ইরান-চীন চুক্তিতে বেকায়দায় যুক্তরাষ্ট্র
ইরান-চীন চুক্তিতে বেকায়দায় যুক্তরাষ্ট্র - ছবি : সংগৃহীত
ইরানি সরকার চীনের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার ২৫ বছর মেয়াদি একটি খসড়া চুক্তি অনুমোদন করেছে বলে খবরে প্রকাশ। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আব্বাস মুসাভি বলেছৈন, এটি ইরানি কূটনীতির জন্য গর্ব করার সময়।
তেহরান এখনো চুক্তির পূর্ণ তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে পেট্রোলিয়াম ইকোনমিস্টের আগে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিপুল হ্রাসকৃত দামে তেল ও গ্যাস বিক্রি করা, মূল্য পরিশোধ দুই বছর পর্যন্ত বিলম্বিত করা এবং সফট কারেন্সিতে দাম প্রদানসহ চীনকে অনক ছাড় দিয়েছে।
এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিকভাবে চীনের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়বে ইরান, আর বেইজিং জ্বালানির বিশাল ও নিরাপদ উৎস লাভ করবে, উপসাগরেও দৃঢ় অবস্থান সৃষ্টি করতে পারবে।
ইরানি মিডিয়ায় ইতোমধ্যেই গুঞ্জন শুরু হয়েছে তেহরান বেইজিংয়ের কাছে কিশ আইল্যান্ড ছেড়ে দিয়েছে তেহরান। এ ধরনের গুঞ্জন মিথ্যা হতে পারে, তবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে ইরানের উপসাগরীয় বন্দরগুলোতে চীনা সামরিক স্থাপনার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
চুক্তি অনুযায়ী, চীনা প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ৫ হাজার পর্যন্ত চীনা নিরাপত্তা সদস্য ইরানে অবস্থান করতে পারবে। এটি ইরানের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই চুক্তি কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই চীনা অবস্থান ব্যাপকভাবে জোরদার করবে না, সেইসাথে মধ্য এশিয়া ও ককেশাসেও বাড়াবে।
ইরান ও ককেশাসের মধ্য দিয়ে বেইজিং ইউরোপ, এমনকি কৃষ্ণ সাগরে যাওয়ার ল্যান্ড রুট পাবে, যদি জর্জিয়া তার কৃষ্ণ সাগরীয় বন্দরগুলো ব্যবহার করতে দেয়।
ইরানের সুবিধা হলো, চীন যদি তার প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করে করে, তবে তার অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণে অর্থ যোগ হবে, বিশেষ করে জ্বালানি খাতে (২৮০ বিলিয়ন ডলার), অবকাঠামো ও পরিবহন খাতে (১২০ বিলিয়ন ডলার)। এ ধরনের বিনিয়োগ নিশ্চিতভাবেই ইরানের অর্থনীতিতে চাঙ্গা করবে, আরো চাকরি রৃষ্ট করবে এবং এর ফলে ইসলামি শাসন জোরদার হবে, ঘরোয়া বিরোধিতা শিথিল হবে।
প্রাচ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ
অবশ্য চুক্তিটির ভাগ্য এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। এটিকে পার্লামেন্টে পাস করতে হবে। চুক্তিটির কথা যখন প্রথম ইরানি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়, তখন অনেক ভাষ্যকার উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছিলেন যে এতে করে চীনের ওপর ইরান মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
এই চুক্তিটিকে ১৮৭২ সালেল কুখ্যাত রয়টার ছাড়ের সাথেও তুলা করা হয়েছিল। চুক্তির সময় টাইমস অব লন্ডন ব্রিটিশ ব্যাংকার ব্যারন জুলিয়াস দা রয়টারের সাথে পারসিয়ার রাজার চুক্তিকে দেশের সম্পদ ও সার্বভৌমত্ব বিদেশীদের কাছে আত্মসমর্পণের বৃহত্তম ঘটনা হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।
চীন ও অন্যান্য এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি ইরানের দিক পরিবর্তনের প্রধান কারণ হলো প্রাচ্যের দিকে মনোনিবেশন করা। আয়াতুল্লাহ হাশেমি রাফসানজানির প্রশাসন পাশ্চাত্যের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টাগুলো ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়।
সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে ২০১৫ সালে ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তিটি সই করার পর। ওই চুক্তির পর ইরান বোয়িং এয়ারবাস কেনা, তার দেশে আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগকে স্বাগত জানায়। কিন্তু ইরানের এই আমন্ত্রণ ইতিবাচক সাড়া পায়নি।
তারপর ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরমাণু চুক্তি থেকে সরে যান, ইরানের ওপর নতুন ও ভয়াবহ অবরোধ আরোপ করেন। এমনকি ইরানি তেল কেনার ওপরও অবরোধ আরোপ করেন। তার এই সিদ্ধান্তের ফলে ইরানের উদারপন্থীরা পর্যন্ত মনে করতে থাকেন যে ইরানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে ওয়াশিংটন আগ্রহী নয়, তারা তেহরানের সরকার পরিবর্তন চায়।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক উন্নয়নের কট্টর বিরোধিতাকারীরা চীনকে ত্রাতা মনে করে। তাদের মতে, চীনের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হলে তা তাদেরকে, এমনকি জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদেও, মার্কিন চাপ থেকে রক্ষা করতে পারে।
উত্তেজনা হ্রাস
ইরান-চীন চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তা ইরানের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে, দেশটির রাজনীতি স্থিতিশীল করবে। এ ধরনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পুনরুদ্ধার ইরানের আঞ্চলিক অবস্থান উন্নত করবে, প্রতিপক্ষরাও মার্কিন নীতি অন্ধভাবে অনুসরণ না করে ইরানের সাথে উত্তেজনা হ্রাস করতে আগ্রহী হবে। আবার আরব রাষ্ট্রগুলোও চীনের সাথে বিশেষ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ছুটে যেতে পারে।
অধিকন্তু, ইরানে চীনকে স্থায়ী অবস্থান দেয়ার ফলে চুক্তিটি বেইজিংয়ের আঞ্চলিক অবস্থান জোরদার করবে, উপসাগরে মার্কিন কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব নস্যাৎ করবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও চীনের অবস্থান বাড়াবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের পরিবর্তন ঠেকাতে পারে পরমাণু চুক্তিতে ফিরে গিয়ে, অবরোধ প্রত্যাহার করে, তেহরানের সাথে কাজ করতে ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে অনুমোদন দিয়ে। আমেরিকার এ ধরনের প্রয়াসের আশু প্রভাব দেখা যাবে ইরানে উদার শক্তিগুলোর আবার চাঙ্গা হওয়ার মধ্যে, আর দীর্ঘ মেয়াদে এটি আরো ভালো রাজনৈতিক সম্পর্কের পথ সৃষ্টি করবে।
ইরানের প্রতি পুরোপুরি বৈরী নীতি অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় তার কৌশলগত বিকল্পগুলো সীমিত করছে। ইরানে চীনের আরো সুস্পষ্ট স্বার্থ তেহরানের প্রতি অতীত আচরণ পর্যালোচনা করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
মিডল ইস্ট আই