তুরস্ক-মিসর যুদ্ধ হবে?

মাসুম খলিলী | Jul 23, 2020 06:59 pm
তুরস্ক-মিসর যুদ্ধ হবে?

তুরস্ক-মিসর যুদ্ধ হবে? - ছবি : সংগ্রহ

 

তুরস্কের কৌশলগত লাভ 

আঙ্কারা সম্ভবত তার সামরিক বিজয়গুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুনির্দিষ্ট আর্থিক, কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক লাভে অনুবাদ করার চেষ্টা করবে। কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক স্তরে এটি যত দ্রুত সম্ভব এয়ার (আল-ওয়াতিয়া) এবং নৌ (মিগ্র্যাট) উভয় ঘাঁটি স্থাপন এবং পরিচালনা করার চেষ্টা করবে। তুরস্কের কার্গো বিমানগুলো ইতোমধ্যে আল-ওয়াতিয়া বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।

আর্থিক ও জ্বালানি দিক থেকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং অবকাঠামো ও নির্মাণ প্রকল্পে প্রধান ভূমিকা নিতে আগ্রহী আঙ্কারা। আঙ্কারা লিবিয়ায় নিরাপত্তা খাত সংস্কারে সহযোগিতা করতে চায়, লিবিয়ান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং জিএনএকে বিদ্যুতের মতো প্রাথমিক পরিষেবা সরবরাহ করতে সহায়তা করতে চায়।

জিএনএ এখনও প্রমাণ করতে পারেনি যে, এটি লিবিয়ার কেবল যুদ্ধবিরোধী অন্য একটি দল নয়, সুসংগঠিত সরকার হিসেবে এটি কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারে সর্বাধিক পরীক্ষাটি হবে প্রশাসনের ক্ষেত্রে জিএনএর সক্ষমতা এবং সদ্য অর্জিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের চিকিৎসাসহ মৌলিক পরিষেবাদির নিশ্চিতকরণের মধ্যে।
লিবিয়ার তেল অর্ধচন্দ্রের নিকটবর্তী সির্তে এবং জুফ্রার ভবিষ্যৎ তুরস্ক এবং রাশিয়া আমিরাত-মিসর জোটের মধ্যে বিরোধের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের সমর্থনে জিএনএ সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, আর তুরস্ক যে কোনো যুদ্ধবিরতির পূর্বশর্ত হিসেবে এলএনএ বাহিনীকে এই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্ক এবং মস্কোর সামরিক উপস্থিতি বিবেচনায় সিরিয়া ও লিবিয়ার দ্বন্দ্বের পরস্পর সংযুক্ত প্রকৃতির কারণে আঙ্কারা রাশিয়ার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আঙ্কারার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য এই অঞ্চলগুলো থেকে এলএনএ’র পশ্চাৎপসরণ।

আঙ্কারার লাল রেখা
সির্তে এবং জুফরার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যখন আসে তখন তুরস্ক জিএনএ’র সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে বিভিন্ন বিকল্পের বিষয়টিও যুক্তিযুক্তভাবে বিবেচনায় রাখবে। এই অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসন বা কোনো আন্তর্জাতিক বাহিনীর উপস্থিতি জিএনএ বা এলএনএ দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প হতে পারে। তবে এখানকার এলএনএ’র নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের জন্য প্রধান লাল রেখা বলে মনে হয়।

এই ক্ষেত্রে, সামরিক হস্তক্ষেপের মিসরীয় হুমকি আঙ্কারায় উচ্চপর্যায়ের উদ্বেগের কারণ বলে মনে হচ্ছে না। যদিও মিসরীয় হস্তক্ষেপ বা একটি ভুল গণনাযোগ্য পদক্ষেপের বিষয়টি একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কারণ মিসর তার জনগণের সামনে দেয়া প্রতিশ্রুতি ও হুমকির পরে সির্তে-জুফ্রার ওপর সামরিক আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হতে পারে। তবে সম্ভবত এটি সীমিত, প্রতীকী এবং আরো বেশি হবে স্থল অভিযানের চেয়ে বিমান হামলার রূপে।

অন্য দিকে, দুই মার্কিন সহযোগী, আঙ্কারা এবং কায়রোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় সঙ্ঘাত আমেরিকার জন্য মধ্যস্থতা করার চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুরস্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ইতালি লিবিয়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, অন্য দিকে তুরস্ক-ফ্রান্সের মধ্যকার বৈরিতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তর আফ্রিকা এবং লিবিয়া বিশেষত পূর্ব ভূমধ্যসাগর, সাহেল এবং সিরিয়া বিতর্কিত ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্র বাড়ছে। জার্মানির মতো ফ্রান্সে তুরস্কের বিশাল জনগোষ্ঠী নেই, তাই তুরস্কের জন্য প্যারিসের প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণে কোনো দেশীয় রাজনৈতিক ব্যয় নেই। আর এই কলহ লিবিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে অনেক ঝামেলা সৃষ্টি করবে।

প্রত্যক্ষ যুদ্ধ কি হবে?
তুরস্ক ও মিসর দুই পক্ষই সির্তে ও জুফ্রাকে লাল রেখা হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক সঙ্ঘাতে জড়ানোর হুমকি দিয়ে এলেও কোনো দেশই এখানে সরাসরি লড়াইয়ে লিপ্ত হতে চায় বলে মনে হয় না। এ কারণে দুই পক্ষই রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সঙ্কটের সমাধান করার কথা বলছে। জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় এ ধরনের আলোচনার শুরু এবং যুদ্ধবিরতির পথে মূল বাধাটিই হলো সির্তে ও জুফ্রার নিয়ন্ত্রণ। উপরে যে তৃতীয় বিকল্প অর্থাৎ সির্তে ও জুফ্রার নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক বাহিনীর হাতে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে এলএনএ বাহিনীর প্রত্যাহার অথবা জিএনএ ও এলএনএ’র যৌথ উপস্থিতি নিশ্চিত করার মতো কোনো ফর্মুলায় উভয়পক্ষ সম্মত হলে সামরিক সঙ্ঘাত এড়ানো যেতে পারে। এরপর আলোচনার মাধ্যমে লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে। সেই সম্ভাবনা এখনো অনেক বেশি এ কারণে যে, সিসি যতই যুদ্ধে জড়ানোর হুমকি দিক না কেন মিসরের সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এখন একবারে নি¤œ পর্যায়ে। দেশটি নিরস্ত্র নিজ দেশের জনগণের সামনে বীরত্ব দেখালেও ব্যবসাবাণিজ্য ও বিলাসী জীবনেই সেনাবাহিনীর সদস্যদের নানাভাবে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে। তুরস্কের বিষয়টি সেরকম নয়।

এরপরও ইসরাইল আমিরাত এমনকি সৌদি আরবও চাইবে লিবিয়ায় মিসরকে ডেকে এনে তুরস্কের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে দিতে। এই ফাঁকে ইসরাইল নিজের সীমান্ত স্থায়ীভাবে পশ্চিম তীর ও জর্দান উপত্যকায় সম্প্রসারণের কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে। অন্য দিকে, সিরিয়ায় রাশিয়া ইরান তুরস্কের সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে তা দীর্ঘায়িত হবে। ২০২৩ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর উসমানীয় খেলাফত ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে করা অপমানমূলক লুজান চুক্তির অবসান ঘটছে। এরপর তুরস্কের জন্য নিজেকে সীমিত করে রাখার বাধ্যবাধকতা সেভাবে থাকবে না। দেশটি তার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে বেশি সক্রিয় হতে পারবে। এ সময় আসার আগেই তুরস্কের শক্তিমত্তাকে যুদ্ধের জটিল আবর্তে জড়ানোর একটি কৌশল কোনো কোনো পক্ষের থাকতেও পারে। তবে এটিও ঠিক যে সিরিয়া এবং লিবিয়ায় সামরিক পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে তুরস্ক যে উত্তীর্ণতার প্রমাণ দিয়েছে সেটিই দেশটিকে এখন প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তির মর্যাদা এনে দিয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর ক্যানভাসেই বিবেচনা করতে হবে লিবিয়ার পরিস্থিতিকে। সেখানে আরো অনেক ঘটনা ঘটতে বাকি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, যার ওপর দেশটির ভবিষ্যৎ অবস্থার অনেকখানি নির্ভর করছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us