হজ-কোরবানি ঐতিহাসিক তথ্য
হজ-কোরবানি ঐতিহাসিক তথ্য - ছবি : সংগৃহীত
মুসলিম উম্মার আদি পিতা ইবরাহিম (আ:)-এর জীবন ছিল পরীক্ষা সঙ্কুল। সারা জীবনই তিনি আল্লাহ কর্তৃক অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হন এবং সব পরীক্ষায় অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এসব পরীক্ষায় পাসের কারণে আল্লাহ তাকে বিরল সম্মানে ভূষিত করে উপাধি দেন খলিল বা একনিষ্ট বন্ধু। যে হজ ও কোরবানি নিয়ে আমাদের উৎসাহের শেষ নেই তা ইবরাহিম (আ:)-এর পরীক্ষারই সুফল।
হজরত ইবরাহিম (আ:)-এর বয়স যখন ৮৬ বছর তখন তিনি একদিন মোরাকাবায় বসে আল্লাহ তায়ালার কাছে একটি পুত্রসন্তান চাইলেন। আল্লাহ তার প্রার্থনা কবুল করলেন এবং তাকে পুত্রসন্তান দান করলেনÑ সেই পুত্রের নাম ইসমাইল (আ:)। আল্লাহপাক কালামে বলেছেন, ‘অতঃপর আমিও তাকে (ইবরাহিমকে) একটি ধৈর্যশীল ছেলে দান করার, সুসংবাদ শুনিয়ে দিলাম (সূরা সা-ফফা-১০১)।
বিভিন্ন তাফসিরকারের মতে ছেলেটির বয়স যখন আনুমানিক ১৩ বছর তখন নবী ইবরাহিম (আ:) স্বপ্নে আদেশ প্রাপ্ত হন যে আল্লাহতায়াল হুকুম করছেনÑ তুমি তোমার প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে আল্লাহ রাহে কোরবানি করো।
এই স্বপ্ন ইবরাহিম (আ:) পরপর তিনরাত দেখলেন। প্রথম স্বপ্ন দেখেন জিল হজ মাসের ৮ তারিখ রাতে। তার পর ৯ তারিখ রাতে তিনি ওই স্বপ্ন আবার দেখলেন। প্রথম দিন স্বপ্ন দেখার পর নবী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চিন্তামগ্ন থাকেন এই জন্য যে এটা আল্লার তরফ থেকে সুস্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন। ৯ তারিখ তিনি বুঝতে পারেন এবং জানতে পারেন যে এটা স্বপ্ন। জিল হজ মাসের দশম রাতে তিনি আবার ওই স্বপ্ন দেখেন।
পরপর তিন রাত স্বপ্ন দেখার পর তার মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে ওই দিনটিকে বিশেষ নামে চিহ্নিত করা হয়। যেমনÑ অষ্টম দিনকে বলা হয় ‘ইয়াওমুত তারভিয়াহ’ বা চিন্তাভাবনার দিন। নবম দিনকে বলা হয় ‘ইয়াওমুল আরাফাহ’ বা জানার দিন। এবং দশম দিনের নামকরণ করা হয় ‘ইয়াওমুন নাহার’ বা কোরবানির দিন।
দশম দিন স্বপ্ন দেখার পর নবী ইবরাহিম (আ:) স্বীয় পুত্রকে আল্লার নামে কোরবানি করার জন্য মনিস্থর করলেন। বিবি হাজেরাকে বললেন, ইসমাইলকে হাতমুখ ধুইয়ে ভালো কাপড় পরিয়ে দিতে। ওকে একটা কাজে নিয়ে যাবেন।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যখন এরকম কথাবর্তা হচ্ছিল তখন শয়তান ভাবলোÑ আজ যদি তাদের ফেতনায় না ফেলতে পারি তাহলে আর কোনো দিন পারব না। পিতাপুত্র যখন ঘর থেকে বের হলেনÑ শয়তান এসে হাজির হলো হাজেরার কাছে। সে জানতে চাইলÑ তোমার ছেলেকে ইবরাহিম কোথায় নিয়ে গেলেন? হাজরা উত্তর করলেনÑ কোনো কাজে নিয়ে গেলেন। শয়তান তখন বললÑ এটা ঠিক নাÑ ইবরাহিম তাকে জবেহ করতে নিয়ে গেছেন।
