যাদের জীবন অনুকরণীয় নমুনা
যাদের জীবন অনুকরণীয় নমুনা - ছবি : সংগৃহীত
উসওয়া অর্থ- আদর্শ, মডেল, অনুকরণীয় নমুনা, উদাহরণ, পদ্ধতি ইত্যাদি। আর হাসানা অর্থ- সুন্দর, উৎকৃষ্ট, অনুপম, উত্তম, ভালো, কল্যাণ, মঙ্গল, পুণ্য ইত্যাদি। অতএব, উসওয়ায়ে হাসানা অর্থ- অনুপম আদর্শ, অনুকরণীয় নমুনা।
যাদের জীবন উসওয়ায়ে হাসানা : পবিত্র কুরআন মজিদ বিশ্ববাসীর সম্মুখে ইসলামের যে স্বরূপ ও প্রকৃতি তুলে ধরতে চায় সেই দৃষ্টিতে যদি কারো জীবন উসওয়ায়ে হাসানা বা অনুপম আদর্শ হয়, তবে তা হবে কেবল হজরত ইবরাহিম আ: এবং বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর পবিত্র জীবন।
কুরআন মজিদে ‘উসওয়ায়ে হাসানা’ বাক্যটি তিন জায়গায় দু’জন নবী প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে বলা হয়েছে- নিশ্চয় তোমাদের জন্য, আল্লাহর রাসূলের জীবনে রয়েছে অতি উৎকৃষ্ট নমুনা, সেই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ তায়ালার সাক্ষাতের এবং শেষ বিচারের দিনের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। (সূরা আহাযাব-২১) হজরত ইবরাহিম আ: প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ইবরাহিম আ: এবং তাঁর সাথীদের জীবনে রয়েছে তোমাদের জন্য অনুপম আদর্শ। (সূরা মুমতাহিনা-৪) ইবরাহিম আ:-এর সাথীদের ব্যাপারে বলা হয়েছে- ‘নিশ্চয় তাদের জীবনে তোমাদের জন্য রয়েছে এক উত্তম আদর্শ সেই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহর সাক্ষাতের এবং পরকালের (কল্যাণের) আশা করে। (সূরা মুমতহিনা-৬)
হজরত ইবরাহিম আ:-এর জীবন কেন উসওয়ায়ে হাসানা : চির সত্য এবং আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন ইসলামকে যিনি পৃথিবীতে সর্বপ্রথম জীবন ব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন তিনি হলেন হজরত ইবরাহিম আ:। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দ্বীনে হানিফের প্রথম মুবাল্লিগ বলে উল্লেখ করেছেন। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টান সবাই তাঁকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে।
তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্য হলো- যখন হজরত ইবরাহিম আ:-কে তাঁর প্রভু বললেন, সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করো, তিনি বললেন, আমি বিশ্ব প্রতিপালকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। ( সূরা বাকারা-১৩১) হজরত ইবরাহিম আ: যেহেতু ইসলামের প্রথম আহ্বায়ক সেহেতু তাঁর জীবনে হয়েছিল ইসলামের মহান শিক্ষার পরিপূর্ণ রূপায়ণ। কেউ যদি সমাজে কোনো নতুন শিক্ষা উপস্থাপন করতে চান, তবে তাকেই হতে হয় সেই শিক্ষার প্রতিচ্ছবি।
হজরত ইবরাহিম আ: ছিলেন ইসলামী শিক্ষার প্রতিচ্ছবি। আর তিনি অনুপম আদর্শ হিসেবে নিজেকে জাতির সামনে উপস্থাপন করে ছিলেন। তাঁর সব কার্যক্রমে ছিল ইসলামের প্রতিধ্বনি। ফলে তিনি হতে পেরেছিলেন মুসলমানদের জন্য উত্তম আদর্শ। ইসলাম নামটিও তিনি রেখেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে সব কার্যক্রম করেছেন চিরস্মরণীয়। তিনি লাভ করেছেন অমরত্ব, হয়ে আছেন চিরঞ্জীব। হজরত ইবরাহিম আ: আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেই, কিন্তু তাঁর কর্ম হজ ও কোরবানির মধ্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
আরাফাতের ময়দানে লাখো-কোটি মানুষের বিশাল সমাবেশে প্রতিটি মানুষ যেন লাব্বাইক লাব্বাইক ধ্বনিতে হজরত ইবরাহিম আ:-এর রূপ ধারণ করে হাজির হয়। প্রতিটি মানুষ ব্যক্তিগত পরিচয় ও বৈশিষ্ট্যকে পরিত্যাগ করে ইবরাহিম খলিল হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রসঙ্গে বলেছেন- আর আমি হজরত ইবরাহিম আ: ও তাঁর সন্তানদিগকে আমার রহমতের বিরাট অংশ দান করেছি এবং তাদের জন্য দুনিয়াতে সর্বোত্তম পন্থায় আলোচনার ব্যবস্থা রেখেছি। (সূরা মরিয়াম-৫০) হজরত ইবরাহিম আ:-এর প্রতিটি কথাই ছিল ইসলামের একেকটি শিক্ষার অভিব্যক্তি। তিনি ইসলামের মহান শিক্ষা ও আদর্শে নিজেকে এমনভাবে হারিয়ে ফেলেছিলেন যে, তাঁর কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বলতে কিছুই ছিল না।
