সাক্ষাতকারে ভারত সম্পর্কে যা বললেন শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট
গোতাবায়া রাজাপাকসে - ছবি : সংগৃহীত
শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে অস্থিরতা বহুদিন থেকে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিজয়ের জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বড় ভাই) মাহিন্দা রাজাপাকসের সাজানো মাঠ তছনছ করে দেন বিরোধী দলের প্রার্থী মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। সবাইকে অবাক করে বিজয়ী হন তিনি। যাকে পরাজিত করেন এক সময় সেই রাজাপাকসের (রাজাপক্ষের) মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তিনি। রাজনীতিতে ‘শেষ কথা বলে কিছু নেই’ তার এই আচরণে সেটাই প্রকাশ পেয়েছিল।
তবে নিয়তি বুঝি মুখ টিপে হাসছিল। কেননা সিরিসেনা বেশি দিন তার নতুন মিত্রদের সাথে থাকতে পারেননি। দেশে শুরু হয় রাজনৈতিক সঙ্কট। আর গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনা রাজাপাকসেদের পক্ষ নেন এবং গণেশ উল্টে দিয়ে গোতাবায়া রাজাপাকসে বিজয়ী হন। তিনি বিজয়ী হওয়ার পর প্রথম বিদেশ সফরে ভারতকে বেছে নিয়ে নভেম্বরেই ভারত সফর করেন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে গোতাবায়া নয়াদিল্লির সাথে সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দিল্লি ও কলম্বোর মধ্যে আরো সহযোগিতার ওপর জোর দেন।
এখানে একটা কথা বলে নেয়া ভালো, রাজাপাকসেকে চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়া ও দেশের প্রধান জনগোষ্ঠী সিনহালা বা সিংহলিদের সমর্থনপুষ্ট বলে মনে করা হয়। অন্য দিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহকে (বিক্রমসিংহ) ভারতপন্থী এবং তামিল ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও তাদের সমর্থনপুষ্ট বলে মনে করা হয়। তবে কূটনৈতিক কায়দায় বা উপরে উপরে উভয় গ্রুপই ভারত বা চীন দু’টি দেশের সাথেই তাদের সুসম্পর্কের কথা বলে থাকে। আর এ কারণেই ভারতকে না চটাতে বা বলা যায় দেশটিকে আস্থায় নিতে গোতাবায়ার বিজয়ের পরপরই তার ভাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে নয়াদিল্লি সফর করেন। ২৫ এপ্রিল পার্লামেন্ট নির্বাচনে দেশটি সত্যিকারভাবে কোন দিকে যেতে উদ্যত তা স্পষ্ট হওয়ার কথা ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ায় সেই প্রক্রিয়াও পিছিয়ে যায়। ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নির্ধারিত সময়ের এক বছর আগে ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচন আহ্বান করেন। সুপ্রিম কোর্ট সেই আদেশ বাতিল করে ২০২০ সালেই নির্বাচন করার নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে এসে পড়ে করোনা মহামারী। ফলে নির্ধারিত সময়ে আর নির্বাচন হয়নি। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কায় আরো কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটায় ৫ আগস্ট পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিন ধার্য হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে বিভিন্ন দলে ভাঙচুরও হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের ইউনাইটেড পিপলস পার্টিতে বড় ধাক্কা লেগেছে, দলটিতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এটাকে দলের উপনেতা রবি করুণানায়েকে তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। তিনি বলেছেন, এই ভাঙন চায়ের কাপে ঝড় মাত্র, বড় গাছ থেকে দু-একটা পাতা পড়ে গেলে কী আসে যায়? তবে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা এতে খুব খুশি। তিনি বলেছেন দলে কোন্দল থাকলে তাদের পক্ষে সরকার চালানো সম্ভব নয়, বরং নিজেদের পরিচয় টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন।
