যুক্তরাষ্ট্রের কারণে চীনকে হারাল ভারত

সালমান রাফি শেখ | Jul 25, 2020 09:15 pm
যুক্তরাষ্ট্রের কারণে চীনকে হারাল ভারত

যুক্তরাষ্ট্রের কারণে চীনকে হারাল ভারত - ছবি : সংগৃহীত

 

ইরানের সাথে চীনের গভীর কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক কৌশলগত মানচিত্র – উভয় ক্ষেত্রেই বেইজিংয়ের পক্ষে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। এমন সময় এই চুক্তির ঘোষণা আসলো যখন পাকিস্তানে চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (সিপিইসি) গতি পেয়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বিআরআই সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে চীনের পরবর্তী সংযোগ স্থাপনকারী দেশ হলো ইরান, এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিআরআইকে আরও সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ইরান হবে পরবর্তী কেন্দ্র, যেটার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, অর্থাৎ ইরাক, সিরিয়া, লেবাননের মতো দেশের সাথে সংযোগ স্থাপিত হবে।

এই সম্প্রসারণের আরও প্রভাব পড়বে। কারণ চীনের ক্রমবর্ধমান সম্প্রসারণের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে জ্বালানি-সমৃদ্ধ এই অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য কমে যাবে।

জ্বালানির বাধাহীন সরবরাহের বিষয়টি যেখানে চীনের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি, সেখানে এই অঞ্চলে চীনের শক্তিশালী অবস্থান এবং ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপস্থিতি না থাকার কারণে এখানে চালকের আসনে বসবে চীন।

বেইজিং কিভাবে তাদের মূল স্বার্থের জায়গাটি রক্ষা করছে, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেছে ইরানের সাথে তাদের শত বিলিয়ন ডলার চুক্তির মধ্য দিয়ে, যে চুক্তির পর চাবাহারের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত প্রকল্প থেকে বাদ পড়েছে ভারত। অথচ এই চাবাহার বন্দরটি কিছুদিন আগেও ভারতের ‘লুক ইস্ট’ নীতির প্রধান মুকুট হিসেবে শোভা পেয়েছে। ভারতের জন্য এটা প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হওয়ার কথা ছিল এবং তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক ভূগোলের একটা প্রধান উপাদান ছিল এটা, যেটার মাধ্যমে ভারত মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানের সাথে সংযুক্ত হবে, এবং পাকিস্তানকে এড়িয়ে বাণিজ্য ও কৌশলগত স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করবে, কারণ পাকিস্তানকে ভারতের নীতি নির্ধারকরা প্রায়ই ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।

চাবাহার-জাহেদান রেলওয়ে লাইনটি চীন নির্মাণ করবে। ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেললাইনটি আফগানিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত চলে গেছে এবং এটার মাধ্যমে পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে পণ্য পরিবহনের সুযোগ ছিল ভারতের। কিন্তু সেটা আর হওয়ার সুযোগ থাকলো না।

ইরান-চীন চুক্তি এবং ভারতের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষিত বদলে গেছে, ইরান চীনের অংশীদার হবে এবং চীনকে মোকাবেলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে থাকবে ভারত। যদিও এটা এখনও দেখার বিষয় যে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব কতটা গভীর ও কতটা শক্তিশালী ও কার্যকর হতে পারবে।

চাবাহার বন্দরের সাথে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য প্রকল্পগুলোর উন্নয়নে ভূমিকা হারানোর কারণে এখানে ভারতের কৌশলগত সমস্যা অনেক বেশি গভীর হয়েছে। চাবাহার রেল প্রকল্পে ভূমিকা হারানোর পর ফারজাদ-বি গ্যাস প্রকল্পের উন্নয়নের কাজ থেকেও বাদ পড়তে যাচ্ছে ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে নিশ্চিত করেছে যে, তেহরান পারস্য উপসাগরে তাদের ফারজাদ-বি গ্যাসফিল্ডের কাজ ‘নিজস্বভাবেই’ উন্নয়ন করবে এবং ভারতকে হয়তো তারা ‘শেষের দিকে এর সাথে যুক্ত করতে পারে’।

