সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে উজিরের কৌতুক : তরুণ আলেমের কথায় তালাক কার্যকর হলো না
আব্বাসীয় আমলের একটি ছবি - ছবি : সংগৃহীত
আব্বাসীয় খলিফা আল মানসুরের কাল। ইসা ইবনে মুসা হাশিমী খেলাফতের একজন পদস্থ উজির, স্বয়ং খলিফার প্রিয়ভাজন। তার অসাধারণ রূপসী স্ত্রী, যাকে গভীরভাবে ভালোবাসেন হাশিমী। এক চন্দ্রালোকিত রাতে স্ত্রীকে নিয়ে গল্প করছিলেন আর উপভোগ করছিলেন রাতের নিসর্গের সৌন্দর্য। হঠাৎ তিনি স্ত্রীকে বললেন,
চাঁদ না তুমি কোনটা সুন্দর?
আরো বললেন, তুমি যদি চাঁদের চেয়ে সুন্দর না হও তবে তোমাকে তিন তালাক।
স্ত্রী শিউরে উঠলেন! সাথে সাথে নিজের মুখমণ্ডল আবৃত করে স্বামীর কাছ থেকে সরে গেলেন; বললেন,
এখন আর আপনি আমাকে দেখতে পারেন না। কেননা আমি আর আপনার স্ত্রী নই।’
হাশিমী সম্বিত ফিরে পেলেন, অস্থির হয়ে উঠলেন। বললেন,
কৌতুক করেই কথাগুলো বলেছি, সত্যিকারভাবে বলিনি।’
-কৌতুক করে বললেও তালাক কার্যকরী হয়ে যায় শরিয়াহ মোতাবেক। বিষয়টির চূড়ান্ত ফায়সালার আগে আমি কোনোভাবেই আপনার জন্য হালাল নই। কেননা আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।’
সারারাত হাশিমী অস্থিরভাবে পায়চারী করে কাটালেন, প্রিয়তমা স্ত্রীর কথা মনে করে করে নিজের ভুলের জন্য আফসোস করতে থাকলেন। সকাল হতেই তিনি খলিফার কাছে পুরো বিষয়টি খুলে বললেন। খলিফা তার এ উজিরকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি সাথে সাথে সেরা ওলামা ও ফকিহদের তলব করলেন এবং সমস্যাটির সমাধান চাইলেন। দরবারে উপস্থিত সব ফকিহ ও আলেম সিদ্ধান্ত দিলেন যে, তালাক কার্যকর হয়ে গেছে; যেহেতু মানুষ চাঁদের চেয়ে সুন্দর হতে পারে না। তবে এক কোণে বসে থাকা এক তরুণ এ সিদ্ধান্তের সাথে কণ্ঠ মেলালেন না। খলিফা তাকে কারণ জিজ্ঞেস করলেন। তিনি সূরা আত তিন তিলাওয়াত করে বললেন, ‘আমিরুল মুমিনিন! আল্লাহ স্বয়ং বলছেন মানুষকেই তিনি সুন্দরতম আকৃতি দিয়েছেন। তাহলে তালাক কিভাবে কার্যকরী হয়?’