হাজেরা জানতে চাইলেনÑ তিনি তাঁর ছেলেকে জবেহ করবেন কেন? শয়তান বললÑ ইবরাহিম মনে করেন যে, তাঁর রব তাঁকে এই কাজের আদেশ দিয়েছেন। হাজেরা বললেনÑ তিনি তাঁর প্রভুর আদেশ পালন করে ভালো কাজ করেছেন।
শয়তান দেখল এখানে কাজ হলো নাÑ সে পিছু নিলো পিতাপুত্রের। কিন্তু তাঁদের কাছেও শয়তান সুবিধা করতে পারল না- পরাস্ত হয়ে ফিরে গেল।
এবার পিতা পুত্রকে জানালেনÑ কেন তিনি তাঁকে মিনার বিজন প্রান্তরে নিয়ে এসেছেন। ইবরাহিম (আ:) বললেন- হে প্রিয় পুত্র, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে আমি আল্লার নামে জবেহ করছি। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? ছেলেটি বলল, আব্বা! আপনি তাই করুন যা আপনাকে হুকুম দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন। (সূরা সাফফাত, আয়াত-১০২)
ইসমাইল তাঁর আব্বাকে বললেন- আব্বা, আপনি নিজের কাপড় সামলে নিন এবং আমাকে ভালো করে বেঁধে দিন। যাতে আমার রক্তের ছিটা আপনার গায়ে না লাগে। জবেহের পর আপনি যখন আমার মায়ের কাছে যাবেন তখন তাঁকে আমার সালাম দেবেন। আর আমার জামাটা নিয়ে যাবেন আম্মাকে দেবেন। যাতে তিনি কিছুটা সান্ত¡না পান।
ইবরাহিম নবী ছেলের মুখে এ কথা শুনে বললেনÑ ‘বাবা! আল্লার হুকুম পালনার্থে আমার কী উত্তম সাহায্যকারী তুমি।’
অতঃপর ছেলের কপালে চুমু খেয়ে ছলছল চোখে তাঁকে বেঁধে ফেললেন। পবিত্র কুরআনে আছেÑ ইবরাহিম তাঁকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। জনমানবহীন মিনা প্রান্তরে ঘটে চলল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ৯৯ বছরের বৃদ্ধ পিতা ১৩ বছর বয়স্ক পুত্রের গলায় ছুরি চালালেন আল্লার হুকুম পালনার্থে।
কিন্তু বিধাতার লীলা বোঝা ভার। ইবরাহিম নবী ছুরি চালিয়েও কাটতে পারলেন না ইসমাইলের গলা। কারণ কি? তিনি তো আল্লাহর হুকুম পালনেই ব্রতী হয়েছেন। আসলে আল্লাহ ছুরিকে নির্দেশ দিয়েছেন সে যেন ইসমাইলের গলা না কাটে। বেহেশত থেকে পাঠিয়ে দিয়েছেন দুম্বা। ইসমাইলের পরিবর্তে জবেহ হয়ে গেল দুম্বা। ঈমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার গৌরবে আল্লাহ ইবরাহিম (আ:) কে পুরস্কার হিসেবে ফিরিয়ে দিলেন পুত্র ইসমাইলকে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন- হে ইবরাহিম! তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্য করে দেখিয়েছ। আমি এবাবে (পরীক্ষার মাধ্যমে) নেক ও সৎ লোকদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিঃসন্দেহে এটাও একটা বিরাট পরীক্ষা। তাই আমি এক বিরাট কোরবানির বদলে তাঁকে (অর্থাৎ তোমার ছেলে ইসমাইলকে) বাঁচিয়ে দিয়েছি। (সূরা সা-ফফাত-আয়াত ১০৪-৭)