মনে করিয়ে দেয়া ভালো, সিরিসেনা প্রেসিডেন্ট হয়ে রাজাপাকসের প্রতিদ্বন্দ্বী রনিল বিক্রমাসিংহকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী পদে বসান। ও দিকে নির্বাচনে হেরে মুষড়ে পড়েন মাহিন্দা রাজাপাকসে। তার আশা ছিল, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি তৃতীয় মেয়াদও পূরণ করবেন। তার কিছু কথিত দুর্নীতি ও ভুলনীতি তার প্রতি ভোটারদের বিরূপ করে তোলে, আর তিনি ক্রমে কর্তৃত্ববাদী শাসকে পরিণত হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। এর ফল তার পরাজয়। তবে রনিলের সাথে তিক্ততা শুরু হতে দেরি হয়নি প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার। তিনি ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর হঠাৎ পুরনো প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। রনিলকে বরখাস্ত না করেই তিনি এটা করেন। ফলে একই সময়ে দেশে দু’জন প্রধানমন্ত্রী হলেন। কিন্তু বেঁকে বসেন রনিল বিক্রমাসিংহ। তিনি ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকার করেন এবং পার্লামেন্ট ভবন দখলে রেখে তিনি তা জানিয়েও দেন। শুরু হয় দেশে মারাত্মক রাজনৈতিক সঙ্কট। তখন এক দেশে কার্যত দু’জন প্রধানমন্ত্রী।
প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা একপর্যায়ে পালামেন্ট ভেঙে দিলে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সেই আদেশ বাতিল করে দেন।
২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে ভয়াবহ বোমা হামলা এই রাজনৈতিক সঙ্কটে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। ওই ঘটনায় তিন শতাধিক লোক প্রাণ হারায়। তার পরেই আসে গত নভেম্বরের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, সিরিসেনা তাতে প্রার্থী হবেন না বলে আগেই ঘোষণা করে বসেন এবং নির্বাচনে তিনি যোগ দেন রাজাপাকসের শিবিরে। মাহিন্দা চালাকির আশ্রয় নেন, প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী করেন ছোট ভাই গোতাবায়াকে। তিনি প্রার্থী হওয়ার জন্য আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে আসেন। সাবেক জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টও তামিল বোমা হামলায় নিহত রানাসিংহ প্রেমাদাসার পুত্র সজিত প্রেমাদাসাকে হারাতে গোতাবায়া সমর্থ হন আর কার্যত উদ্ধার হয় মাহিন্দার ‘হারানো সা¤্রাজ্য’। এই পরিস্থিতিতে সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া দ্য হিন্দুকে দেয়া সাক্ষাৎকারে দিল্লি ও কলম্বোর মধ্যে আরো সহযোগিতার ওপর জোর দিলেন।
চীনের সাথে রাজাপাকসে তথা গোতাবায়া প্রশাসনের সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের এবং সেই সুবাদে পাকিস্তানের সাথেও তাদের বিভিন্ন সামরিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ আছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় চীন শ্রীলঙ্কাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়েছে যা ভারতের মোটেও পছন্দ হওয়ার কথা নয়। মাহিন্দা রাজাপাকসে ভারত সফরে যাওয়ার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তান বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মুজাহিদ আনোয়ার খান কলম্বোতে রাজাপাকসের সাথে বৈঠক করে দেশটিকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেন। তিনি পাকিস্তানের কাছ থেকে শ্রীলঙ্কা বিমানবাহিনীকে ‘টেকনিক্যাল ট্রেনিং ও প্রফেশনাল এক্সপার্টাইজ’ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। মাহিন্দা সন্ত্রাস দমনে পাকিস্তানের সহযোগিতা কামনা করেন। দু’বছর পর কার্যত পাকিস্তান আবার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে দেশটিকে পাশে পেতে চাইছে যা ভারত সন্দেহের চোখে দেখছে বলে ভাষ্যকারদের অভিমত। তবে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে এই সহযোগিতা নতুন নয়। সেনাকর্মকর্তা থাকাকালে গোতাবায়া পাকিস্তানে গিয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। নিজের সম্পর্কে গোতাবায়া বলেন, দিল্লি ও কলম্বোর মধ্যকার অতীতের ভুল বোঝাবুঝি পরিত্যাগে আন্তরিক হওয়া এবং এগিয়ে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। চীনের বিনিয়োগ ঠেকাতে চাইলে ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলো শ্রীলঙ্কায় আরো বিনিয়োগ করতে হবে। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারতের সহায়তা কামনা করেন।
এখানে সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন দ্য হিন্দুর প্রভাবশালী সাংবাদিক সুহাসিনী হায়দার। কলম্বো থেকে তাকে সহায়তা করেন মীরা শ্রীনিবাসন-
দ্য হিন্দু : আপনি কি ভারত-শ্রীলঙ্কা সম্পর্ককে ‘উচ্চতর পর্যায়ে’ নিয়ে যাওয়ার আশা করেন? যেমনটা আপনি এখানে নয়াদিল্লিতে বলেছেন, আর অগ্রাধিকার ক্ষেত্রগুলো কী কী?
গোতাবায়া রাজাপাকসে : সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসের সময়েও আমাদের নয়াদিল্লিøর সাথে খুবই আন্তরিক সম্পর্ক ছিল, কিন্তু পরে (২০১৪-১৫) তা হঠাৎ করে নি¤œমুখী হয় এবং সিরিসেনা সরকারের সময়েও তারা ভালো সম্পর্ক রেখে চলছিলেন; কিন্তু পরে এতে বহু ক্ষেত্রে হতাশা নেমে আসে। ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলতে চাই। আমি সাধারণভাবে খুবই ফ্র্যাংক, তাই নয়াদিল্লিøকে আন্তরিকভাবে বলতে চাই, যদিও আমি কিছু করতে চাই না, আর যা করব তাড়াতাড়িই করব এবং প্রতিশ্রুতি থেকে সরে যাবো না। আমরা বিগত সরকারের সময় সফল ছিলাম। কেননা, নয়াদিল্লির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের তিনজনের সমন্বয় টিমে একটি পৃথক মেকানিজম ছিল। কনফ্লিক্ট চলছিল বলে আমাদের এই মেকানিজম বা কৌশলের প্রয়োজন ছিল। আমরা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে সেনসিটিভ সমস্যাগুলো সমাধান করতে পেরেছি।
দ্য হিন্দু : আপনারা সমন্বয়ের জন্য একই কৌশল ফিরিয়ে আনবেন?
গোতাবায়া : ভালো কথা, সেই সময় কনফ্লিক্টের কারণে সেটার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু এখন এটার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনি করি না। কেননা আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কাজ করতে পারি। আমরা এগিয়ে যেতে চাইলে এবং সত্যিকারভাবে কাজ করতে চাইলে আমাদের মধ্যে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমি মনে করি, আমাদের সম্পর্কের প্রধান ইস্যুগুলোতে ভারত আমাদের সাথে থাকতে পারে, চীন অথবা পাকিস্তান যেমনটা রয়েছে। তবে আমরা যদি এমন কিছু না করি যা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মনে সন্দেহের জন্ম দেয়; তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
দ্য হিন্দু : দিল্লির সাথে উন্নয়ন সহযোগিতা প্রশ্নে, যার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদি অতিরিক্ত ৪০০ মিলিয়ন ডলারের কথা ঘোষণা করেছেন, আপনি কি ত্রিঙ্কোমালি অয়েল ফার্ম এবং পোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টের মতো প্রকল্পের ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের স্বাক্ষরকৃত সমঝোতা স্মারকগুলোর প্রতি সম্মান দেখাবেন?
গোতাবায়া : বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে যে সব ক্ষেত্রে আমাদের সুনির্দিষ্ট মডালিটিতে পরিবর্তন আনতে হবে, আর এই সফরকালে এসব বিষয়ে কথা বলব। আমি সবগুলো প্রকল্পের বিষয়ে এখনো পুরোপুরি স্টাডি করিনি, তবে প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, যেসব প্রকল্প শ্রীলঙ্কার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সেগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নেবো।
দ্য হিন্দু : আপনি জনসমক্ষে বলেছেন, হামবানতোতা পোর্ট চুক্তির বিষয়টি নিয়ে চীনের সাথে নতুন করে আলোচনা করবেন, যেটার ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। সেই সাথে মাততালা এয়ারপোর্ট প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী, ভারত যার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে? এখন তো আপনি ক্ষমতায়, আপনি কী করবেন?
গোতাবায়া : আমি মনে করি, হামবানতোতা প্রকল্পের মতো কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব প্রকল্পের ব্যাপারে শ্রীলঙ্কা সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা প্রয়োজন। কেননা এগুলো হোটেল বা একটি টার্মিনালের মতো নয়। তাই পোর্ট, এয়ারপোর্ট অথবা আমাদের বন্দরের মতো প্রকল্পগুলোর বিষয়ে একটু নিয়ন্ত্রণ তো থাকতেই হবে। আমাদের নিয়ন্ত্রণে থেকে তারা সব কিছুই করতে পারবেন, তবে এই ৯৯ বছরের লিজ এগ্রিমেন্ট ( যা বিগত সরকার স্বাক্ষর করেছে) প্রশ্নে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি ইমপেক্ট তো থাকবেই। আমাদের মূল্যবান সম্পদগুলো অন্যদের দিয়ে দিলে পরবর্তী বংশধররা তো আমাদের জেনারেশনকে অভিশাপ দেবেই। আর এ কারণেই আমাদের পার্টি এসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে।
দ্য হিন্দু : কিন্তু প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে সরকার এই ঋণের বিষয়টি ‘যথাযোগ্য’ বলে মনে করেছিলেন বলেই তো এই লিজ দেয়া হয়েছিল...
