কোরবানির অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসায়িল
কোরবানির পশু - ছবি : সংগৃহীত
মুসলিমদের বৃহত্তম দুটি ধর্মীয় উৎসবের একটি হলো পবিত্র ঈদুল আজহা। কোরবানি গুরুত্বপুর্ণ একটি ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানির শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য, সান্নিধ্য, আত্মত্যাগ, জবেহ, রক্তপাত ইত্যাদি। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় কোরবানি বলা হয়, মহান রাব্বুল আলামিনের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের আশায় নির্ধারিত তারিখের মধ্যে হালাল কোনো পশু আল্লাহর নামে জবেহ করা। কোরবানি আদিকাল থেকে চলে আসছে। হজরত আদম আ:-এর যুগে কোরবানির সূচনা হয়েছিল। আদম আ:-এর সন্তান হাবিল-কাবিলের মধ্যে বিয়ে-শাদি নিয়ে যখন মতানৈক্য দেখা দিলো তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের ইখলাসের সাথে হালাল পশু কোরবানি করার নির্দেশ দিলেন।
তিনি বললেন, তোমাদের মধ্যে যার কোরবানি আমার কাছে কবুল হবে তার কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়া হবে। হাবিল এবং কাবিল কোরবানির নির্দেশ পেয়ে কোরবানি করল। হাবিলের কোরবানি আল্লাহর কাছে কবুল হলো, কাবিলের হলো না। কাবিলের কোরবানি কবুল না হওয়ার কারণে সে ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলকে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ এরশাদ করেন- ‘হে নবী আপনি তাদের কাছে যথাযথভাবে আদম আ:-এর পুত্রদ্বয়ের কথা আলোচনা করেন, যখন তারা মহান রবের কাছে তাদের কোরবানিকে পেশ করল, তখন একজনের কবুল হলো অন্যজনের হলো না। যার কোরবানি কবুল হলো না সে ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যজনকে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করে ফেলব। পালনকর্তা একমাত্র মুত্তাকিদের কোরবানি কবুল করেন। (সূরা মায়িদা : ২৭)
কোরবানির গুরুত্ব প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামিন কুরআন কারিমে এরশাদ করেন- ‘আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানি নির্ধারণ করেছি যাতে তারা হালাল পশু জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে।’ (সূরা হজ : ৩৪) আল্লাহ তায়ালা কুরআনে আরো বলেছেন- ‘নিশ্চই আমার কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না, তবে আমার কাছে পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া।’ (সূরা হজ : ৩৭)
একদা হজরত জায়েদ ইবনে আরকাম রা: রাসূল সা:-এর কাছে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা: কোরবানি কী? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করলেন কোরবানি হচ্ছে তোমাদের আদি পিতা হজরত ইবরাহিম আ:-এর জীবনাদর্শ। সাহাবি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন কোরবানির ফজিলত কী? রাসূল সা: বললেন, পশুর পশমের পরিবর্তে একেকটি করে নেকি দেয়া হয়।’ (মেশকাত : ১২৯) রাসূলুল্লাহ সা: এরশাদ করেন, ‘কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই কোরবানিদাতার কোরবানি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায় এবং তার অতীতের সব গুনাহ মোচন করে দেয়া হয়। (তিরমিজি ; ১/১৮০)। মহানবী সা: আরো এরশাদ করেন, ‘তোমরা মোটা তাজা পশু দেখে কোরবানি করো, কারণ এ পশুই পুলসিরাতের বাহক হবে। (মুসলিম : ২৬৩৯) বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূল সা: পবিত্র মদিনায় ১০ বছর জীবন-যাপন করেছেন প্রত্যেক বছরই তিনি পশু কোরবানি করেছেন। (তিরমিজি : ১/১৮৯) হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুল সা: এরশাদ করেন, ‘কোরবানির দিন আল্লাহর কাছে কোরবানি অপেক্ষা উত্তম কোনো আমল আর নেই। (মেশকাত : ১৯৩৭) বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবু হোরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, নবী করিম সা: এরশাদ করেন সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানির দিন কোরবানি করে না সে যেন ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহের ময়দানের কাছে না যায়। (ইবনে মাজাহ : ১৭২১)
ইসলামে যেহেতু কোরবানি গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত। তাই কোরবানি সম্পর্কিত মাসয়ালা-মাসায়িল জেনে বিশুদ্ধভাবে কোরবানি করা জরুরি। অন্যান্য ইবাদতের মতো কোরবানি শুদ্ধ হওয়ার জন্য রয়েছে বেশ কিছু নিয়ম ও বিধিবিধান।
যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব : ঈদুল আজহার দিন প্রয়োজনীয় খরচ ছাড়া সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপা কিংবা সমপরিমাণ সম্পদ যার কাছে থাকবে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার জন্য নেসাব পরিমাণ মাল পূর্ণ এক বছর থাকা জরুরি নয়, কোরবানির শেষ দিন সূর্যাস্তের আগেও যদি কেউ নেসাব পরিমাণের মালিক হয় তাহলে তার ওপরও কোরবানি ওয়াজিব। জীবিকা নির্বাহের জন্য যে পরিমাণ জমি ও ফসলের দরকার তা থেকে অতিরিক্ত জমি ও ফসলের মূল্য অথবা যেকোনো একটির মূল্য নেসাব পরিমাণ হলেও কোরবানি করা ওয়াজিব। একই পরিবারের সব সদস্য পৃথক পৃথকভাবে নেসাবের মালিক হলে সবার ওপর আলাদাভাবে কোরবানি ওয়াজিব। কোনো উদ্দেশ্যে কোরবানির মান্নত করলে সে উদ্দেশ্য পূর্ণ হলেও কোরবানি করা ওয়াজিব। অতএব প্রত্যেক স্বাধীন, ধনী, প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক নর-নারীর ওপর কোরবানি ওয়াজিব।
কোরবানির পশু ও তার বয়স : ইসলামী শরিয়তে গরু-মহিষ, ভেড়া, ছাগল, দুম্বা, উট কোরবানি করাকে বৈধতা দান করেছে। তবে ছাগল, ভেড়া, দুম্বা এক ব্যক্তির পক্ষ থেকে আদায় করা চলবে কিন্তু গরু, মহিষ, উট সাত ব্যক্তি শরিক হতে পারবে। শর্ত একটাই শরিকদার সবার নিয়ত বিশুদ্ধ থাকতে হবে। এদের মধ্যে একজনেরও যদি লোক দেখানো বা গোশত খাওয়ার উদ্দেশ্য হয় তাহলে কারো কোরবানি কবুল হবে না। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, এক বছর বয়সী হওয়া আবশ্যক। তবে যদি ছয় মাসের দুম্বা এবং ভেড়া এরূপ মোটা তাজা হয় যে, দেখতে এক বছরের মতো মনে হয় তাহলে ওই ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা যাবে। আর ছাগল যত বড়ই হোক না কেন এক বছর পরিপূর্ণ হওয়া জরুরি, একদিন কম হলেও কোরবানি জায়েজ হবে না। গাভী, মহিষ দুই বছর পূর্ণ হওয়া জরুরি। উট পাঁচ বছরের হওয়া জরুরি, একদিন কম হলেও কোরবানি হবে না। কোরবানির জন্য মোটা, তরতাজা, সুস্থ পশু হওয়া জরুরি। আতুর, লেংড়া, কানা, কানকাটা, লেজকাটা, দুর্বল পশু দিয়ে কোরবানি বিশুদ্ধ হবে না।
কোরবানির দিন : কোরবানির দিন হলো ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ। এ তিন দিনের মধ্যে যেকোনো দিন কোরবানি করা জায়েজ আছে। তবে উত্তম দিন হচ্ছে প্রথম দিন অর্থাৎ ১০ জিলহজ। কোনো কারণ ছাড়া বিলম্ব না করা ভালো।
কোরবানির সময় : জিলহজের দশম দিন ঈদের নামাজ পড়ার পর থেকে জিলহজের ১২ তারিখ সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত কোরবানি করা যাবে। তবে ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা যাবে না। ঈদের নামাজ পড়ে এসে কোরবানি করতে হবে। যদি শহরের একাধিক স্থানে ঈদের নামাজ হয় তাহলে যেকোনো এক স্থানে নামাজ আদায় হয়ে গেলে সব স্থানেই কোরবানি করা জায়েজ হবে।
জবাই : কোরবানিদাতা সে নিজেও জবাই করতে পারবে এবং কোনো আলেম তথা জানলেওয়ালা কাউকে দিয়ে কোরবানি করাতে পারবে। তবে উত্তম হচ্ছে নিজের কোরবানি নিজে করা। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে নিয়ত করা জরুরি নয় বরং অন্তরের নিয়তই যথেষ্ট। জবাই করার সময় অবশ্য অল্লাহর নাম নিতে হবে।
কোরবানির গোশত : কোরবানির গোশত নিজে খাবে এবং গরিব-মিসকিনদের খাওয়াবে। উত্তম পন্থা হচ্ছে গোশতকে তিন ভাগে ভাগ করা, একভাগ গরিব-মিসকিনকে দান করা। একভাগ আত্মীয়স্বজনকে দেয়া এবং এক অংশ নিজ পরিবারের জন্য রাখা।
পশুর চামড়া : কোরবানির পশুর চামড়া নিজে ব্যবহার করতে পারবেন এবং অন্যকে হাদিয়াও দিতে পারবেন। আবার মাদরাসার লিল্লাহ ফান্ডেও দান করা যাবে। বিক্রি করলে চামড়ার টাকা একমাত্র গরিব-মিসকিনকেই দান করতে হবে। সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে মাদরাসার গরিব ফান্ডে দান করা।
কোরবানি যেহেতু একটি উত্তম ইবাদত। এ ইবাদতটিও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া চাই। কারণ আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেছেন, ‘নিশ্চই আমার কাছে কোরবানির পশুর গোশত ও রক্ত কিছুই পৌঁছে না, তবে আমার কাছে পৌঁছে একমাত্র তাকওয়া। (সূরা হজ : ৩৭) (তথ্য সূত্র : আহসানুল ফাতাওয়া ৭/৫১০, তিরমিজি ১/১২০, ইমদাদুল ফাতায়া ২/১৬৬, মুয়াত্তা মালেক ১৮৮)
লেখক : অধ্যক্ষ, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার