কোরবানি কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল

ড. মোহাম্মদ আতীকুর রহমান | Jul 31, 2020 01:53 pm
কোরবানি কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল

কোরবানি কিছু গুরুত্বপূর্ণ মাসায়েল - ছবি : নয়া দিগন্ত

 

 

স্বীয় কামনা-বাসনা, ব্যক্তিসত্তা, কষ্টার্জিত সম্পদ ও প্রাণাধিক প্রিয় বস্তুকে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টির সামনে সমর্পণের উদাত্ত আহ্বান নিয়ে কোরবানির ঈদ আমাদের সামনে উপস্থিত। কোরবানি এক দিকে যেমন ত্যাগের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর ত্যাগদীপ্ত সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস আমাদের স্মৃতিপটে জাগিয়ে দেয়, তেমনি প্রতিটি মুমিন অন্তরকে ঈমানি চেতনায় করে তোলে উজ্জীবিত।

কোরবানি কী : কোরবানি শব্দের অর্থ উৎসর্গ ও নৈকট্য অর্জন। শরিয়তের পরিভাষায় জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে নির্দিষ্ট নিয়ম ও সময়ে, নির্দিষ্ট জন্তুকে মহান আল্লাহর অধিক সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে জবাই করাকে কোরবানি বলা হয়। কোরবানি আদায় করা বিত্তবানদের ওপর ওয়াজিব। তবে দরিদ্র ব্যক্তিও ইচ্ছা করলে কোরবানি আদায় করে ছাওয়াব অর্জন করতে পারেন।

কোরবানির ফজিলত :

কোরবানির ফজিলত সীমাহীন। মহানবী সা: বলেছেন, ‘কোরবানির সময় আল্লাহর নিকট কোরবানির চেয়ে অধিক প্রিয় আর কোনো জিনিস নেই। কোরবানির সময় কোরবানিই সবচেয়ে বড় ইবাদত। কোরবানি জবাই করার সময় প্রথম যে রক্তের ফোঁটা পড়ে, তা মাটি পর্যন্ত পৌঁছার আগেই কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়।’

মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘কোরবানির জানোয়ারের যত পশম থাকে প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে এক একটি নেকি লেখা হয়।’ অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমরা মোটা ও তাজা জন্তুর দ্বারা কোরবানি করো, কারণ এটা পোলসেরাতে তোমাদের সাথী হবে।’

যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব :

১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজের সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কোনো ব্যক্তি যদি মালিকে নিসাব (সাড়ে বায়ান্ন ভরি রূপা কিংবা সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা কিছু স্বর্ণ, কিছু রূপা এবং কিছু নগদ অর্থÑ সব মিলিয়ে যদি সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমান হয়, এরূপ সম্পদের অধিকারী) হয়, তবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। স্ত্রী ও বালেগ পুত্র, বালেগা কন্যা ধনী হলে তাদের নিজ থেকেই কোরবানি করা ওয়াজিব। কিন্তু নাবালেগ পুত্র, নাবালেগ কন্যা ধনী হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে না। স্বামী যদি স্ত্রীর প থেকে তার অনুমতিক্রমে কোরবানি আদায় করে, তা হলে স্ত্রীর ওয়াজিব আদায় হয়ে যাবে। মুসাফিরের ওপর মুসাফিরি অবস্থায় কোরবানি ওয়াজিব হবে না।

কোরবানির সময়সীমা :

১০ জিলহজের ফজর থেকে ১২ জিলহজের সূর্য অস্ত যাওয়ার আগেই কোরবানি আদায় করতে হবে। এই তিন দিনের যে দিন ইচ্ছা সে দিনই কোরবানি করা যেতে পারে। তবে ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা ঠিক নয়। অবশ্য যে স্থানে ঈদের নামাজ ও জুমার নামাজ আদায় হয় না, সে স্থানে ১০ জিলহজ ফজরের পরও কোরবানি করা যেতে পারে। রাতের বেলা বা অন্ধকার স্থানে কোরবানি না করাই উত্তম।

কোরবানির পশু :

বকরি, পাঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা, গাভী, ষাড়, বলদ, মহিষ, উট এই কয় প্রকার জন্তুর দ্বারা কোরবানি করা যাবে। হরিণ, বক ইত্যাদি হালাল বন্য জন্তুর দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। বকরি, পাঠা, খাসি, ভেড়া, দুম্বা পূর্ণ এক বছরের কম বয়সের হলে তা দ্বারা কোরবানি আদায় হবে না। তবে ছয় মাসের বেশি বয়সের দুম্বার বাচ্চা যদি মোটাতাজা হওয়ার কারণে এক বছরের বাচ্চার মতো মনে হয়, তবে তা দ্বারা কোরবানি করা বৈধ হবে। গরু, মহিষের বয়স কমপে দুই বছর এবং উটের বয়স পাঁচ বছর হতে হবে। কোরবানির পশু সুস্থ, সবল এবং দৃষ্টিনন্দন হতে হবে। অন্ধ, কানহীন জন্তু কিংবা একটি কান বা লেজের এক তৃতীয়াংশ বা তদপো বেশি কেটে গেছে, মূল থেকে ভেঙে যাওয়া শিংওয়ালা জন্তুর দ্বারা কোরবানি বৈধ হবে না। অনুরূপভাবে অতি কৃশকায়, দন্তহীন জানোয়ার, তিন পায়ে ভর দিয়ে চলা খোড়া জন্তু দ্বারা কোরবানি করা বৈধ হবে না। শিংহীন জন্তু বা শিং উঠেছে কিন্তু ভেঙে গেছে, খাসি বানিয়ে দেয়া জন্তু বা জন্তুর গায়ে বা কাঁধে অল্প দাদ বা খুজলি হয়েছে এরূপ জন্তু দ্বারা কোরবানি বৈধ। ভালো পশু ক্রয় করার পর যদি কোনো কারণে কোরবানি করার অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে তবে অন্য একটি পশু ক্রয় করে কোরবানি করতে হবে। মালিকে নিসাব না হলে তিনি সে পশু দ্বারাই কোরবানি করতে পারবেন।

