চীন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধে কী করবে পাকিস্তান
চীন-যুক্তরাষ্ট্র স্নায়ুযুদ্ধে কী করবে পাকিস্তান - ছবি : সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্রুত একটা ‘নতুন স্নায়ু যুদ্ধে’ রূপ নিচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যেই চীন-বিরোধী জোট গড়ার আহ্বান জানাচ্ছে। এ অবস্থায় আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই ভূ-রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ যে বদলে যাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সাথেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে পাকিস্তানের এবং সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে অবশ্যই কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং এমন একটা দক্ষ কূটনীতি গ্রহণ করতে হবে যাতে উভয়ের সাথে সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। আবার একইসাথে নতুন ‘দুই মেরুর’ রাজনীতিতে অপ্রয়োজনীয় জটিলতা এড়িয়ে চলা যায়।
সঙ্ঘাতের কথা বাদ দিলেও পাকিস্তানের রাজনৈতিক অর্থনীতি এখনও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গভীরভাবে জড়িত। আফগান প্রেক্ষাপটে এখনও অনেক ঘটনা বাকি; পাকিস্তানে আইএমএফ ঋণ সহায়তা প্যাকেট কাজ করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র এখনও পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় রফতানি বাজার। অন্যদিকে, চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) আবারও গতি পেয়েছে, যদিও প্রকল্পটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সমালোচনা করেছে। আর, সম্প্রতি ঘোষিত চীন-ইরান চুক্তি দেখিয়েছে যে আঞ্চলিক সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে চীন কতটা দক্ষতার সাথে নিজেদেরকে চালকের আসনে নিয়ে গেছে।
হিউস্টনে চীনা কনস্যুলেট বন্ধের যে সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে, সেটা দুই বছর ধরে চলে আসা যুক্তরাষ্ট্র-চীন বিরোধিতার প্রেক্ষিতে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সর্বশেষ সংযোজন মাত্র। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরুর পর থেকেই এই ধারা শুরু হয়েছে।
এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র যে কারণে চীন-বিরোধী একটা বয়ান গড়ে তুলছে, সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের চলমান নির্বাচনী প্রক্রিয়া। নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থানকে সংহত করতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘চীন কার্ড’ ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছেন। বিভিন্ন সংবাদে যেটা বোঝা যাচ্ছে, সেটা হলো কোভিড-১৯ এর নিয়ন্ত্রণহীন সংক্রমল এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিক দুর্দশা – দুটোর জন্যই চীনকে দোষারোপের কার্ড বেছে নিয়েছেন ট্রাম্প।
দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বাদ দিলেও বৈশ্বিক রাজনীতিতে যেভাবে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে এবং চীনের প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, সেটাও একটা বড় কারণ যে জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটা ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ সূচনা করেছে এবং নিজেদের নেতৃত্বে একটা ‘জোট’ গড়ার চেষ্টা করছে। এভাবে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে ‘মুক্ত বিশ্বের নেতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে, যেমনটা তারা মার্কিন-সোভিয়েত ইউনিয়ন শীতল যুদ্ধের সময়ে করেছিল।
পম্পেও সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা আশা করছি যে, আমরা একটা জোট গড়ে তুলতে পারবো যারা এই হুমকিটার মর্ম বুঝবে এবং আমরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে বোঝাতে পারবো যে এই ধরনের আচরণে জড়ানোটা তাদের স্বার্থের জন্য ভালো নয়”। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডোমিনিক র্যাব এ সময় তার পাশেই ছিলেন। পম্পেও আরো বলেন, “আমরা চাই প্রতিটি দেশ যারা মুক্তি ও গণতন্ত্রের মূল্য বোঝে, তারা যেন এই হুমকিটা বুঝতে পারে, যেটা চীনা কমিউনিস্ট পার্টি তাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে”।
