এরদোগানের রাজনীতি

মাসুম খলিলী | Jul 28, 2020 07:50 pm
এরদোগানের রাজনীতি

এরদোগানের রাজনীতি - ছবি : সংগৃহীত

 

ইস্তাম্বুলের বহুলালোচিত স্থাপনা আয়া সোফিয়াকে ৮৬ বছর পর আবার মসজিদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ায় তুরস্ককে নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনা অনেক বেড়েছে। আয়া সোফিয়া এমন এক সময় মসজিদ হিসেবে নামাজের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলো, যে সময়টাতে তুরস্ক দেশটির বাইরে সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের পর বিজয়ী পাশ্চাত্য মিত্র শক্তি অধীনতামূলক ধরনের চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে তুর্কি খেলাফতের অবসান ঘটায়। একই সাথে তুরস্কের মানচিত্রকে খণ্ডিত করে একবারে ছোট করে ফেলা হয়। পুরো তুর্কি ভূখণ্ডকে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়ার বিরুদ্ধে তুর্কি সেনারা প্রতিরোধ যুদ্ধ করে স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। তবে ১৯২৩ সালে সুজারল্যান্ডের লুজানে স্বাক্ষরিত চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের বিকাশ ও সমৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টাকে শৃঙ্খলিত করে ফেলা হয়।

কী ছিল লুজান চুক্তিতে?
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তকারী চূড়ান্ত চুক্তি হিসেবে পরিচিত ১৯২৩ সালের লুজান চুক্তিতে একদিকে অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি তুরস্কের প্রতিনিধিরা এবং অন্য দিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, গ্রিস, রোমানিয়া এবং যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিরা ছিলেন। সাত মাসের সম্মেলনের পরে ১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজানে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে তুরস্কের আধুনিক রাষ্ট্রের সীমানার স্বীকৃতি দেয়া হয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, তুরস্ক তার আগের আরব প্রদেশগুলোর ওপর কোনো দাবি জানাবে না এবং সাইপ্রাসে ব্রিটিশদের দখল এবং ডডেকানিজের ওপর ইতালীয় অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে। অন্য দিকে মিত্ররা তাদের তুরস্কের কুর্দিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি পরিত্যাগ করবে। সাথে সাথে তুরস্ক আর্মেনিয়ার স্বত্ব ত্যাগ করবে। আর তুরস্কের ওপর প্রভাব বিস্তার করার দাবি ত্যাগ করবে মিত্র শক্তি এবং তুরস্কের আর্থিক বা সশস্ত্র বাহিনীর ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ চাপাবে না। এজিয়ান সাগর এবং কৃষ্ণ সাগরের মধ্যে বসফরাস প্রণালীতে জাহাজ চলাচলে কোনো ফি নিতে পারবে না তুরস্ক।

এরপর কী হবে?
২০২৩ সালের মধ্যে লুসান চুক্তি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই চুক্তির অবসানের পর তুরস্ক কী পদক্ষেপ নেবে তা নিয়ে বিশ্ব ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলবিদদের মধ্যে নানা আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তুরস্ক কি অটোমান সাম্রাজ্যকে পুনরুত্থিত করতে চাইবে? এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক মানচিত্র পরিবর্তন হবে? তুরস্ক কি তার শক্ত ক্ষমতা ব্যবহার করে আঞ্চলিক আধিপত্য তৈরি করার মাধ্যমে নিজেকে আগের ভূমিকায় ফিরিয়ে আনবে? তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ২০২৩ সালের পরে বিপ্লবী কিছু ঘটতে চলেছে। তিনি উল্লেখ করেন, তুরস্ক ২০২৩ সালের লক্ষ্যে পৌঁছার পর পুরো অঞ্চলের ভবিষ্যৎকে নতুন অবয়ব দেবে। তুরস্ক এখন নতুন বিজয় ও সাফল্যের দোরগোড়ায়।

এরদোগান উল্লেখ করেন যে, ‘তুরস্কের বিরোধীরা’ ১৯২০ সালে ‘সেভের্স চুক্তি’ এবং ১৯২৩ সালে লুসান চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল। যার মাধ্যমে তুরস্ককে এজিয়ান সাগরের দ্বীপপুঞ্জ গ্রিসের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। এরদোগান বলেন, সেভের্সের সন্ধির মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের পেছনে প্রথম ছুরিকাঘাত করে তুরস্ককে তার অধীনে থাকা বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। তুরস্ককে সাইপ্রাস, লিবিয়া, মিসর, সুদান, ইরাক এবং সিরিয়ার উরফা, আদানা এবং গাজিয়ানটপ কেলস এবং মার্শ বাদে লেভান্টের বাকি অঞ্চলের ওপরে সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।

১৯১৪ সালের নভেম্বরে অটোমান সাম্রাজ্যকে মিসর ও সুদানের ওপর রাজনৈতিক ও আর্থিক অধিকার ত্যাগ করতে হয়। এর পরের সেভের্স ও লুজান চুক্তিকে তুর্কিরা কখনোই ভুলে যায়নি। লুজান চুক্তির আগে, ১৯২০ সালে ‘সেভের্সের সন্ধি’ সমাপ্ত করা হয়েছিল, যার আওতায় অটোমান সাম্রাজ্যের বেশির ভাগ অ-তুর্কি রাষ্ট্রকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। তবে তুর্কিরা এই চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে ১৯২২-১৯২৩ যুদ্ধের দুর্দান্ত জয় অর্জন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যায়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তুরস্কের প্রচেষ্টাগুলোতে এখন অধিক মনোযোগ দিতে শুরু করেছে, বিশেষত লুজান চুক্তির সমাপ্তির বিষয়ে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যেকোনো চুক্তি ১০০ বছর পরে শেষ হয়ে যায়। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ২০২৩ সালে এই চুক্তির মেয়াদের ওপর লক্ষ রাখছেন। উত্তরের ইরাকের মসুলের বর্তমান পরিস্থিতি এবং সিরিয়ার রাক্কা ও আফরিনের সাথে তুরস্ককে সংযুক্ত করার ভাবনা তার মধ্যে রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। লুজান চুক্তির আগে এই এলাকা সবসময় তুরস্কের সাথে সংযুক্ত ছিল।

২০২৩ সালে ১০০ বছরের পুরনো চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথে তুরস্ক নিজেই জ্বালানি অনুন্ধানের জন্য ব্যাপকভাবে মনোনিবেশ করবে বলে মনে হচ্ছে। এরদোগান ইঙ্গিত দিয়েছেন, তেল সরবরাহকারী জাহাজগুলো কৃষ্ণসাগর এবং মারমার সাগরের মধ্যে পারাপারে তুরস্ক একটি নতুন চ্যানেল খনন করে একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে। এখান থেকে আদায় করা ফি তুরস্কের অর্থনীতিতে নতুন সঞ্জিবনী যুক্ত করবে।

বিগত শতাব্দীতে, বিশেষত গত দশকে, তুরস্ক অঞ্চলটির মধ্যে কিছুটা প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। আঞ্চলিকভাবে প্রভাবের ক্ষেত্রে তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী এখন ইরান। আর ইসরাইল তার সামরিক শক্তির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। সিরিয়ার বিরোধে তুরস্ক সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। ‘অপারেশন ইউফ্রেটিস শিল্ড’ এবং তার ‘অপারেশন জলপাই শাখা’ এবং লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত জিএনএ সরকারকে সামরিক সহযোগিতা প্রদানে বিশেষ ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে দেশটি আবারো একটি আঞ্চলিক শক্তি হয়ে উঠেছে, যাকে এই অঞ্চলের সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক নেতা হিসেবে এক সময় গণ্য করা হতে পারে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us