কোরবানি কত নামে করা যাবে :

গরু, মহিষ ও উটের ক্ষেত্রে এক থেকে সাত নাম দেয়া যেতে পারে। অন্যান্য জন্তুর েেত্র এক নাম দেয়া যাবে। গরু, মহিষ ও উট ক্রয় করার আগে সাতজন ভাগীদার ঠিক করে নেয়া উত্তম। যদি কেউ ক্রয় পরবর্তী ভাগীদার পাওয়ার ইচ্ছায় একা গরু, মহিষ বা উট ক্রয় করে তবে তা বৈধ হবে। একা করার নিয়তে পশু ক্রয় করার পর পরবর্তীতে কাউকে ভাগীদার হিসেবে নিলে তা বৈধ হলেও উত্তম নয়। উল্লেখ্য, ক্রেতা গরিব হলে তিনি অন্যকে ভাগীদার হিসেবে নিতে পারবে না।

কোরবানিদাতাদের নিয়ত :

কোরবানি একমাত্র মহান আল্লাহর উদ্দেশ্যে হতে হবে। ভাগীদারদের কারো গোশত খাওয়ার নিয়ত থাকলে কোরবানি গ্রহণযোগ্য হবে না। কোরবানির েেত্র ভাগীদার থাকলে সবার ভাগ সমান হতে হবে। আন্দাজে ভাগ না করে পাল্লা দিয়ে মেপে সমান সমান ভাগ করতে হবে। কম-বেশি হলে কোরবানি হবে না। আকিকার নিয়তে কেউ ভাগীদার হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে।

কোরবানি কে করবেন :

নিজের কোরবানির পশু নিজ হাতেই জবাই করা মুস্তাহাব। নিজে অম হলে একজন অভিজ্ঞ আলেম দ্বারা কোরবানি করানো উচিত। এ সময় নিজে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো। মহিলাদের সামনে উপস্থিত না থাকাই উত্তম।

কোরবানি করার নিয়ম :

কোরবানির পশুকে কিবলামুখী করে শুইয়ে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করতে হবে। কোরবানি করার সময় মুখে নিয়ত করা ও দোয়া উচ্চারণ করা জরুরি নয়। স্মরণ থাকলে কোরবানির জন্য নির্ধারিত দোয়া পড়া যেতে পারে। ক্রয়কৃত জন্তুর বাচ্চা হলে ওই বাচ্চাকে কোরবানি করে গরিব মিসকিনকে দিয়ে দিতে হবে, নিজে খাওয়া যাবে না। বাচ্চাকে জবাই না করে গরিবকে দান করে দেয়া যেতে পারে।

হারিয়ে যাওয়া পশু :

কোরবানির জীব হারিয়ে গেলে তার পরিবর্তে অন্য পশু ক্রয় করার পর প্রথম পশুটি পাওয়া গেলে ক্রেতা মালিকে নিসাব হলে তার জন্য যেকোনো একটি কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। যদি মালিকে নিসাব না হয় তবে উভয়টি কোরবানি করা ওয়াজিব হবে। একটি কোরবানি করার পর অপরটি ১২ জিলহজের পর পাওয়া গেলে গরিব লোকটি সেই পশুটিকে সদকা করে দেবে।

গোশত খাওয়া ও বণ্টন :

কোরবানির পশুর গোশত পরিবার পরিজন ও আত্মীয়-স্বজন নিয়ে তৃপ্তিসহকারে খাওয়া যাবে। গোশত বণ্টনের মুস্তাহাব নিয়ম হচ্ছে- তিন ভাগ করে এক ভাগ গরিবদের, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও এক ভাগ নিজে রেখে দেয়া। নিজে বেশি অংশ রেখে গরিবদের সামান্য দান করলেও কোরবানি আদায় হয়ে যাবে।

কোরবানির চামড়া :

কোরবানির চামড়ার প্রকৃত হকদার হচ্ছে এতিম-মিসকিন তথা গরিবেরা। যদি কেউ তা বিক্রি করে তবে বিক্রিত অর্থ সম্পূর্ণ দান করে দিতে হবে। নিজের কাজে ব্যবহার করা যাবে না। পশু জবাইয়ের বিনিময় কিংবা বানানোর পারিশ্রমিক চামড়া বিক্রির পয়সা বা গোশত দিয়ে দেয়া যাবে না। মসজিদ নির্মাণ, মেরামত কিংবা অন্য কোনো নেক কাজে এই অর্থ দান করা যাবে না।

মৃত ব্যক্তির জন্য কোরবানি :

মৃত্যুর আগে কেউ কোরবানির জন্য অসিয়ত করে গেলে তার অংশের সব গোশত দান করে দেয়া ওয়াজিব। তবে স্বীয় ইচ্ছায় মৃতকে সওয়াব পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে কোরবানি করা হলে ওই অংশের গোশত ইচ্ছা অনুযায়ী খেতে ও দান করতে পারবেন। কোরবানির যে বিধান শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে মোতাবেক কোরবানি করা জরুরি।

লেখক : গবেষক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us