যুক্তরাষ্ট্র যেখানে এখনো আফগানিস্তানে উপস্থিত রয়েছে এবং মধ্য এশিয়া অঞ্চলে এখনও তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আরো বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে, সে অবস্থায় এটা প্রায় নিশ্চিত যে, এই ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ অনেক কিছুই ঘটবে এই এশিয়াতে। ফলে পাকিস্তানের মতো দেশ – যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আর চীন উভয়েই প্রভাব বিস্তারের জন্য লড়ছে, তারা একটা জটিল পররাষ্ট্র নীতির ঝামেলায় পড়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্র-সোভিয়েত ইউনিয়ন শীতল যুদ্ধকালিন পাকিস্তান সোভিয়েত ইউনিয়নের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অনেক বেশি ‘আদর্শিক মিল’ পেয়েছিল। কিন্তু ‘নতুন শীতল যুদ্ধের’ মধ্যে সেই জোরালো আদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার (কমিউনিজম বনাম পুঁজিবাদ) জায়গাটা নেই। এর অর্থ হলো আঞ্চলিক খেলোয়াড়দের এখানে নতুন ধরনের হিসেব নিকেশ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
চীনের নেতৃত্বাধীন আঞ্চলিক সংযোগ কর্মসূচির যে প্রভাব পড়বে, সেটা বিবেচনা করে ভবিষ্যতে পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে ভৌগলিক সংশ্লিষ্টতাকে মৌলিক নীতি নির্ধারক হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভৌগলিক অবস্থানকে কেন্দ্রে রাখলে পাকিস্তান বাস্তবসম্মতভাবে নিজেদেরকে আঞ্চলিকতার সাথে সংযুক্ত করতে পারবে। এই আঞ্চলিক সংশ্লিষ্টতা বেশ কিছু ভালো উপকারও নিয়ে আসতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাকিস্তানের যদিও চীনের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের সাথে গভীরভাবে জড়িত, কিন্তু চীন-ইরান চুক্তি পাকিস্তানকে একটা সুবর্ণ সুযোগ এনে দিয়েছে, যেটাকে কাজে লাগিয়ে ইরানের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে পারে পাকিস্তান। এটাকে ব্যবহার করে পাকিস্তান জ্বালানি ও বাণিজ্য করিডোরের প্রধান চাবিকাঠি হয়ে উঠতে পারে, যে করিডোরের মাধ্যমে ইউরেশিয়ার সাথে যুক্ত হবে দক্ষিণ এশিয়া ও উপসাগরীয় অঞ্চলের বাজার আর বন্দরগুলো।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, আঞ্চলিকভাবে সমন্বয়ের জন্য পাকিস্তান যে পছন্দ বেছে নিয়েছে- যার অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বৃহৎ প্রতিপক্ষের সাথে জোট গড়া – এটা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এটা বিশেষভাবে সত্য যেখানে যুক্তরাষ্ট্র আর চীন পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধের মনোভাব নিয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাকিস্তান এ ক্ষেত্রে আফগানিস্তানের উপর তাদের প্রভাবকে কাজে লাগাতে পারে। এবং এর মাধ্যমে চীনের সাথে সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের উপর যে প্রভাব পড়তে পারে, সেখানে ভারসাম্য আনতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র যদিও আফগানিস্তান থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, তবে, সেনা প্রত্যাহার পরবর্তী আফগানিস্তানে পাকিস্তানের একটা দীর্ঘমেয়াদি ভূমিকা তারা দেখতে চায়, যেখানে পাকিস্তান ভারসাম্য রক্ষা এবং আফগানিস্তানকে আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে শান্তি রক্ষার কাজ করবে।
পাকিস্তান আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অংশীদারিত্বের সম্পর্ককে অব্যাহত রাখতে পারে এবং একই সাথে এটাও বোঝাতে পারে যে, পাকিস্তান যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়, কিন্তু তারা আঞ্চলিকভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। পাকিস্তানে সিপিইসি কেন্দ্রিক যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেখানে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাকে গ্রহণ করে এবং সংযোগ প্রকল্পকে প্রত্যাখ্যান করে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক চীন-বিরোধী জোটের (একজন জুনিয়র) অংশীদার হওয়াটা পাকিস্তানের জন্য সম্ভবও নয়, আর সেটা বাস্তবসম্মতও নয়।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর