ভারতকে নিয়ে ইরানের খেলা!
ভারতকে নিয়ে ইরানের খেলা! - ছবি : সংগৃহীত
চলতি মাসের প্রথম দিকে নয়া দিল্লি ইরান থেকে এই খবর পেয়ে চমকে ওঠে যে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের অনুকূলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দেয়া হয়েছে।
দৃশ্যত বিনিয়োগ করতে ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ইরানের ভারত মহাসাগরীয় বন্দর চাবাহারের সাথে আফগান সীমান্ত নগরী জাহেদানের মধ্যে সংযোগকারী রেললাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজটি হারানোর শঙ্কার মধ্যে সরকারের পররাষ্ট্র অগ্রাধিকার নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে। এর জের ধরে কূটনীতিকরা ভারতের আঞ্চলিক উচ্চাভিলাষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় বন্দরটিতে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছেন।
ইরানের ওপর মার্কিন অবরোধ পুরোপুরি অনুসরণ, কারো কারো মতে অতিরিক্ত প্রয়োগের জের ধরে, সর্বোপরি ইরান থেকে জ্বালানি আমদানি স্থগিত করে চাবাহার বন্দর প্রকল্প নিয়ে ন্যূনতম প্রয়াস চালানোর প্রেক্ষাপটে ইরান তার দেশে প্রকাশ্যেই ভারতের অধিকার ও সুবিধাগুলো ব্যাপকভাবে হ্রাস করবে, এতে বিস্ময়ের আছে সামান্যই। ইরান সাথে সাথে ‘গুঞ্জন’ অস্বীকার করলেও তা হুঁশিয়ারি হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
এই ঘটনার পাশাপাশি একদিকে ভারত-চীন সীমান্ত উত্তেজনা এবং অন্যদিকে তেহরান ও বেইজিংয়ের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি আসন্ন কৌশলগত চুক্তির খবর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চীনের কাছে জায়গা হারানোর ক্ষতি ভারতের পক্ষে পুষিয়ে নেয়া কঠিন হবে। আর ২০২৬ সালে তেহরান ও নয়া দিল্লির মধ্যকার বর্তমান ১০ বছর মেয়াদি চুক্তিটি শেষ হওয়া মাত্র চীন তার উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েীটভ প্রকল্প চাবাহারে বাস্তবায়ন করতে পারবে।
ইরান অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাখ্যাই দিয়ে বলেছে, চীন ও ভারত উভয়ে একইসাথে চাবাহার বন্দর প্রকল্প থেকে উপকৃত হতে পারবে। তবে ইরান ও চীন দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির দিকে ধীরে ধীরে এগুতে থাকায় চাবাহার বন্দরের ভবিষ্যত সব পক্ষের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।
উভয় পক্ষে খেলা
একটি বড় প্রশ্ন হলো, ইরান কি উভয় পক্ষের সাথে খেলতে পারবে এবং কোনো না কোনোভাবে কি চীন ও ভারত উভয়ের স্বার্থের সাথে সমন্বয় সাধন করতে পারবে? এমনকি ভারত যদি অব্যাহতভাবে ইরানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ গাঁটছড়া বাঁধে এবং চীনের বিরুদ্ধে আরো তীব্রভাবে প্রতিযোগিতায় নামে?
এই মুহূর্তে ইরানে প্রধান যে চিন্তাধারা দেখা যাচ্ছে, তাতে বলা হচ্ছে যে তারা জটিল এই হিসাব থেকে নিরাপদে উত্তরণ ঘটিয়ে একইসাথে চীন ও ভারতের কাছ থেকে বাণিজ্যিক সুবিধা হাসিল করতে পারবে।
তবে ক্ষীণ একটি ধারায় বলা হচ্ছে, ভারত যেহেতু ইরানের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাই তেহরানের উচিত হবে না নয়া দিল্লির সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে খুব আশাবাদী হওয়া। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার তার মুসলিম জনসংখ্যার প্রতি অসদাচরণ করার জন্য ব্যাপকভাবে সমালোচিত হচ্ছে।
তেহরানের এক রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপকের, তিনি পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি, ভাষায়, ইরানের অভিযোগগুলো যাতে ভারত সরকার সমাধান করতে তাগিদ অনুভব করে, সেজন্যই ভারতকে একটু ধাক্কা দিয়েছে ইরান।
ভারতীয় রাষ্ট্রদূত গাদ্দাম ধর্মেন্দ্র ইরানি পার্লামেন্টের স্পিকার রাঘার গালিবাফ, ইরানের সড়ক প্রতিমন্ত্রী ও ইরান রেলওয়ের প্রধানের সাথে সাক্ষাত করে চাবাহার-জাহেদান রেল প্রকল্পে সহযোগিতা পর্যালোচনা করেছেন।
কথার চেয়ে কাজই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ইরান এখন সত্যিই দেখতে চাচ্ছে, ইরানের আঞ্চলিক ও অঞ্চল-বহির্ভূত প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রভাব নাকচ করে ইরানবিষয়ক নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করতে পারে কিনা ভারত।
ভারত যে চাবাহার প্রকল্পের ব্যাপারে পুরোপুরি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণও দেখতে চাচ্ছে ইরান।
ভারত পার্লামেন্টের স্পিকারের শিগগিরই ইরান সফরের কথা রয়েছে। এটিও আঞ্চলিক পার্টনার হিসেবে ইরানের প্রতি দিল্লির আগ্রহ আছে কিনা তাও পরিষ্কার করে দিতে পারে।
মার্কিন অবরোধে ছাড়
তেহরানের দৃষ্টিকোণ থেকে চাবাহারে ভারতের কার্যক্রমের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের ছাড় প্রদানকে ইরানে বাইরের বিনিয়োগ সুযোগের অনন্য এক জানালা খুলে দিয়েছে।
তবে এখন পর্যন্ত ভারত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি এবং ইরানের সাথে সম্পর্ক রক্ষাকে অনেক কম গুরুত্ব দিচ্ছে।
এখন পর্যন্ত পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরে চীনের ভূমিকা প্রতিরোধ করে ভারতের শক্তি প্রক্ষেপণের জন্য চাহাবার বন্দরকে ব্যবহারের কাজটি অনিশ্চিত ও দ্ব্যর্থবোধক। এই অনিশ্চয়তার সৃষ্টি চীন-ভারত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভারতের ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ঘটনায়। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চাপ দিতে চাইলেও চাবাহারে ভারতের বিনিয়োগের ওপর ছাড় দিয়েছে।
ইরান এই সুযোগটি কাজে লাগাতে চাইছে বলে তেহরানের ওই অধ্যাপক বলেন।
অবশ্য ভারতের ব্যাপারে খুব কম ইরানিই হতাশা গোপন করতে আগ্রহী। তারা বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারতের আনুগত্যে ইরানিরা ক্ষুব্ধ।
আবার অনেক বিশ্লেষক ইরান-পাকিস্তান-চীন ত্রিদেশীয় আঞ্চলিক জোটের কথা বলছেন। তাদের মতে, এটি ভারতের জন্য ভূকৌশলগতভাবে ক্ষতিকর হবে। কিন্তু এই ইস্যুতে ইরানিরা একমতে নেই। অবশ্য গালিবাফের মতো কোনো কোনো ইরানি কর্মকর্তা এখনো ইরান-ভারতের মধ্যে সম্পর্ক পর্যালোচনা করতে আগ্রহী। কারণ দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন আছে।
উল্লেখ্য, ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি, তিনি জানুয়ারিতে ইরাকে মার্কিন হামলায় নিহত হয়েছিলেন, ঘনিষ্ঠ ইরান-ভারত সম্পর্কের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। তার হিসাবের মধ্যে আফগানিস্তানও ছিল। সোলাইমানি মারা গেছেন। কিন্তু তার রাজনৈতিক অগ্রাধিকারের বিষয়টি শক্তিশালী বিপ্লবী গার্ডদের মধ্যে এখনো রয়ে গেছে।
ইরান-চীন ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরতার প্রেক্ষাপটেও যদি ভারতের সাথে ইরান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে তবে তেহরান জোরালোভাবে বলতে পারবে যে তারা বেইজিংয়ের কক্ষপথে প্রবেশ করেনি।
তাছাড়া ইরানের আধুনিক সামরিক সরঞ্জামের সম্ভাব্য উৎস হতে পারে ভারত। আবার ভারতও ইরানে অস্ত্র রফতানি করতে আগ্রহী।
ফলে ইরানের ধাক্কা খেয়ে ভারত সরকার যদি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরে আসে, চাবাহার বন্দরের ব্যাপারে তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করে তবে তা হবে ভারত সরকারের জন্য নিরাপদ বাজি। মোদি এমনকি তেহরান ও ওয়াশিংটনের মধ্যে মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকাও পালন করতে পারেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি পুনর্নির্বাচিত হন, তবে মোদির জন্য কাজটি সহজ হবে। একইকাজ করছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবে।
অবশ্য এ ধরনের ভারসাম্য পূর্ণ কাজের অনুপস্থিতি ঘটলে ইরানে ভারতের স্বার্থ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে, চীনের জন্য তা লাভজনক হবে তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
এশিয়া টাইমস