ভারতের বাদ পড়ার পেছনে একটা প্রধান কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ইরান নীতি এবং তাদের একতরফা নিষেধাজ্ঞা অনুসরণের ক্ষেত্রে ভারত কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ। চীন অন্যদিকে ঠিক এর বিপরীত অবস্থান নিয়েছে। তারা শুধু ইরানের তেল আমদানিই জারি রাখেনি বরং মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকেও তারা অবজ্ঞা করেছে। সে কারণে ইরানের জন্য চীন স্বাভাবিকভাবেই অধিক পছন্দনীয় কৌশলগত অংশীদার হয়ে উঠেছে।

ইরান-চীন চুক্তি অনুযায়ী, ইরানের ব্যাংকিং, টেলিযোগাযোগ, বন্দর, রেলওয়ে এবং আরও বহু ডজন প্রকল্পে চীনের অংশগ্রহণের কারণে এই খাতগুলোতে ভারতের মতো অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণ আনুপাতিক হারে কমে আসবে। বিনিময়ে চীন নিয়মিতভাবে, এবং এক ইরানি কর্মকর্তা ও তেল ব্যবসায়ীর ভাষ্যমতে, আগামী ২৫ বছরের জন্য বড় ধরনের ছাড়ে ইরানি তেলের সরবরাহ পাবে।

এই চুক্তির একটি শক্তিশালী সামরিক দিকও রয়েছে। যদিও এই সম্ভাবনা কম যে, ইরানে চীনের সামরিক বন্দর বা নৌ ঘাঁটি হবে, কিন্তু চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ ও মহড়া, যৌথ গবেষণা এবং অস্ত্র উন্নয়ন ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের আহ্বান জানানো হয়েছে।

এমনকি চাবাহার বন্দরের ব্যাপারে ভারতের ‘প্রাসঙ্গিকতা’ যদি থাকেও এবং সেখানে তারা যদি কিছু পরিচালনাগত অধিকার ধরেও রাখে, তার পরও এই অঞ্চলে চীনা পরিকল্পনার কারণে এই বন্দর ভারতের জন্য অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।

এ বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে আরেকটি বন্দর, চীন যেটা ইরানের জাসকে উন্নয়ন করবে। হরমুজ প্রণালীর পাশেই অবস্থিত এই বন্দরটি হবে সারা বিশ্বের সাতটি নৌ সংকীর্ণ পয়েন্টের মধ্যে একটি। প্রতি বছর এই পয়েন্ট দিয়ে বহু বিলিয়ন ডলারের পণ্য আর তেল পরিবাহিত হয়। চীন যদি জাসকে বন্দর নির্মাণ করে, তাহলে বিশ্বের কৌশলগত ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাতটি নৌ সংকীর্ণ পয়েন্টের একটির উপর চীনের প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হবে।

সেখানে চীনা বন্দরের অর্থ হলো সংকীর্ণ পয়েন্টেই শুধু চীনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে না, হরমুজ প্রণালীর পাশেই চীনের থাকার অর্থ হলো এই অঞ্চলের কৌশলগত ভারসাম্য ব্যাপকভাবে ইরানের অনুকূলে চলে যাবে এবং উপসাগরীয় অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। এই নৌ পথটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত দিক থেকে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাদের পঞ্চম নৌবহরের সদরদপ্তর হলো উপসাগরীয় অঞ্চলের বাহরাইনে।

ইরানিদের দিক থেকে চীনের আগমনের অর্থ হলো এ অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্য শেষ হয়ে যাওয়া। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যৌথ নৌ মহড়ার পর ঠিক এই উপসংহারেই এসেছিলেন এক ইরানি নৌ কমান্ডার। হোসেন খানজাদি বলেছিলেন, এই মহড়া দেখিয়েছে যে, “এই অঞ্চলে আমেরিকান আগ্রাসনের যুগ শেষ”।

ইরান-চীন চুক্তির আরেকটি অর্থ হলো ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার অবসান। কারণ তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে এবং নিজেদের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us