অংশীদারিত্ব গড়েছিল, তখন দেশটি ছিল তার সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে। ভারত এখন আর ওই অবস্থানে নেই। ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম প্রধান অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। ভারতের কাছে এখন অনেক বিকল্প আছে : উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যও। ২০১৫-১৯ সময়কালে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজারে রুশ হিস্যা ৭২ ভাগ থেকে নেমে ৫৬ ভাগ হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প বৈচিত্র্যমুখী হয়েছে।
তবে ভারতের বর্তমান অগ্রাধিকার কেবল অস্ত্র কেনার মধ্যেই সীমিত নেই। ভারত এখন নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও নির্মাণ করতে চাচ্ছে। ভারত কেবল কিছু সরঞ্জাম নির্মাণই করছে না, সেইসাথে বিদেশী গবেষকদেও সাথে অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করছে, ভারতের বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। গত বছর মস্কো সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই আকাক্সক্ষার কথা রুশদেরকে জানিয়েছিলেন।
তবে এ ধরনের সহযোগিতার জন্য প্রয়োজন বিপুল কৌশলগত যোগ্যতা। আর তা হলো নয়অ দিল্লির স্বার্থের হিসাব। ভারত যদি রুশ-চীন সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে পারে, তবে দুই দেশের মধ্যে আরো শক্তিশালী কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
¯œায়ুযুদ্ধেও সময় নিক্সন যখন চীন গিয়েছিলেন, তখন সোভিয়েত-চীন সম্পর্ক আদর্শগত প্রতিযোগিতার মধ্যে ভেঙে পড়েছিল। তবে চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়েই নিজেদেরকে বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্র রফতানির প্রধান দেশ হিসেবে বিবেচনা করছিল এবং বিবাদে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বিবাদেও সুযোগটি গ্রহণ করতে বেইজিং গিয়েছিলেন নিক্সন। কিন্তু এখন আর ওই অবস্থা নেই। চীন অবশ্য তার রাজনৈতিক মতাদর্শ রফতানি করার চেষ্টা করছে, প্রধানত আফ্রিকায়, কিন্তু এই ফ্রন্টে বেইজিংয়ের সাথে মস্কো প্রতিযোগিতা করছে, এমন কোনো প্রমাণ নেই। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ¯œায়ুযুদ্ধের সময়ের অবস্থানও নেই রাশিয়ার, তারা এখন আর তাদের রফতানি পণ্য হিসেবে সমাজতন্ত্রকে বিবেচনা করে না।
রাশিয়া ও চীন বর্তমানে তাদের নিজ নিজ প্রতিবেশী এলাকায় ভূখ-গত প্রভাব জাহির করার চেষ্টা করছে। তবে তাদের নিজ নিজ পরিম-ল সাধারণভাবে আলাদা। বেইজিংয়ের নজর পূর্ব, দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার দিকে। আর মস্কো মনোযোগী মোটামুটিভাবে পূর্ব ইউরোপে। তবে দুই দেশের একটি স্থানে মোকাবেলা হতে পারে। তা হলো মধ্য এশিয়া। এখানে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটি (বিআরআই) মস্কোর জন্য কিছু কষ্টের কারণ হতে পারে।
এই ছোটখাট বিষয় ছাড়া এমন কোনো নিশ্চিত মতপার্থক্য নেই, যার সুযোগ নিতে পারে ভারত। অন্যদিকে দুই দেশের মধ্যে অনেক বিষয়ে মিলও আছে। চীন ও রাশিয়া উভয়েই বিশ্ব পরিচালানায় পাশ্চাত্যের প্রভাব প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে, বিশেষ করে উভয়েই প্রপাগান্ডা ও নির্বাচনী হস্তক্ষেপের (গণতন্ত্রের মতো বিষয়ে এই ইস্যুতে ভারত হলো সহজাত প্রতিদ্বন্দ্বী) মাধ্যমে গণতান্ত্রিক আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করছে।
আবার চীনের অর্থনৈতিক শক্তি সম্পর্কেও রাশিয়া বাস্তববাদী আর চীনও রাশিয়ার অধিকতর উন্নত সামরিক উপস্থিতি, বিশেষ করে ইউরোপে, সম্পর্কে অবগত। আগামী বছরগুলোতে পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে চীন ও রাশিয়া তাদের অভিন্ন স্বার্থ হাসিলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরান ও সিরিয়ার মতো স্থানে তা দেখা গেছে।
চীনের সাথে যেকোনো সামরিক সঙ্ঘাতে ভারতকে সম্ভবত সমর্থন করবে না রাশিয়া। আর বেইজিং আপত্তি করলে মস্কো ভারতের স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্প বিকাশের সক্ষমতা অর্জনে সহায়তা থেকেও সরে আসতে পারে। নয়া দিল্লির জন্য ভালো হয় অন্যত্র, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলসহ অন্যান্য দেশের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। কৌশলগত স্বার্থের সাথে জোরালোভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ সক্ষমতা সৃষ্টিকারী অংশীদারিত্ব প্রয়োজন।
দি ডিপ্লোম্যাট