২০২৩ সালে কী করবে তুরস্ক?
আয়া সোফিয়ায় স্ত্রীসহ এরদোগান - ছবি : সংগৃহীত
২০২৩ সালের মধ্যে তুরস্কের অর্জনের জন্য অনেক লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে অর্থনীতি, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্যসেবা, অবকাঠামো পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্র রয়েছে।
অর্থনীতি : ২০২৩ সাল নাগাদ শীর্ষ দশ বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম হয়ে ওঠার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে তুরস্কের। ২০১৪ সালের এক ট্রিলিয়ন ডলারের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনকে ২০২৩ সালের মধ্যে দুই ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় ২৫,০০০ ডলারে নিয়ে যাওয়া এবং ২০২৩ সালের মধ্যে তুরস্কের বার্ষিক রফতানি ৫০০ বিলিয়ন ডলারে বাড়ানোর লক্ষ রয়েছে। সেই সাথে ২০২৩ সালের মধ্যে বিদেশী বাণিজ্যের পরিমাণ এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীতকরণ ঠিক করা হয়েছে লক্ষ্যমাত্রায়।
এ ছাড়া ২০২৩ সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার দশ পয়েন্ট বাড়িয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যা তিন কোটিতে উন্নীত করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫ শতাংশে হ্রাস করা হবে। আর বসফরাস প্রণালী এবং ডারডানেলিসের মাধ্যমে সমুদ্র বাণিজ্যে শুল্ক প্রয়োগ করে বাড়তি আয়ের সংযোজন করা হবে। বায়ুভিত্তিক বিদ্যুতের ইনস্টল ক্ষমতা ২০,০০০ মেগাওয়াট এবং ভূ-তাপীয় শক্তির ইনস্টল ক্ষমতা ৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে। দক্ষতা উন্নতকরণের মাধ্যমে ২০১ স্তরের ২০ শতাংশের নিচে জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনা হবে। তিনটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হবে এবং এই প্লান্টগুলোর ইনস্টলড ক্ষমতা ১৪,৭০০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হবে।
পররাষ্ট্র নীতি : তুরস্কের বিদেশ-নীতির লক্ষ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে রয়েছে, প্রথমত, তুরস্ক ইইউ সদস্যপদ পাওয়ার সব শর্ত অর্জন করবে এবং ২০২৩ সালের মধ্যে ইইউর প্রভাবশালী একটি সদস্য দেশ হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে। দ্বিতীয়ত, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে আঞ্চলিক সংহতকরণে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। তৃতীয়ত, এটি আঞ্চলিক সঙ্ঘাত নিরসনে কার্যকর ভূমিকা নিতে চাইবে। চতুর্থত, এটি বৈশ্বিক অঙ্গনে সব ক্ষেত্রে জোরালোভাবে অংশ নেবে। পঞ্চমত, এটি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে একটি নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে এবং বিশ্বের শীর্ষ দশ বৃহত্তম অর্থনীতির একটিতে পরিণত হবে। এসব লক্ষ্য অর্জনে তুরস্ককে অবশ্যই প্রতিটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে হবে, বিশ্ব স্থিতিশীলতা সম্পর্কিত প্রতিটি বিষয়ে আগ্রহী হতে হবে এবং সে অনুযায়ী অবদান রাখতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা : স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে তুরস্কের নির্ধারিত লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে, স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থায় জনগণের ১০০ শতাংশ অংশগ্রহণ। প্রতি এক লাখ লোকের জন্য চিকিৎসকের সংখ্যা বর্তমান ১৭৫ থেকে বাড়িয়ে ২১০ জনে উন্নীতকরণ।
পরিবহন : বিবেচ্য সময়ের মধ্যে ১১ হাজার কিলোমিটার নতুন রেলপথ তৈরি করা হবে এবং উচ্চগতির ট্রেনের নেটওয়ার্ক প্রসারিত করা হবে। ১৫ হাজার কিলোমিটার বিভক্ত মহাসড়ক তৈরি করা হবে। বিশ্বের বৃহত্তম আকারের ১০টি বন্দর প্রতিষ্ঠা বা সম্প্রসারণ করা হবে। স্থানীয়ভাবে বিমান, মানুষ্যবিহীন ড্রোন এবং উপগ্রহ তৈরি করা হবে।
পর্যটন : তুরস্ককে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে, যেখানে পাঁচ কোটি পর্যটক আকৃষ্ট হবে এবং বছরে ৫০ বিলিয়ন আসবে পর্যটন খাত থেকে।
লক্ষের পথে কতটা এগিয়েছে তুরস্ক
আর তিন বছর পরই আসবে ২০২৩ সাল। এর মধ্যে নির্ধারিত লক্ষ অর্জনের পথে তুরস্ক অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে। প্রতিবেশী অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ, বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা এবং সর্বশেষ করোনা সংক্রমণের কারণে তুরস্কের অগ্রগতি বেশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেশটি নিজস্ব লক্ষ্য অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
তুরস্কের এক সময় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটার একটি ব্যাধি ছিল। গত দুই দশক ধরে সেই ব্যাধি থেকে দেশটি মুক্ত হয়েছে বলে মনে হয়। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ ধরনের প্রবণতা অনেকখানি কমে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। তুরস্ক দেশে এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পেরেছে যেখানে প্রকৃতই জনসমর্থনের প্রতিফলন ঘটে। ক্ষমতাসীন একেপির অধীনে হওয়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেশটির সবচেয়ে বড় তিন সিটির নির্বাচনে শাসক দল পরাজিত হয়েছে। দেশটির গণতন্ত্র চর্চা নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে নানা ধরনের সমলোচনা সত্ত্বেও সেখানে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের সাথে ধর্মনিরপেক্ষতার এক ধরনের সমন্বয় ঘটেছে। অনেকে তুর্কি শাসনব্যবস্থাকে ইসলামী মূল্যবোধ ও ধ্যানধারণা আর পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রের একটি সমন্বিত মডেল হিসেবে বিবেচনা করেন। মধ্যপ্রাচ্যের একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের এ অঞ্চলে তুরস্ককে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর পাশে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।
অনেক সমালোচক মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক উসমানীয় খেলাফতের পুরনো সাম্রাজ্যকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে। এই অভিযোগ এনে মধ্যপ্রাচ্যে মিসর, সৌদি আরব, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সমন্বয়ে একটি অক্ষও তৈরি করা হয়েছে; যার সাথে ইসরাইলের রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র।
এ কথা সত্যি যে, লুজান চুক্তির মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে তুরস্ককে সঙ্কুুচিত এক দেশে পরিণত করা হয়েছে। এমনকি মসুল ইদলিব আফরিন রাক্কার মতো তুর্কি ঐতিহ্যের শহরকে তুরস্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। লুজান চুক্তির অবসানের পর এসব এলাকাকে তুরস্ক তার মানচিত্রভুক্ত করতে পারে বলেও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেন। এজিয়ান সাগরের তুর্কি দ্বীপ যেগুলো গ্রিসকে স্থানান্তর করা হয়েছে সেগুলো আবার তুরস্ক নিজ নিয়ন্ত্রণে নিতে পারে বলে মনে করা হয়। সাইপ্রাসের ব্যাপারে তুরস্ক আবার আগ্রাসী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও মনে করা হয়।
এসব জল্পনা অনেকখানি তুরস্ক এবং এর প্রভাবকে তার সম্পূর্ণ ভূখণ্ডে আটকে রাখতে করা হয় বলে মনে হয়। এরদোগান সব সময় একজন স্বপ্নচারী রাষ্ট্রনায়ক হলেও তাকে অবাস্তব উচ্চাভিলাষী পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। তিনি এমন কোনো অপরিণামদর্শী নীতি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে মনে হয় না যাতে পুরো ইউরোপের সাথে তার শত্রুতা সৃষ্টি হয়। অথবা মধ্যপ্রাচ্যের জাতি রাষ্ট্রগুলোর মুখোমুখি হয়ে পড়েন তিনি। যদিও এরদোগান তার নীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে বেশ জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব এবং এই অঞ্চলের জনপ্রিয় আন্দোলন মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করে চলেন।
এরদোগানের পররাষ্ট্র কৌশল পর্যবেক্ষণে মনে হয় তিনি বিশ্ব শক্তিগুলোর সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে চলবেন। তিনি ন্যাটোর মধ্যে থেকেই রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করে চলছেন। চীনের সাথেও তার রয়েছে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক। তুর্কি রাষ্ট্রের অখণ্ডতা অগ্রগতি এবং বিদ্যমান রূপকল্পকে সামনে রেখে এগোতে পারলে অদূর ভবিষ্যতে তুরস্ক আবার পরিণত হতে পারে একটি অন্যতম বিশ্ব শক্তিতে। ২০২৩ সাল নিঃসন্দেহে এই ক্ষেত্রে একটি বিরাট মাইলফলক।
mrkmmb@gmail.com