যখন তাঁর সম্মুখে নক্ষত্রপুঞ্জ আলো নিয়ে, চাঁদ তার মনোহরী সৌন্দর্য নিয়ে এবং সূর্য তার শ্রেষ্ঠত্বের গাম্ভীর্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল, তখন তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন- আমি ধ্বংসশীল বস্তুকে পছন্দ করি না। (সূরা আনয়াম-৭৬) হজরত ইবরাহিম আ:-এর সম্মুখে ছিল সারি সারি মূর্তি। তা সত্ত্বেও তাঁর হৃদয়ে কে এসব মূর্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং এক স্রষ্টার প্রতি অবিচল বিশ্বাস সৃষ্টি করে দিলো? সে দিন তাঁর কণ্ঠে আল্লাহর অস্তিত্বের কথা ফল্গুধারার মতো উচ্চারিত হয়েছিল- সেই আল্লাহ তায়ালা- যিনি আমাকে সৃষ্টি করছেন, পরে তিনিই আমাকে হিদায়েত করেছেন। যিনি আমাকে আহার দান করেন ও আমার তৃষ্ণা দূরীভূত করেন, যখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তিনি আমাকে সুস্থ করেন এবং যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন। পরে আবার জীবিত করবেন। (সূরা শুয়ারা-৭৮-৮১)
হজরত ইবরাহিম আ: যখন তাঁর পিতা, চাচা ও বংশের লোকদেরকে মূর্তি তৈরি করতে দেখলেন তখন তাঁর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো- ‘আপনারা যেসব জিনিসের পূজা করছেন, আমি তা থেকে পবিত্র, এর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সম্পর্ক সেই স্রষ্টার সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, তিনিই আমাকে হেদায়াত দান করবেন। (সূরা যুখরুফ-২৬-২৭)।
হজরত ইবরাহিম আ: ইসলামের অনুপম আদর্শের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন স্বীয় জীবনে। আর এ আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছেন অনাগত প্রজন্মকে। আল্লাহর বাণী- আর এই ইসলাম সম্পর্কেই হজরত ইবরাহিম তাঁর সন্তানদের (ইসমাঈল ও ইসহাক) এবং ইয়াকুবকে ওসিয়ত করেছেন। হে আমার পুত্র! নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীনকে (ইসলামকে) পছন্দ করেছেন। (অতএব তোমরা আজীবন এই দ্বীনের উপর অটল-অবিচল থাকবে) এবং মুসলমান হওয়া ছাড়া মৃত্যুবরণ করো না। (সূরা বাকারা- ১৩২)
হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন কেন উসওয়ায়ে হাসানা : আল্লাহ তায়ালা হজরত মুহাম্মদ সা:কে সব নবী-রাসূলের গুণাবলি দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তাঁর মধ্যে ছিল হজরত আদম আ:-এর ব্যবহার, হজরত নূহ আ:-এর প্রচার উদ্দীপনা, হজরত ইবরাহিম আ:-এর তাওহিদী প্রেরণা, হজরত ইসহাক আ:-এর সন্তুষ্টি, হজরত ইসমাঈল আ:-এর কোরবানি, হজরত মূসা আ:-এর বিরামহীন প্রচেষ্টা ও সাধনা, হজরত হারুন আ:-এর সত্য প্রীতি, হজরত ইয়াকুব আ:-এর আনুগত্য, হজরত সুলাইমান আ:-এর জ্ঞান, হজরত দাউদ আ:-এর সাহস, হজরত জাকারিয়া আ:-এর ইবাদত, হজরত ইয়াহিয়া আ:-এর পবিত্রতা, হজরত ঈসা আ:-এর আল্লাহভীতি, হজরত ইউনুস আ:-এর ভ্রান্তি স্বীকার, হজরত লুত আ:-এর পরিশ্রম, হজরত আইউব আ:-এর ধৈর্য।
হজরত মুহাম্মদ সা:-কে যেসব বিশেষ মর্যাদা দান করা হয়েছে তা অন্য কোনো নবী-রাসূলকে দান করা হয়নি। তাঁকে দান করা হয়েছে স্থায়ী, সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী গ্রন্থ। যার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং গ্রহণ করেছেন আল্লাহ তায়ালা। মহানবী সা:-এর ওঠা-বসা, নিদ্রা- জাগরণ, বিয়ে-শাদি, দিবা-রাত্রের ইবাদত, যুদ্ধ-সন্ধি, চলাফেরা, আহার-বিহার, হাসি-কান্না, বস্ত্র পরিধান, আলাপ-আলোচনা, আচার-ব্যবহার, দাম্পত্য জীবন, লেনদেন, বেচাকেনা, দাড়ি রাখার পদ্ধতি, গোঁফ রাখার নিয়ম ইত্যাদিতে রয়েছে অনুকরণীয় আদর্শ।
স্বীয় চাচা আবু তালেব তাঁকে দাওয়াত থেকে বিরত রাখতে চাইলে তিনি বলেছিলেন- আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমি এ দাওয়াত থেকে বিরত থাকব না। মহানবী সা:-এর আগমন হজরত ইবরাহিম আ:-এর দোয়ার ফসল। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের প্রতি বিরাট উপকার করেছেন যখন তিনি তাদের মধ্য থেকেই তাদের কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের কাছে আল্লাহ তায়ালার আয়াতসমূহ পাঠ করেন এবং তাদের সংশোধন করেন, আর তাদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা দান করেন অথচ ইতঃপূর্বে তারা ছিল স্পষ্ট মূর্খতা এবং পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত। (সূরা আলে ইমরান-১৬৪) হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবন উসওয়ায়ে হাসানা হওয়ার কারণেই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- (হে রাসূল!) বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসতে চাও, তা হলে আমার আনুগত্য করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন (সূরা আলে ইমরান- ৩১)। এ আয়াতে তাঁর আনুগত্য, তাঁর জীবনের অনুসৃতিকে আল্লাহর ভালোবাসার মানদণ্ডে পরিণত করা হয়েছে। ফলে তাঁর জীবন মুসলমানদের জন্য অনুপম আদর্শ।
লেখক : প্রধান ফকিহ্, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদ্রাসা, ফেনী