এটি প্রেরিত হয়েছিল জিব্রাইল (আ:)-এর মাধ্যমে।
জিব্রাইল এই অভূতপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করে আল্লার প্রতি কৃতজ্ঞতায় উচ্চারণ করেছিলেনÑ আল্লাহু আকবারÑ আল্লাহু আকবার।
বালক ইসমাইলও কোরবানি হওয়ার সময় বলেছিলেনÑ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ আল্লাহু আকবার। ইবরাহিম (আ:) পুত্রের গলায় ছুরি চালানোর সময়ও আল্লাহর প্রশংসায় উচ্চারণ করেন- আল্লাহু আকবার অলিল্লাহিল হামদ।
আল্লাহর অপার করুণায় এই তাকবিরটিকে সুন্নতে পরিণত করে একে চিরস্থায়ী করেন। শুধু তা-ই নয়- নবী ইবরাহিম (আ:) ও তাঁর জীবনব্যাপী নানা পরীক্ষার ফলস্বরূপ আল্লাহ কুরআনের আয়াতে বর্ণনা করলেন) ‘আমি তোমার এই সুমহান আদর্শকে পরবর্র্তীদের জন্য চিরস্মরণীয় করে রাখলাম। তোমার এসব কীর্তির দরুণ তোমার প্রতি আমার রহমত ও শান্তিধারা বর্ষিত হোক। (সূরাÑসা-ফফাতÑ আয়াত-৮)
মহান আল্লাহর ঘোষণার পর থেকে আজ অবধি চলে আসছে ইবরাহিমের স্মৃতি পালনের তার আদর্শ বাস্তবায়নের আন্তরিক প্রচেষ্টা।
দেখা যাচ্ছে শুধু কোরবানি নয়, হজের অন্যান্য অনুসঙ্গও হজরত ইবরাহিম (আ:) এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের কার্যকরণ থেকেই যোগ হয়েছে। সাফা-মারওয়া সায়িকরা, শয়তানকে পাথর মারা হজের অন্যতম অনুসঙ্গ স্মরণ করিয়ে দেয় বিবি হাজেরার শিশুপুত্রের মুখে পানি তুলে দেয়ার জন্য সাতবার সাফা-মারওয়ায় দৌড়ানোর স্মৃতি। শয়তান তিনবার ইবরাহিম (আ:) কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল- প্রতিবারই ইবরাহিম (আ:) সাতটি করে কঙ্কর নিক্ষেপ করেছিলেন- আজো হাজী সাহেবানেরা শয়তানকে বিতাড়িত করতে পাথর নিক্ষেপ করেন।
যে পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে ইবরাহিম (আ:) বায়তুল্লাহ বা আল্লার ঘর কাবা শরিফ সংস্কার করেছিলেন, সেই পাথরে তাঁর পায়ের ছাপ রয়েছে। সেখানে বর্তমানে স্বর্ণনির্মিত পায়ের ছাপ রাখা আছে। এই স্থানকে বলা হয় মাকামে ইবরাহিম এবং হজ করতে গেলে ওখানে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হয়। জমজমের শীতল পানি পান করার সময় যখন আমরা এই দোয়া পাঠ করি- হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে ফলপ্রসূ এলম, সচ্ছল জীবিকা এবং সব রোগের নিরাময় কামনা করছি তখন কি পিপাসার্ত শিশু ইসমাইলের কথা মনে না পড়ে পারে? তাঁর কথা মতোই পিতা ইবরাহিম তাঁকে বেঁধে ছিলেন জবেহের আগে। এখনো কোরবানির গরুকে জবেহের আগে কষে বাঁধা হয়।