অব্যর্থ যুক্তি। অবশেষে উপস্থিত অন্যান্য আলেম এ যুক্তি মেনে নিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন এবং তালাক কার্যকরী না করার সিদ্ধান্ত দিলেন। সামান্য একটু জ্ঞান কিভাবে মানুষের জীবনকে আলোকিত করতে পারে তার একটি চমৎকার উদাহরণ হতে পারে এই ঘটনাটি।
ইতিহাসের জানালায় উঁকি দিলে বারবার দেখা যায় আমাদের সমৃদ্ধ অতীত। জ্ঞানের আলোয় এক সময় রচিত হয়েছিল আগামীর পথ। এ অতীত জ্ঞানের, এ সৌন্দর্য প্রজ্ঞার, এ আলো অন্ধকারকে পথ দেখাবার।
আলোর উল্টো পিঠেই বসে আছে অন্ধকার। অজ্ঞতার আরেক নাম মূর্খতা, যাকে আরবিতে বলা হয় জেহালত। আইয়ামে জাহিলিয়াত মানে হচ্ছে অজ্ঞতা বা মূর্খতার যুগ। প্রাক-ইসলামী যুগকে ইতিহাস এ নামেই আখ্যায়িত করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে সে যুগের মানুষ কী জানত না? কিংবা কোন বিষয়ে তারা অজ্ঞ ছিল? অজ্ঞতা এবং অন্ধকারের সংজ্ঞাতেই একটি মৌলিক গলদ রয়ে গেছে। সত্যিকারের অন্ধকারকে যদি চিনতে হয় তাহলে অন্ধকারের সংজ্ঞাকে আগে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
ইতিহাস বলে মরুচারী আরব জাতি ব্যবসাবাণিজ্যে খুবই দক্ষ ছিল, মক্কা থেকে সুদূর সিরিয়ায় তাদের বাণিজ্য কাফেলার যাতায়াত ছিল নিয়মিত। বাণিজ্য কূটনীতির প্রয়াসে আশপাশের জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তারা নিজস্ব প্রতিপত্তি এবং প্রভাব তৈরি করে নিয়েছিল। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তারা তাদের ব্যবসায়িক জগতকে বিস্তৃত করার কাজে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করতে পেরেছিল।
চারু শিল্পে আরববাসীর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল এমন শোনা যায় না তবে শিল্পের দক্ষতা তাদের প্রশ্নাতীত। মূর্তি ও ভাস্কর্য চর্চায় তারা চমৎকারিত্ব প্রমাণ করেছে। সাহিত্যের রস বোধেও তারা যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। তারা কথায় কথায় কবিতা রচনা করতে পারত, কবিতার আসর ছিল তাদের কাছে ভীষণ প্রিয়। ইমরুল কায়েসের মতো ভুবনবিখ্যাত কবি তাদের মধ্যে ছিল। আরবের ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত ওকাজের মেলার মূল আকর্ষণ ছিল কাব্যচর্চা। কাব্যপ্রীতির সাথে সাথে শরাব প্রীতিও ছিল অসাধারণ। মদের পেয়ালা ছাড়া তাদের কবিতার আসরই তো জমে উঠত না। সে সব কবিতায় নারীদেহের রগরগে বর্ণনার খবরও ইতিহাস আমাদের জানান দেয়।
আপাত যাযাবর আরব জাতির অসাধারণ স্মরণশক্তির কথা তো কিংবদন্তির মতোই ইতিহাসে বর্ণিত আছে। সংস্কৃতি ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তাদের পদচারণা ছিল। আজকের সমাজ যেমন মমতা কুলকার্নি আর সালমান খানদের ভাড়া করে আনে নৃত্য-গীতের আসর বসিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হতে। আরবের নজর ইবনে হারিসা প্রমুখ কোরাইশ নেতৃবর্গ পারস্যের উর্বশী নর্তকীদের ভাড়া আনতো একই মাকসুদে।
তাহলে আমি কেন সে সময়টাকে জাহিলিয়াতের বা মূর্খতার সময় বলা হয়? মজার বিষয় হচ্ছে উপরে তাদের যে গুণের(?) কথা বলেছি, একবিংশ শতাব্দীর এই সভ্য যুগে কথিত আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রগতিশীল মানুষও ঠিক একই গুণের অধিকারী। যেসব দোষে তারা দুষ্ট ছিল, আজকের পৃথিবীতে এ দোষ নেই কোথায়?
তারা মারামারি করত। আজকে পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে প্রতিদিন যত সংখ্যক বনি আদম নিহত হচ্ছে, খোদার জমিন ভিজে যাচ্ছে মানুষের রক্তে, এসব মারামারি যারা করছে এবং যারা এ পৈশাচিকতার ইন্ধনদাতা, নাটের গুরু তারা কি সে সময়ের চেয়ে আরো বেশি বর্বর নয়?
তারা কন্যাসন্তানকে জীবন্ত কবর দিত; আজকের সভ্য সমাজ তো মাতৃগর্ভে সন্তানের ভ্রƒণ নিষিক্ত হতেই দেয় না। অভাবের তাড়নায় সন্তান হত্যা করতে আল কুরআন কঠোরভাবে নিষেধ করেছে : এটি একটি প্রাচীন জাহিলিয়াত। কিন্তু আজকের সভ্য ভদ্র লোকেরা যা করেন তা কি একই কারণে নয়? পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে, উদ্দেশ্য কিন্তু সেই একই থেকে গিয়েছে।
যে সমকামিতাকে তারা আইন করে বৈধ করে নিয়েছে, তা মূলত প্রায় চার হাজার বছর আগের জাহিলিয়াত, যে কারণে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন লুৎ জাতিকে। সে যুগের জাহেল লোকেরা অন্তত এ পর্যন্ত পৌঁছেনি। অন্ধকারের মাপকাঠিতে সে যুগ আর এ যুগ যেন একাকার।
আসলে জ্ঞানকে যদি ধারণ করতে হয় তবে জ্ঞানের সংজ্ঞা হতে হবে কার্যকর, সার্বজনীন এবং ঐশী জ্ঞান কর্তৃক সত্যায়িত। অন্ধকার সর্বাবস্থায়ই অন্ধকার। মধ্য যুগ হোক আর আধুনিক যুগ হোক যেখানেই সত্য জ্ঞানের অভাব সেখানেই জমাট বাঁধা অন্ধকারের অস্তিত্ব। আলোর উৎস হচ্ছে জ্ঞান। জ্ঞানী বা আলোকিত মানুষের কথা বলতে গিয়ে তাই আল কুরআন বলেছে,
নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি, দিন ও রাতের আবর্তনের মধ্যে জ্ঞানীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে যারা দাঁড়ানো, বসা ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আসমান ও জমিনের সৃষ্টি বৈচিত্র্য নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯০-৯১)
মানবজীবনে কিছু মৌলিক প্রশ্ন আছে যেগুলোর জবাব জানা না থাকলে তিনি কতটা ডিগ্রিধারী, কতগুলো সনদ জোগাড় করেছেন, কত টাকা উপার্জন করেন, কোন পদে আসীন আছেনÑ ইসলামের দৃষ্টিতে এসব মূল্যহীন। সে প্রশ্নগুলো হচ্ছে : আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? কোথায় ফিরে যাবো? কে আমাকে পাঠালেন এবং কী দায়িত্ব আমার? অজস্র এ সৃষ্টিনিচয়ের মাঝে আমার অবস্থান বা মর্যাদা কী? ভারসাম্যপূর্ণ এ মহাজগৎ যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করছেন, সে মহান স্রষ্টার সাথে আমার সম্পর্ক কী? এ প্রশ্নগুলোর জবাব যার যতটা নির্ভুলভাবে জানা আছে ইসলামের দৃষ্টিতে তিনি ততটা জ্ঞানী। এ জন্যই নবী-রাসূলগণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও পৃথিবীতে তারা ছিলেন সবচেয়ে জ্ঞানী; উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর জবাব তারা পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুলভাবে জানতেন।
নির্ভুল এ জ্ঞানের উৎস হচ্ছে ঐশী গ্রন্থ তথা ওহিভিত্তিক জ্ঞান। আল কুরআন আর সুন্নাহ হচ্ছে এর সর্বশেষ সংস্করণ। এ উৎসগুলোর সাথে সম্পর্ক যত দুর্বল থাকবে সে এই জ্ঞান থেকেও তত দূরে থাকবে। আল কুরআন তাই জ্ঞান অর্জনের প্রতি যথেষ্ট তাকিদ দিয়েছে। কুরআনের শুরুই হয়েছিল ‘পড়ো’ শব্দ দ্বারা।
আলোর আঙিনায় পা রাখতে মহানবী সা:-এর প্রথম উদাত্ত আহবান ‘পড়ো’। জ্ঞান অর্জন হচ্ছে অন্ধকার দূর করার প্রথম হাতিয়ার। জ্ঞান আমাদের অজ্ঞতাকে দূর করার পাশাপাশি কুসংস্কার মুক্ত করবে। মুক্ত করবে অন্ধবিশ^াস থেকে। পড়লেই জানতে পারবে। জানলেই মানতে পারবে।
প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা: আমাদের জন্য রেখে গেছেন দু’টি অমূল্য সম্পদ- কুরআন ও সুন্নাহ। সেই কুরআন ও সুন্নাহকে জানার চেষ্টা, বাস্তবজীবনে তার পূর্ণ অনুসরণের চেষ্টাই কেবল পারে হৃদয়রাজ্যের পুঞ্জীভূত অন্ধকারকে দূর করে শাশ্বত আলোয় আলোকিত করতে। নব্য জাহিলিয়াতের ক্লেদ-আবর্জনা যা আমাদের আপন পরিচয় ভুলিয়ে দিয়েছে তা থেকে মুক্ত হতে পারে বর্তমান পৃথিবী।
লেখক : একটি বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক ঊর্ধ্বতন নির্বাহী