এক অভয়ারন্য আর চীন-ভারত নতুন সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র
এক অভয়ারন্য আর চীন-ভারত নতুন সঙ্ঘাতের ক্ষেত্র - ছবি : সংগৃহীত
প্রবাহিত বাতাসের উচ্চভূমি, বজ্র ড্রাগনের দেশ ভুটানে বিশ্বাস করা হয় যে, মিগোই (ভুটানের ভাষায় শক্তিশালী মানুষ) নামের একটি পৌরাণিক বানর-জাতীয় প্রাণী হিমালয় অঞ্চলের আলপাইন বন, নীল পাইন এবং রডোডেনড্রন বনাঞ্চলের মধ্যে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু এই নাদুস নুদুস আর লোমশ প্রাণীটি হয়তো আর নিজেদের মতো করে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বাস করতে পারবে না। মিগোই এখন ভুটানের দুই বড় প্রতিবেশী – উত্তরে চীন আর দক্ষিণে ভারতের মধ্যে বেড়ে ওঠা সীমান্ত সঙ্ঘাতের মাঝখানে আটকা পড়তে চলেছে।
ভুটানের সেকটাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য – যেটার উপর চীনও দাবি জানিয়েছে – সেই এলাকার ভেতর দিয়ে ভারতের সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব ভুটানকে একটা জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। সেকটাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের সাথে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত রয়েছে, যেটাকে চীন ভারতের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
ভারতের যেখানে হিমালয় অঞ্চলের সীমান্তে চীনকে মোকাবেলা করার জন্য সীমান্তে প্রয়োজনীয় সেনা সমাবেশের মতো যোগাযোগ অবকাঠামোর অভাব রয়েছে, সেখানে আসামের গোয়াহাটির সাথে অরুণাচল প্রদেশের তাওয়াংয়ের লুমলার যোগাযোগ স্থাপনের জন্য ভুটানের ত্রাশিগাং জেলার মধ্য দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণের আগ্রহ নতুন করে ব্যক্ত করেছে ভারত। ভুটানের ‘মোগোই দেশের’ মধ্য দিয়ে এই সড়কটি নির্মিত হলে সেটা শুধু ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বই কমাবে না, বরং গোয়াহাটি আর তাওয়াংয়ের মধ্যে যাতায়াতের সময়ও ৫ থেকে ৬ ঘন্টা কমিয়ে আনবে।
পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের ফরোয়ার্ড পোস্টগুলোকে সামরিক সরঞ্জাম ও সেনাদের মোতায়েনের জন্য সীমান্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থাকে জোরদার করার গতি বাড়াচ্ছে ভারত। ভারতের আগের সরকারগুলো পূর্ব সীমান্তে সংযোগ বাড়ানোর যে সব পরিকল্পনা নিয়েছিল, সেগুলো গত ছয় বছর ধরে কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। কিন্তু এখন চীন হিমালয় অঞ্চলে তাদের তৎপরতা বাড়ানোর কারণে ভারতের বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকার এই কাজের গতি বাড়িয়েছে। ভারত এখন ভুটানের সাথে ক্রস-বর্ডার লিঙ্ক রোড তৈরি করছে।
কিন্তু এটা নিয়ে চীনা সেনাদের সাথে সঙ্ঘাত লেগেছে। প্রথম সঙ্ঘাত লাগে ২০১৭ সালে যখন দোকলাম মালভূমিতে চীনের সব মওসুমের উপযোগী সড়ক নির্মাণ নিয়ে আপত্তি জানায় ভারত। ভুটানের এই জায়গাটিতে ভারত আর চীন তখন মুখোমুখি হয়েছিল। ৭৫ দিনের ওই অচলাস্থা ভুটানকে ভূরাজনৈতিক সঙ্ঘাতের মধ্যে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।
চলতি বছরের মে মাসে ভারত-নেপাল-চীনের ত্রিদেশীয় সংযোগ পয়েন্টের লিম্পিয়াধুরা-লিপুলেখ-কালাপানি এলাকায় লিঙ্ক রোডড় নির্মাণের কারণে ভারত আর নেপালের মধ্যে শত্রুতামূলক সঙ্ঘাত বেড়ে গেছে। এই বিবাদকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বড় ধরণের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক বিবাদ তৈরি হয়েছে, যদিও দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক বহু শতকের পুরনো। ৩৭০ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী বিস্তৃত ওই তিনটি এলাকাকে নিজেদের অংশ হিসেবে দাবি করে নেপাল। ভারত কৌশলগত লিপুলেখ পর্বত গিরিপথের নিয়ন্ত্রণ করে, যেটার মাধ্যমে ভারতের ঝাড়খাণ্ড রাজ্যের সাথে চীনের তিব্বত সংযুক্ত হয়েছে।
১৯ জুন নেপালের পার্লামেন্ট সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র গ্রহণ করেছে, যেখানে বিতর্কিত তিনটি এলাকাকে নেপালের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছে। নেপালের নতুন মানচিত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেপালে এবং নেপাল-ভারত সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
জুন মাসে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারত আর চীনের মধ্যে সঙ্ঘাত হয়েছে এবং এর ফলে সেখানে যথেষ্ট রক্তপাতও হয়েছে। এই অচলাবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রচেষ্টা এখনও চলছে।
চীন-ভারত সঙ্ঘাত সত্বেও দুই দেশের সাথেই ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে ভুটান। তবে, চীনের অন্য চিন্তা রয়েছে। গালওয়ান অচলাবস্থা চলাকালে, কাউন্সিল অব দ্য গ্লোবাল এনভারনমেন্ট ফ্যাসিলিটি’র ৫৮তম বৈঠকে চীনা প্রতিনিধি দল অপ্রত্যাশিতভাবে পুরো সেকটাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যকে ভুটানের নিজেদের সীমানার মধ্যে রাখার বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানায়। চীন দাবি করে যে, এটা একটা ‘বিতর্কিত এলাকা’। এই বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়নের বিষয়েও আপত্তি জানায় চীন।
চীন বিষয়ক পর্যবেক্ষক ও কৌশলগত বিশ্লেষক, কলকাতা-ভিত্তিক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশান্স অ্যাণ্ড ডেভলপমেন্টের (সিএসআইআরডি) ডিরেক্টার বিনোদ কুমার মিশ্র বলেন, “সেকটাং হোক বা গালওয়ান উপত্যকা হোক, যেখানেই ভারত সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা চীনের দিক থেকে সামরিক ও কূটনৈতিক বিরোধিতা উসকে দিয়েছে”।
থিম্পু আর বেইজিং যদিও ১৯৮৪ সাল থেকে সীমান্ত আলোচনা চালিয়ে আসছে, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে কোন আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। বেইজিংয়ের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য থিম্পুকে নয়াদিল্লীর পরোক্ষ অনুমতি নিতে হবে, কারণ এখনো ভুটানের উপর দিল্লীর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে।
আরেকটি সমস্যা রয়েছে ভুটানের। তাদের আশঙ্কা হলো ভারতের বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশান যে সড়ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে, সেটা সেকটাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের জীববৈচিত্রের ক্ষতি করতে পারে।
বেইজিং এই এলাকা ও আশেপাশের জায়গার উপর নিজেদের দাবির কথা জানিয়েছে এবং এর স্পষ্ট উদ্দেশ্য হলো থিম্পুকে চাপ দেয়া, যাতে তারা বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্যের ভেতর দিয়ে ভারতের সড়ক নির্মাণের প্রস্তাবে রাজি না হয়। ১৯৮৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে চীন ও ভুটান ২৪ দফা সীমান্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছে।
বিনোদ মিশ্র এসএএমকে বলেন, “আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়ার সামর্থ চীনের রয়েছে, তাই তারা আগে থেকে এটার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে”। তিনি আরও বলেন, বেইজিং চেষ্টা করছে যাতে ভুটান ভারতের বলয় থেকে বেরিয়ে আসে।
সেকটাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থানগুলোর অংশ এবং সাধারণভাবে ধারণা করা হয় যে, দুর্লভ মিগোয় এখানে বাস করে। বহু শতাব্দি ধরে হিমালয় অঞ্চলের আখ্যানের সাথে এই প্রাণীর নাম জড়িয়ে আছে। তাছাড়া নির্জনতাপ্রিয় ব্রোকপারাও বাস করে এখানে। এই ব্রোকপারা হলো আধা-যাযাবর বুনো-গাই পালনকারী একটা উপজাতীয় গোষ্ঠি।
এই যুগে এসে অধিকাংশ ভুটানিজ যখন সাইবার জগতের মাধ্যমে বাইরের জগতের সামনে নিজেদের উন্মুক্ত করে দিয়েছে, ব্রোকপারা তখনও বিপরীত দিকেই চলছে। তারা এখনো বুনো মিগোয়কে ভয় পায়। সময়ের একটা জায়গায় এসে তারা যেন জমে গেছে কারণ তারা এখনো তাদের পূর্বসূরীদের বহু পুরনো রীতি নীতি মেনে চলে এবং তাদের উপর বাইরের প্রভাব তেমন পড়েনি বললেই চলে।
ভুটানে যে ৪৬ প্রজাতির রডোডেনড্রন (বিশেষ প্রজাতির ফুল) রয়েছে, এর মধ্যে ৩৫টি প্রজাতিই রয়েছে এই অভয়ারণ্যে এবং এই জঙ্গলকে তাই ‘রডোডেনড্রনের স্বর্গ’ বলা হয়।
মিশ্র বলেন, চীনা পদক্ষেপের কারণে সেকটাং বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের জন্য আন্তর্জাতিক অর্থায়ন বন্ধ হয়ে গেলে ভুটানের জন্য সেটা বিভিন্নভাবে ক্ষতির কারণ হবে। মিশ্র আরও বলেন, “এটা ভুটানের শান্তিপূর্ণ সীমান্তকে অশান্ত করে তুলবে… তাদের পরিবেশ-বান্ধব টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য যে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন দরকার, সেটা সীমিত হয়ে আসবে এবং এটা মোটেই কাম্য নয়”।
ভুটানে চীনের কোমল-শক্তির সূচনা
আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলেও ভুটানে কোমল শক্তি বাড়ানোর প্রচেষ্টা শুরু করেছে চীন এবং সাম্প্রতিককালে এর মাত্রা বেড়েছে। ভুটানে ভারতের সামরিক উপস্থিতি নিয়ে বিশেষ করে ভুটানের নতুন প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে এবং তারা এটাকে ‘রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর’ এবং ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ মনে করে।
কোভিড-১৯ এর নিষেধাজ্ঞার আগে ভুটানে বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে শীর্ষে ছিল (ভারত ছাড়া) চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটকরা। ভুটানে চীনের কোমল শক্তি বৃদ্ধি প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে রয়েছে ভুটানের শিক্ষার্থীদের চীনে উচ্চশিক্ষার জন্য স্কলারশিপ দেয়া, বিশেষ করে চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলবিদ্যায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এটা দেয়া হচ্ছে।
স্থলবেষ্টিত বৌদ্ধ প্রধান এই দেশটিতে কিছুকাল আগেও রাজতন্ত্র ছিল। বহু দশক ধরে দেশটি তাদের দুই শক্তিধর বড় প্রতিবেশীর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে এসেছে। কিন্তু আজ, তরুণ ভুটানিজদের মধ্যে একটি বড় অংশ আরও ভালো সুযোগ সুবিধা অর্জনের জন্য চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পক্ষে। আবার একই সাথে তারা উদ্বিগ্ন কারণ ভারত তাদের ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে।
ভুটানের যে অভয়ারণ্যের উপর চীনের দাবি রয়েছে, তার ভেতর দিয়ে ভারতের সড়ক নির্মাণের কি প্রভাব পড়বে ভুটানের ভূ-রাজনৈতিক চিন্তায়, সেটা দেখার জন্য এখনো অপেক্ষা করতে হবে।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর