দুঃস্বপ্ন কেন দেখে
দুঃস্বপ্ন - ছবি : সংগৃহীত
দুঃস্বপ্ন (Night Mares) : ঘুমের রেম (Rem) স্তরে মানুষে অনেক সময় আতঙ্কগ্রস্ত স্বপ্ন দেখে থাকে। এই সব স্বপ্নে মানুষ দেখে যে, কেউ তাকে আক্রমণ করছে অথবা সে উঁচু থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে বা ভয়ঙ্কর কোনো কিছু দেখছে। দুঃস্বপ্ন মানুষ স্বাভাবিকভাবে দেখে থাকতে পারে। সাধারণত অবদমিত চিন্তা এবং মস্তিষ্কের ভেতরের প্রচ্ছন্ন চিন্তার বিমূর্ত প্রকাশরূপে মানুষের দুঃস্বপ্ন দেখা কোনো রোগ নয়। অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ীভাবে ঘন ঘন দুঃস্বপ্ন দেখা মানসিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। যারা মদ পান বা নেশা করে অথবা বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজ করে থাকে তাদের ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি হয়। এ ছাড়া বেশ কিছু ওষুধ আছে যাতে মানুষ দুঃস্বপ্ন দেখতে পারে।
নিদ্রাকালীন চমকানো (Sleep start) : অনেকে আছে যারা ঘুমের মধ্যে হঠাৎ করে চমকানো এবং সাথে সাথে খিঁচুনি দিয়ে জেগে ওঠে। জেগে গেলে এই চমক বা খিঁচুনি আর থাকে না। এ ধরনের সমস্যা মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করলেও এটা কোনো রোগ বা রোগের লক্ষণ নয়। এ জন্য কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই।
নিদ্রাকালীন হাঁটা (Somnambulism) : অনেকের দেখা যায়, তারা ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করে। এমন কি সামনে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তা সরিয়ে দেয়া। যেমন- চেয়ার বা দরজা প্রভৃতি। অনেকের ক্ষেত্রে এ সময় চোখ খোলা থাকে কিন্তু মুখ ও চোখ অভিব্যক্তিহীন থাকে। তাদের চলন অনেকটা বিশৃঙ্খল অথবা সোজা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে একে নিশিডাক বা জিনে ধরা বলে। এ অবস্থা প্রায় ১০ মিনিট পর্যন্ত থাকে। এটা ননরেম স্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে হয়ে থাকে বলে সে কী ধরনের স্বপ্ন দেখছে তা স্বস্তি ফিরে পেলে কিছু মনে করতে পারে না।
এ ধরনের ঘটনা হয় রাতের প্রথমের দিকে। কিন্তু যারা বলে যে, স্বপ্ন দেখে বা স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে হাঁটছিল তাদেরটা ঘটে রেম স্তরে এবং তা রাতের শেষার্ধে। এ ধরনের নিশিডাক বা নিদ্রাকালীন হাঁটা শিশুদের মধ্যে বেশি হয়। যাদের বয়স ছয় থেকে ১২ তাদের বেশি হয়। এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো রোগ নয়, কিন্তু যখন এটা বড়দের মধ্যে দেখা যায় তখন তা কতগুলো কারণে হতে পারে। কারণগুলো হলো যারা গাঁজা, ফেনসিডিল, মদ প্রভৃতি নেশায় অভ্যস্ত। কিছু কিছু বিশেষ ধরনের ওষুধ খাওয়া। মস্তিষ্কের কোনো অসুবিধা বা অসুখ থাকলে। মৃগিরোগী শিশুদের ক্ষেত্রে এর থেকে সাবধানে থাকার জন্য রাতে তাদের রুমে কোনো ধারাল জিনিস রাখবেন না। বিছানা থেকে যাতে পড়ে না যায় এবং অন্য কোনোভাবে আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। দরজা শক্ত করে আটকিয়ে রাখবেন। শিশুরা বড় হয়ে গেলে এ রোগ আর থাকবে না। বড়দের ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা সৃষ্টিকারী কারণগুলোর যথাযথ চিকিৎসা করানো উচিত। ঝাড় ফুঁক ও তাবিজ কবজ করে কোনো উপকার তো হবে না বরং তাতে ভয় পেয়ে পরে মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হবে।
ঘুমের মধ্যে সংবেদী আক্রমণ (Sensory Paroxysm) : এতে হঠাৎ করে ঘুমের মধ্যে খুব জোরে আওয়াজ শোনা, তীব্র আলোর ঝলক দেখা এবং মনে হবে কেউ যেন তাকে মাটি থেকে উঁচুতে তুলে জোরে আছাড় মারতে যাচ্ছে। এ স্বপ্নে দেখার পর পরই ঘুম ভেঙে যায়। এটা বেশি হয় যেসব লোক দুর্বল ও যারা প্রচণ্ড মানসিক পরিশ্রম করেন তাদের মধ্যে। এটা তেমন কোনো রোগ নয়।
নিদ্রায় দমবন্ধ হয়ে যাওয়া (Sleep Area) : অনেকে বলে থাকেন ঘুমের মধ্যে তাদের দম আটকে যায়। এ ধরনের অবস্থাকে অনেকে ‘বোবায় ধরা’ বলে মনে করেন। এ ধরনের নিঃশ্বাস বন্ধ অবস্থা ১০ সেকেন্ড পর্যন্ত স্থায়ী থাকে। এক ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুমের মধ্যে প্রায় ৩০ বার পর্যন্ত এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে। বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটা আরো বেশি হতে পারে। এর কারণের উৎস হিসাবে একে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। শ্বাসনালী বদ্ধতা বা অবস্ট্রাকটিড স্লিপ এপনিয়া, কেন্দ্রীয় বা সেন্ট্রাল স্লিপ এপনিয়া, মিশ্র ধরনের এপনিয়া।
১. শ্বাসনালী বদ্ধতা ঘুম বা অবস্ট্রাকটিড স্লিপ এপনিয়া : এ ক্ষেত্রে শ্বাস প্রশ্বাস শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া সক্রিয় থাকে, এ জন্য রোগী শ্বাস নিতে পারলেও শ্বাসনালীর ওপরের দিকে কোনো কারণে কিছুক্ষণের জন্য বদ্ধতা সৃষ্টি হলে বায়ু ফুসফুসে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে রোগীর দমবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এটা অনেক কারণে হতে পারে। কোনো কারণে উপরের শ্বাসনালীর পেশির টানের কারণে তা চুপসে যায় এবং শ্বাস নেয়ার সময়ও তা পর্যাপ্ত খোলে না। গঠনগত কারণে ওপরের শ্বাস পথ সরু হয়ে যায়। বড় জিহ্বা, গলার সরু শ্বাসপথ, মেদাধিক্যতা, টনসিল বা এডিনয়েড ফুলে যাওয়া, গলার ক্যান্সার প্রভৃতি। ওপরের কারণের সাথে মদপান, ধূমপান, ঘুমের ওষুধ খাওয়া এবং দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুমানো যুক্ত হলে রাতকালীন শ্বাসবদ্ধতা বাড়িয়ে দেয়।
এ সব রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে এরা মধ্যবয়স্ক লোক, শরীরে প্রচুর মেদ আছে, উচ্চ রক্তচাপ আছে এবং দিনে বেশি ঘুমান। রোগী নিজে বলেন তাদের দিনে খুব বেশি ঘুম পায়, অবশ লাগে, সকালে ঘুম থেকে উঠলে একটা ঘুম ঘুম ভাব থাকে, মাথা ও ঘাড় ব্যথা করে, মাথা ঘোরায়, ওজন বাড়ছে, কোনো কাজে মনোযোগী হতে পারছে না এবং পুরুষত্বহীনতা দেখা দিয়েছে। তাদের শয্যাসঙ্গীরা বলে থাকে যে, রোগী রাতে খুব জোরেশোরে শব্দ করে নাক ডাকে, ঘুমের মধ্যে অস্থির হয়ে ঘেমে ওঠে, গোঙাতে থাকে এবং হাত পা ছোড়াছুড়ি করে।
তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যাবে প্রায়ই সব কিছু স্বাভাবিক। কারণ দিনে এগুলোর প্রকটতা থাকে না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কারণগুলোর লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। এ জন্য তাদের নাক, কান, গলা ও থাইরয়েড পরীক্ষা করা এবং উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ দেখা জরুরি।
চিকিৎসা : ওষুধ দিয়ে এর কোনো সাফল্যজনক চিকিৎসা সম্ভব নয়। এ জন্য রোগীর উচিত ওজন কমানো, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং নাক, কান, গলার কোনো অসুবিধা থাকলে তার চিকিৎসা করানো। মদ্যপান, ধূমপান ও অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়া বন্ধ করা। আধুনিককালে নাকের সার্বক্ষণিক বায়ু চাপ প্রয়োগ পদ্ধতি, মুখ ও চোয়ালে বিশেষ জিনিস আটকে রাতে ঘুমানো এবং গলার বিশেষ ধরনের প্লাস্টিক সার্জারি Uvulopalatopharyngo plasty (এখানে আলা জিহ্বার সাথে মুখের তালু ও গলার বিশেষ পদ্ধতি আটানো হয়)। অনেকে টনসিলেকটমি ও নাকের ডিএনএসের অপারেশন করতে উপদেশ দিয়ে থাকেন।