গোতাবায়া : না, সেটা ভুল। সেটা একটা ঋণের ফাঁদ ছিল- এটাও বলা ভুল। সত্যিকার অর্থে আমাদের সময়ে পোর্ট অথরিটি ঋণের প্রথম কিস্তির অর্থ ফেরত দিয়েছিল (চীনা ব্যাংকের কাছে)। অন্য দিকে সিরিসেনা সরকার আরো অধিক অর্থ ঋণ হিসেবে এনেছিল এবং সেগুলো খরচ করে ফেলেছে। তারা যদি মনে করত, ঋণের পাহাড় জমছে তবে কেন তারা সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে না দিয়ে প্রথমে ঋণ পরিশোধের দিকে নজর দেয়নি?
দ্য হিন্দু : অতীতে চীনের সাথে শ্রীলঙ্কার প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে, বিশেষ করে চীনা সাবমেরিন ভেড়ার বিষয় নিয়ে ভারতের উদ্বেগ ছিল, যখন আপনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন। ২০১৭ সালে আপনি এই ইস্যুতে বলেছেন ভারতের শিরাবরণে একটি মৌমাছি ছিল। বর্তমানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আপনি কি এসব বিষয়ে আরো সংবেদনশীল হবেন?
গোতাবায়া : আমরা সেই সময়ের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল, তবে সাবমেরিনকে একটি সাধারণ ইস্যু হিসেবে সে সময়ে কর্মকর্তারা এড়িয়ে গেছেন। যুদ্ধজাহাজ নিয়মিতভাবেই শ্রীলঙ্কায় ভিড়েছে এবং সব জাহাজের আগমনই ছিল আরব সাগরে নৌদস্যুতা রোধে গঠিত টাস্কফোর্সের অংশ, সেই সাথে রুশ জাহাজও সেখানে ভিড়েছে। চীন যখন সাবমেরিন ভিড়তে দেয়ার অনুরোধ করল, তখন কর্মকর্তারা এটিকে বিবেচনা করলেন একটি স্বাভাবিক পোর্ট কল হিসেবে এবং এর অনুমোদন দিলেন। ভারতের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন তার বইতে লিখেছেন, ‘গোতাবায়া কথা দিয়েছেন তিনি ভারতের বিরুদ্ধে কিছু করবেন না এবং তিনি তার কথা রেখেছেন।’ অতএব, আমি সত্যিকার অর্থেই সংবেদনশীল।
দ্য হিন্দু : আপনি অতীতে ভারতের সন্দেহের কথা উল্লেখ করেছেন, এর মধ্যে আছে চীনের সাথে বিরোধের প্রসঙ্গ ও তামিল ইস্যু। তবে সেই সাথে আপনার অভিযোগ ছিল ভারতের বিভিন্ন সংস্থা আপনার ভাইকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়া অর্থাৎ সরকার পরিবর্তনের ষড়যন্ত্র করছে। আপনার সরকার কি অতীতের সেই সন্দেহের উল্লেখ করা পৃষ্ঠাটি উল্টে দেবে?
গোতাবায়া : আমি নিশ্চিত (আমরা পৃষ্ঠাটি উল্টিয়ে দেবো)। আমরা সরকার পরিবর্তনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন সংস্থার ষড়যন্ত্রের কথা জেনেছি। তাদের অনেকের সন্দেহের কারণ ছিল চীনের সাথে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি, কিন্তু সেটা ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি। চীনের সাথে আমাদের চুক্তি ছিল পুরোপুরি বাণিজ্যিক। ভারত, জাপান, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশকে বলতে চাইÑ এগিয়ে আসার ও আমাদের সাথে বিনিয়োগের জন্য। তারা তাদের কোম্পানিগুলোকে শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগ এবং আমাদের অগ্রযাত্রায় সহযোগিতা করতে বলা উচিত, কারণ তারা তা না করলে শুধু শ্রীলঙ্কার নয়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশেরই একই সমস্যা হতে পারে। অন্য দেশগুলো কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না নিলে চীনারা সবখানেই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ নিতে পারে।
দ্য হিন্দু : সন্ত্রাস প্রশ্নে আপনি বর্তমানে ভারতের সাথে কী ধরনের সহযোগিতার বিষয় দেখছেন?
গোতাবায়া : শ্রীলঙ্কায় হুমকির বিষয়টি পরিবর্তিত হয়েছে। এলটিটিই শ্রীলঙ্কার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট হুমকি ছিল, তার মতো না হলেও বর্তমান বিশে^ সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার কারণে আইএস (ইসলামিক স্টেট) একটি বৈশি^ক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারত ও অন্য দেশগুলোর কাছে এই হুমকির বিষয়ে আমাদের চেয়ে বেশি তথ্য রয়েছে। বিগত সরকার নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তৎপরতাকে খুব বেশি অগ্রাধিকার দেয়নি। আমাদের সময়ে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা হিসেবে রয়েছে। কিন্তু বিগত সরকার দূরদৃষ্টির অভাবে সামরিক বাহিনী থেকে দূরে থেকেছে। আমরা সেই অবস্থা পুরোপুরি উল্টে দিয়েছি। আমরা গোয়েন্দা বাহিনীকে আপগ্রেড করতে চাচ্ছি। কেননা, আগে গোয়েন্দা বাহিনী শুধু এলটিটিইর হুমকির ব্যাপারেই সতর্ক থাকত, আইএস নয়। আমাদের এ ব্যাপারে ভারত ও অন্যান্য দেশের সহযোগিতা এবং সেই সাথে কারিগরি সহায়তাও প্রয়োজন।
দ্য হিন্দু : যে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব দিতে চাচ্ছেন তাতে অতীতের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। গুম ও সাদা ভ্যান আতঙ্ক এবং সেই সাথে বিশেষ করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংতার আশ্রয় নেয়ার মতো বিষয়গুলোতেও উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেগুলো আর ঘটবে না আপনি কি সে রকম নিশ্চয়তা দিতে পারেন?
গোতাবায়া : এগুলো বানোয়াট অভিযোগ। আর এগুলোর কোনোটাই অবশ্যই আমার দ্বারা ঘটেনি। ২০০৯ পরবর্তী সময়ে আমরা এসব অভিযোগ পরীক্ষা করে দেখেছি, কিন্তু এগুলো কঠিন। আমরা এ সবের জন্য দায়ী নই, এরপরও আমরা সিআইডিকে (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) এসব অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে নির্দেশ দিয়েছি, কিন্তু তারা কোনো প্রমাণ পায়নি। এগুলো যদি সহজই হতো তবে (সিরিসেনা) সরকার কেন বিষয়গুলোকে খতিয়ে দেখেনি? সত্যি কথা হচ্ছে, যুদ্ধকালে আমরা সাংবাদিকদের ব্যাপারে বেশ কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিলাম, কিন্তু বর্তমানে শান্তির সময়ে নয়। মনে রাখা দরকার, মাহিন্দা রাজাপাকসের সরকার যুদ্ধ শুরু করেনি, আমরা এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়েছি। এসব অভিযোগের বিষয়ে আগেকার প্রেসিডেন্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় না কেন?
দ্য হিন্দু : ড. জয়শঙ্করের কলম্বো সফর শেষে গত সপ্তাহে ভারত সরকার একটি বিবৃতি প্রকাশ করে তামিলদের ব্যাপারে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও সমতার আহ্বান জানিয়েছে। আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
গোতাবায়া : পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে (জয়শঙ্কর) আমার অ্যাপ্রোচের বিষয় জানিয়েছি, আর তা হলো (তামিলদের) উন্নয়ন ও একটি উন্নত জীবন মানের বিষয় অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়ে বলতে হয় সংবিধানে এই ব্যবস্থা তো রয়েছে। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, চাকরি এবং মৎস্য ও কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে সরাসরি জনসাধারণ যাতে উপকৃত হয় সেই ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। আমরা রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করতে পারি। কিন্তু ৭০ বছরের খারাপ সময়ে একের পর এক নেতা একটা মাত্র বিষয়ের উপরই জোর দিয়েছেন, আর তা হলো ডিভলুশন, ডিভলুশন, ডিভলুশন। কিন্তু কার্যত কিছুই হয়নি। আমিও বিশ^াস করি, কারো পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ইচ্ছা ও অনভূতির বিরুদ্ধে গিয়ে কিছুই করা যায় না। কেউ মেজরিটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলে তা অসত্য। কেন সিনহালা (সিংহলি) বলবে না ওই এলাকার উন্নতি করবেন না অথবা তাদের চাকরি দেবেন না, কিন্তু রাজনৈতিক ইস্যুগুলো আলাদা। আমি বলতে চাই, পাঁচ বছর পর আমার উন্নয়নের (দেশের উত্তর ও পূর্বের) রেকর্ড দেখে আমাকে বিচার করুন।
দ্য হিন্দু : আপনি কি ডিভলুশন বা তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার জনসাধারণের অধিকার প্রশ্নে ত্রয়োদশ সংশোধনীর বিষয়ে আলোচনার কোনো প্রতিশ্রিুতি দিতে চান?
গোতাবায়া : ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের অংশ এবং এটি ক্রিয়াশীল। পুলিশের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের মতো কিছু ক্ষেত্র রয়েছে যেগুলো আমরা বাস্তবায়ন করিনি। আমি এগুলোর বিকল্প নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছুক।
দ্য হিন্দু : অতীতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকাকালে আপনি শ্রীলঙ্কা সেনাবাহিনীর বিজয়ের সময় নেতৃত্ব দিয়েছেন, কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সত্ত্বেও, আন্তর্জাতিক ম্যান্ডেটে গঠিত ট্রুুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে অস্বীকার করেছেন বলে আপনাকে অভিযুক্ত করা হয়। পাঁচ বছর পরও কি সেই উত্তরাধিকারই বহন করতে চান?
গোতাবায়া : এসব অভিযোগ ভুল। শান্তির সময়ে এসব বিষয়ে বিচার কিংবা কাজ করার বিষয়ে আমার আগ্রহ যুদ্ধকালীন সময়ের চেয়েও বেশি। আমি সেসব এলাকার মাইন অপসারণ করেছি, রিসেটেলমেন্ট, পুনর্বাসন ও উন্নয়নের ব্যাপারে কাজ করেছি এবং আমি সব মিলিশিয়ার অস্ত্রসংবরণ করেছি। আমাকে ছাড়া সেখানকার প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হতো না, আমাদের সরকারই উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে প্রথমবারের মতো তা করেছে। আমরা নিশ্চিত করেছি যে, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে, আমরা সেখানে কোনো অনিয়ম করতে চাইনি এবং প্রার্থী বাছাইয়েও আমাদের কোনো পছন্দ ছিল না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এসব বিষয়ের স্বীকৃতি দেয়নি, এমনকি তামিল রাজনীতিবিদরাও এসবের স্বীকৃতি দেননি, যদি দিতেন তা উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের জন্য ভালো পরিস্থিতি নিয়ে আসত।
দ্য হিন্দু : আপনার বড় ভাই মাহিন্দা এখন প্রধানমন্ত্রী, আরেক ভাই চামালও মন্ত্রী। এখন কাজের ক্ষেত্রে আপনার ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক কেমন হবে এবং ১৯তম সংশোধনীর আলোকে অধিকতর পার্লামেন্টারি সিস্টেম আনার ক্ষেত্রে ক্ষমতা হস্তান্তরের মতো কোনো বিষয় ঘটবে কি?
গোতাবায়া : ১৯তম সংশোধনী (২০১৫ সালে পাস করা) একটি ব্যর্থতা, আমরা পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে এটি সংবিধান থেকে বাতিল করে দেবো। (হাসতে হাসতে) টপ লেভেলে দুই ভাই থাকলেই কেবল কার্যকরভাবে ১৯তম সংশোধনীর মতো কোনো কিছু করা যায়। একটি দেশকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। সিরিসেনা-বিক্রমাসিংহে সরকারের সময়ে এটা ছিল না। তারা দুজনই সবসময় লড়াইয়ে লিপ্ত থাকতেন, সেই সময়ে কোনো উন্নয়নই হয়নি। স্থিতিশীলতা না থাকলে বিনিয়োগকারীরাও আসবেন না।
দ্য হিন্দু : পরিবারে আপনাকে ‘টার্মিনেটর’ নামে ডাকা হয়; এটা কি সত্যি?
গোতাবায়া : (হাসতে হাসতে) এটা সত্যি নয়। আমি ছোটবেলা থেকেই আমাদের পরিবারে সবচেয়ে নির্দোষ ব্যক্তি। আমি সেনাবাহিনীতে যোগদানের পর আমার পরিবার বলেছিল, মাহিন্দার সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া উচিত ছিল, আর আমার যোগ দেয়া উচিত ছিল রাজনীতিতে।
‘দ্য হিন্দু’ থেকে অনুবাদ : আহমদ মতিউর রহমান