মিসর কি তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে?

মাসুম খলিলী | Jul 23, 2020 07:14 pm
মিসর কি তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে?

মিসর কি তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামবে? - ছবি : সংগ্রহ

 

মিসরের নতুন সম্পৃক্ততা

জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত সরকারের সেনাবাহিনী খলিফা হাফতারের নিয়ন্ত্রণাধীন কৌশলগত সির্তে শহরের কাছাকাছি পৌঁছার পরে মিসরীয় সংসদে লিবিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর বিষয় অনুমোদনের ঘটনা ঘটেছে। মিসরের সংসদের সেরকম আলাদা কোনো গুরুত্ব না থাকায় দেশটির রাষ্ট্রপতি সিসি লিবিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের কথা বলার পরেই সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংসদে প্রস্তাব অনুমোদনের পর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মিসরের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে সীমান্তের বাইরে যুদ্ধ মিসনে মিসরীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের অনুমোদন দিয়েছে।’

সংসদের এই ভোটাভুটির কিছুক্ষণ আগে সিসি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফোনে কথা বলেছেন। এরপর হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘দুই দেশের নেতারা যুদ্ধবিরতি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আলোচনার অগ্রগতির মাধ্যমে লিবিয়ার সঙ্ঘাত তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।’
হোয়াইট হাউজ বলেছে, ট্রাম্প ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমমানুয়েল ম্যাক্রনকে ফোনে বলেছিলেন যে বিদেশী বাহিনী এবং অস্ত্রের উপস্থিতি দ্বন্দ্বকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক সাংবাদিকদের বলেছেন : ‘লিবিয়ায় বর্তমান সঙ্কটের কোনো সামরিক সমাধান নেই এবং অবশ্যই তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি হওয়া উচিত।’

প্রক্সি যুদ্ধ চাঙ্গা হবে?
বলা হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত লিবিয়ার সরকারি বাহিনী যে কেন্দ্রীয় শহর সির্তের কাছে চলে গেছে এবং তারা হাফতারের অবৈধ মিলিশিয়া যে থেকে পুনরায় দখল করার চেষ্টা করছে সেটি লিবিয়ার বিশৃঙ্খল প্রক্সি যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে সমর্থনকারী মিসর ও তুরস্কের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সরাসরি লড়াইয়ে ডেকে আনতে পারে। সিসি কৌশলগত উপকূলীয় শহর সির্তেকে ‘রেডলাইন’ হিসেবে অভিহিত করে আগেই সতর্ক করেন যে, এই শহরে যেকোনো আক্রমণই কায়রোকে তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে প্ররোচিত করবে।

মিসর শুরু থেকেই পূর্বাঞ্চলভিত্তিক হাফতারের মিলিশিয়াকে সমর্থন করে আসছে আর তুরস্ক পশ্চিমে ত্রিপোলিতে ইউএন-সমর্থিত সরকারকে সমর্থন করে। মিসরের পাশাপাশি খলিফা হাফতারকে সংযুক্ত আরব আমিরাত আর রাশিয়াও সমর্থন দেয়। অন্য দিকে, তুরস্ক ছাড়াও ত্রিপোলি বাহিনীকে কাতার ও ইতালি সহায়তা করে।
খলিফা হাফতারের মিলিশিয়ারা গত বছরের এপ্রিলে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের কাছ থেকে ত্রিপোলি দখলের জন্য আক্রমণ শুরু করেছিল। কিন্তু লিবিয়ার রাজধানীর উপকণ্ঠে পৌঁছার পর তা অচল হয়ে পড়ে। আর গত মাসে ত্রিপোলি সরকার মিত্র তুরস্কের সহায়তায় পাল্টা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর, শহরের সব প্রধান প্রবেশদ্বার ও প্রস্থানপথ এবং এই অঞ্চলের মূল নগরগুলোর একটি পুনরুদ্ধার করে। এখন আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে মধ্যাঞ্চলের কৌশলগত নগরী সির্তে দখল করতে চাইছে। এটি সম্ভব হলে লিবিয়ার সরকারি বাহিনীর পক্ষে আরো পূর্বের দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর হাফতারের নিয়ন্ত্রণ থেকে অত্যাবশ্যকীয় তেল স্থাপনা, টার্মিনাল এবং ক্ষেত্রগুলো দখল করে নিতে পারবে জিএনএ বাহিনী।

তুরস্কের সংশ্লিষ্টতা
লিবিয়ায় রাজনৈতিক সমাধানকেই তুরস্ক সমর্থন করে। তবে এই প্রক্রিয়া থেকে হাফতারের বিদায় কামনা করে। গত ২০ জুলাই আঙ্কারায় তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার লিবিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেথি বাসাগা এবং মাল্টার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাইরন ক্যামিলারির সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। আঙ্কারায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শেষে তারা লিবিয়ায় যুদ্ধবাজ খলিফা হাফতারের প্রতি সমর্থন অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এটি বেশ অবাক করা বিষয় যে নন-ন্যাটো রাশিয়া এবং ন্যাটো-সদস্য ফ্রান্স একই সমান্তরালে ন্যাটো সদস্য তুরস্কের বিরুদ্ধে এসে দাঁড়িয়েছে। লিবিয়ার জটিল দ্বন্দ্বের সাথে অনেক দেশই জড়িত। এর ফলে সব পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট প্রক্সি যুদ্ধের সূচনা হচ্ছে। তবে লিবিয়ায় তাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের গভীর প্রভাবের কারণে মিসর এবং তুরস্ক দেশটির সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত।

দুই দেশের সমুদ্রসীমা সীমানা নির্ধারণে গত বছর একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর লিবিয়ার জাতীয় সমঝোতা (জিএনএ) সরকারকে সমর্থন করতে তুর্কি সামরিক সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিকল্পিত অনুসন্ধানে তুরস্ক নিজের জন্য বৃহত্তর ভূমিকা নিতে চায় এবং জিএনএবিরোধী মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, রাশিয়া, ফ্রান্স এমনকি গ্রিস দ্বারা সমর্থিত খলিফা হাফতারের বাহিনীকে দুর্বল করতে চায়।

মার্কিন নীতির বিভ্রান্তি!
কৌশলগত স্বার্থ সেভাবে না থাকায় লিবিয়ায় মার্কিন অবস্থান বা ভূমিকা সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ওয়াশিংটন লিবিয়াকে তার সামরিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রান্তসীমায় ঠেলে দিয়েছে, কিন্তু রাশিয়ার এই সঙ্ঘাতের ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব মার্কিন অবস্থানকে বদলে দিতে পারে বলেও অনেকেই মনে করছেন। আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও তুরস্ক জিএনএকে সমর্থন করছে, অন্যদিকে ফ্রান্স গ্রিস ও মিসর হাফতার বাহিনীকে সমর্থন করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব হাফতারকে সমর্থন করলেও রিয়াদ মৌখিক সহায়তার চেয়ে বেশি কিছু করছে বলে দেখা যাচ্ছে না; যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেপরোয়া ভূমিকা নিচ্ছে।

কায়রো-আঙ্কারার সক্ষমতা

লিবিয়ায় মুখোমুখি দুই পক্ষ তুরস্ক এবং মিসরের সেনাবাহিনীর এফ-১৬ বিমানসহ শত শত অন্য যুদ্ধবিমান রয়েছে। মিসরীয় সেনাবাহিনী হাজার হাজার ট্যাংক নিয়ে কাগজে-কলমে বিশ্বের নবমতম শক্তিশালী। তুরস্ক রয়েছে একাদশ স্থানে। তবে সম্ভবত ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় তুর্কি বাহিনীকে মিসরের চেয়ে বেশি কার্যকর মনে করা হয়। অবশ্য এই তত্ত্বগত আলোচনার বাইরে বাস্তবে, ক্ষমতা এবং কার্যকারিতার মধ্যে একটি বিস্তৃত ফাঁক আছে। মিসর দীর্ঘকাল বাইরের কোনো সঙ্ঘাতের জন্য পরীক্ষিত হয়নি আর প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ঘরে বসে দুর্বল সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। গত সাত বছর ধরে সিনাই উপদ্বীপে দায়েশ বাহিনীর সাথে এর সঙ্ঘাত চলছে, কিন্তু ৭০০০-এরও কম যোদ্ধাসম্বলিত সীমিত বিদ্রোহও নির্মূল করতে পারেনি। অন্য দিকে, বিদ্রোহের মুখে তুরস্কের অভিজ্ঞতা এবং কার্যকারিতা অনেক বেশি প্রমাণিত হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী বহু বছর ধরে সিরিয়ায় জড়িত ছিল এবং কুর্দি পিকেকে বাহিনীকে তারা মোকাবেলা করছে। তুর্কি বাহিনী আইএসকেও শক্তিশালীভাবে মোকাবেলা করেছিল।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us