সারাহ আমিরির গল্প
সারাহ আমিরি - ছবি : সংগৃহীত
‘ছোটবেলায় আমার বয়স যখন ১২ বছর, তখন আমাদের ছায়াপথের সবচেয়ে নিকটতম অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির একটি ছবি দেখেছিলাম। সেই ছবিটি আমাকে সৌরজগতের প্রতি আকৃষ্ট করে। তখনই মহাকাশ প্রকৌশলে উৎসাহী হই। শৈশবে আমার স্বপ্নটি ছিল, মহাকাশ থেকে আমি পৃথিবী দেখব। কিন্তু তখন আমাকে সবসময় শুনতে হয়েছে, এটি অসম্ভব। কারণ এমন একটা দেশে থাকি, যে দেশটা একেবারেই নতুন; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এখনো সমৃদ্ধ নয়। আমি কিন্তু স্বপ্নের ব্যাপারে হাল ছাড়িনি। বলতাম, মহাকাশ নিয়েই কাজ করতে চাই। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, আমি কল্পলোকে বা জগতে বাস করছি। কিন্তু আমি নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকি।’
সারাহ আমিরি সেকেন্ডারি শেষ করে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব শারজাহে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হন। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার শখ থাকলেও সে বিষয়টি ওখানে ছিল না। ফলে কম্পিউটার সায়েন্সে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। আমিরাতে তখন কোনো মহাকাশ কর্মসূচি ছিল না। ফলে তাকে এমিরেটস ইনস্টিটিউশন ফর অ্যাডভান্সড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে যোগ দিতে হলো। সেখানে কাজ করেন দুবাই স্যাট-১ ও দুবাই স্যাট-২ প্রকল্পে। এরপর যোগ দেন জলবায়ুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। ২০১৬ সালে তাকে সায়েন্স কাউন্সিলের প্রধান করা হলো। দেশটি মঙ্গল অভিযান শুরু করলে এর সাথে তাকে জড়িত করা হয়। এখন এই মিশনের তিনিই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। ২০১৭ সালে তাকে আমিরাতের অ্যাডভান্সড সায়েন্সবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী করা হয়। তিনি বৈশ্বিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে আমেরিকায় যান এবং নাসাসহ বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থাগুলো ঘুরে প্রশিক্ষণ ও নানা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে নাসা সূর্য অভিযানে পাঠায় পার্কার সোলার প্রোব মহাকাশযানকে। এ অভিযানেও বিজ্ঞানী দলের নেতৃত্ব দেন একজন নারী, ড. নিকোলা ফক্স। তার বয়স যখন ৯ বছর, তখন তিনি লন্ডনের বাসায় বাবার সাথে বসে টেলিভিশনে সর্বপ্রথম মানব হিসেবে নীল আর্মস্ট্রংয়ের চাঁদে পা রাখার ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিলেন। তখনই তিনি স্বপ্ন দেখেন, নিজেও মহাকাশ বিজ্ঞানী হবেন। তার স্বপ্নও বাস্তবায়িত হয়েছে। ৪৯ বছর পর নাসায় তার নেতৃত্বেই সূর্য অভিযান পরিচালিত হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির অ্যাপ্লাইড ফিজিক্সের অধ্যাপক।
আর এবার আমিরাতের নারী বিজ্ঞানী সারাহর ঘটনাও যেন নিকোলা ফক্সের মতোই। ছোটবেলার স্বপ্নে অটল থেকে তিনিও তা জয় করেছেন।
আমিরাতের হোপ মহাকাশযান যেটি মঙ্গল গ্রহে গেছে, তা নির্মাণের বেশির ভাগ কাজ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর ল্যাবরেটরি ফর অ্যাটমোসফিয়ারিক অ্যান্ড স্পেস ফিজিক্সে। দুবাইয়ের মোহাম্মদ বিন রশিদ স্পেস সেন্টারেও উল্লেখযোগ্য কাজ হয়েছে। জাপানি রকেট দ্বারা চালিত মহাকাশযানটিতে তিন ধরনের সেন্সর রয়েছে, যার কাজ হবে মঙ্গলগ্রহের জটিল বায়ুমণ্ডল পরিমাপ করা। এতে শক্তিশালী রেজ্যুলেশনের একটি মাল্টিব্র্যান্ড ক্যামেরা আছে, যা সূক্ষ্ম বস্তুর ছবি তুলবে। গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের উপরি ভাগ ও নিম্ন ভাগ পরিমাপ করার জন্য রয়েছে ইনফ্রারেড স্পেকটোমিটার। এটি তৈরি করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি। তৃতীয় আরেকটি সেন্সর গ্রহটির অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন পরিমাপ করবে।
বিজ্ঞানী সারাহ বলেন, এই মিশনের অন্যতম কাজ হচ্ছে, এ দু’টি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান কেন মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে থাকতে পারছে না, তা পরিমাপ করা। লাল গ্রহটিতে পৃথিবীর মতোই একসময় নদী সাগর ও পানি ছিল। কিন্তু এখন এটি শুষ্ক ধূলিকণায় পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সায়েন্স মিউজিয়াম গ্রুপের পরিচালক স্যার ইয়ান ব্ল্যাচফোর্ড বলেন, এর আগে যতগুলো মহাকাশযান মঙ্গলে গেছে সেগুলো ভূতত্ত্বের দিকে মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছে। কিন্তু হোপ মিশন সফল হলে জলবায়ু সম্পর্কে সামগ্রিক একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত কেন মঙ্গল অভিযান চালাচ্ছে? তাদের তো এ ব্যাপারে কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। এটি এক ধরনের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। আজ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারত এ পরিকল্পনা নিয়েছে। এ ব্যাপারে দেশটির বিজ্ঞানীরা বলেন, তারা তাদের দেশকে ধীরে ধীরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করার চিন্তা থেকেই এ উদ্যোগ নিয়েছেন।
সাত মাস পর ‘হোপ’ যখন গন্তব্যে পৌঁছবে, তখন আরব আমিরাত স্বাধীনতার ৫০ বছর অর্থাৎ সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে। দেশটি দেখাতে চাচ্ছে, তার ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এমন চ্যালেঞ্জ নেয়ার ক্ষমতা তাদের আছে।
বিজ্ঞানী সারাহ আল আমিরি বলেন, আমিরাতের তরুণ বিজ্ঞানীদের জন্য হোপ মিশন স্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং পেশায় যুক্ত হওয়ার দ্বার খুলে দিয়েছে।
জ্বালানি তেলের ব্যবসা আর যথেষ্ট নয় আরব আমিরাতের। তাদের দৃষ্টি এখন মহাকাশে। শুধু তেলের ওপর নির্ভরশীল না থেকে নতুন কিছু করতে চাচ্ছে আরব দেশটি। যদি এ মিশন সফল হয় তা হলে প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে এসে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে চায় আমিরাত রাষ্ট্র।
মঙ্গলগ্রহ অভিযান হোপের সাথে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানান দিতে চান, আট শতাব্দী আগে আরব বিজ্ঞানীরা অনেক উন্নত দেশের চেয়েও অগ্রসর ছিলেন। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দিক থেকে তারা ছিলেন সামনের সারিতে। আমিরাতের শাসক উচ্চাকাক্সক্ষী এই মিশনের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক গৌরবকে আবারো উদ্দীপ্ত করতে চান। এর আগে আরব আমিরাত পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার জন্য রকেট পাঠিয়েছিল।
সংযুক্ত আরব আমিরাত মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আরব উপদ্বীপের উত্তর পূর্ব কোণায় অবস্থিত সাতটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ফেডারেশন। এটি মরুময় দেশ। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছে। উত্তরে পারস্য উপসাগর, দক্ষিণ ও পশ্চিমে সৌদি আরব এবং পূর্বে ওমান ও ওমান উপসাগর। ১৯৫০ সালে পেট্রোলিয়াম আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসিত অনুন্নত এলাকার সমষ্টি ছিল এ অঞ্চল। ১৯৭০ সালের শুরুতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসে। দুবাইয়ের ‘বুর্জ খলিফা’ পৃথিবীর গগনচুম্বী এক অট্টালিকা, যা বিশ্ববাসীর চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। দেশটিতে ৮২ লাখ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থানীয় ১১ লাখ, ভারতীয় ২৬ লাখ ও পাকিস্তানি আছে ১২ লাখ। মঙ্গলগ্রহে আমিরাতের হোপ মহাকাশযান পাঠানোর এ ঘটনা দেশটির জন্য বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সৃষ্টি করল নতুন এক ইতিহাস, যা মুসলিম বিশ্বের জন্যও এক বড় অনুপ্রেরণা।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক
abdal62@gmail.com