করোনা সঙ্কটে কোরবানি : কিছু প্রশ্ন ও জবাব
কোরবানির হাট - ছবি : সংগৃহীত
মাত্র ক’দিন পর বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বে মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা বা পশু কোরবানি উদযাপিত হবে। ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী এর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। করোনা সঙ্কটের কারণে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে এ বছর কোরবানি না করলে কী হয়? ‘পশুহাটে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় তাই পশু বেচাকেনার হাট বন্ধ রাখতে হবে অথবা কোরবানির পশুর অর্থ দরিদ্র ও বন্যাপীড়িত মানুষের মাঝে বিতরণ করা উচিত।’ এর সাথে আছে অতি পুরনো আরেকটি ‘যুক্তি’। প্রতি বছর কোরবানিতে লাখ লাখ পশু কোরবানি দেয়ার কারণে দেশে পশুসঙ্কট দেখা দেবে এবং সারা বছর দুধ ও গোশতের চাহিদায় ঘাটতি দেখা দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি। টিভি চ্যানেল ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি নিয়ে আলোচনা ও টকশোর আয়োজন করা হয়।
এতে ভিন্নধর্মের বুদ্ধিজীবীদের কোরবানির বিপক্ষে মতামত দিতে দেখা যায়। আসলে কোরবানির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় বিধিবিধানের অন্তর্ভুক্ত। সঙ্কটকালে কী করা উচিত এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন শরিয়াহ বিশেষজ্ঞরা। অন্য ধর্মের বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শ দান অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক। করোনায় আক্রান্ত রোগী মারা গেলে তারাই সবার লাশ পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা যখন ঘোষণা দিলো, লাশ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর সুযোগ নেই এবং ধর্মীয় বিধি মেনে দাফন করা নিরাপদ তখন তারা চুপসে যান। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্ম, ধর্মীয়বিধি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার প্রবণতা পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কম।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিরাপদ দূরত্বে হাটবাজারে পশু বেচাকেনার ব্যবস্থা করা কর্তৃপক্ষের জন্য মোটেই অসুবিধাজনক হওয়ার কথা নয়। ইতোমধ্যে দৈনিক ও সাপ্তাহিক হাটবাজারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নিয়ম চালু হয়েছে। গ্রাহক ও বেপারিদের হাটে একপথ দিয়ে ঢুকে অন্য পথে বের হওয়ারও ব্যবস্থা করা যায়। অনলাইনে পশু বেচাকেনার উদ্যোগও এখন নজরে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় এটিকে ত্বরান্বিত করা যেতে পারে।
বছরের নির্ধারিত মাসে ও নির্ধারিত দিনগুলোতে পশু কোরবানি করা ওয়াজিব বা অপরিহার্য। এটিকে বিলম্বিত করার সুযোগ নেই। বিধিসম্মত ও যৌক্তিক কোনো কারণে নির্ধারিত দিনগুলোতে কোরবানি করতে সক্ষম না হলে ওই পশুর অর্থ অভাবগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিলিয়ে দিতে হয়। কোরবানি না করে কোরবানির পশুর অর্থ দান করে দিলে কোরবানির ওয়াজিব আদায় হবে না। দান ও কোরবানি পৃথক পৃথক ইবাদত। একে অপরের পরিপূরক নয়।
দেড় হাজার বছর ধরে লাখ লাখ গরু, ছাগল ও মহিষ কোরবানি দেয়ার পরও বাজারে হালাল পশুর অভাব দেখা যায়নি। গোশতের চাহিদায় ঘাটতি হয়নি। দুধের সঙ্কটও সৃষ্টি হয়নি। সারা বছর ধরে গোটা বাংলাদেশের হাটবাজারে হালাল পশু জবাই করে বেচাকেনা করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সমাজে যে জিনিসের চাহিদা থাকে, তার উৎপাদন, আমদানি ও বিপণনও বৃদ্ধি পায়।
কোরবানির ধর্মীয় দিক যেমন আছে, তেমনি আছে অর্থনৈতিক ও মানবিক তাৎপর্যও। মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ- এ তিনটি দিনে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট নিয়মে হালাল পশু জবাই করাই কোরবানি। ত্যাগ, তিতিক্ষা ও প্রিয়বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করাই কোরবানির তাৎপর্য। প্রচলিত কোরবানি হজরত ইবরাহিম আ:-এর অপূর্ব আত্মত্যাগের ঘটনারই স্মৃতিবহ। হাদিসে বর্ণিত আছে : ‘রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কোরবানি কী? তিনি বলেন, এটি তোমাদের পিতা ইবরাহিম আ:-এর সুন্নাত। তাঁরা বলেন, এতে আমাদের কি কল্যাণ নিহিত আছে? জবাবে তিনি বলেন, এর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি করে নেকি রয়েছে। নেক আমলগুলোর মধ্যে কোরবানি একটি বিশেষ আমল। এ কারণেই রাসূলুল্লাহ সা: সবসময় কোরবানি করেছেন এবং সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি বর্জনকারী ব্যক্তির প্রতি তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন। মহানবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’
দেশের বিভিন্ন উপজেলায় উন্নতজাতের পশুর খামার গড়ে উঠেছে। এতে রয়েছে খামারিদের কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ। এমনকি প্রতিটি গ্রামে মানুষ পশু পালন করে থাকেন। তারা কোরবানির অপেক্ষায় থাকেন। পশু বিক্রি করে জরুরি ব্যয় নির্বাহ করবেন, এমন পরিকল্পনা বহু পরিবারের থাকে। আছেন লাখ লাখ বেপারি। তারা বিপুল টাকা বিনিয়োগ করে খামারিদের কাছ থেকে পশু কিনে ট্রাকে করে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নিয়ে যান লাভের আশায়। পশুর চামড়া থেকেও আসে অনেক টাকা। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে সিন্ডিকেটের কারণে এই খাতে ধস নেমেছে। এক কথায় কোরবানিকে কেন্দ্র করে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়। অর্থনীতির চাকা হয় সচল। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে চামড়া খাত থেকে আয় হয়েছে ৮৩ কোটি ৭১ লাখ ডলার।
কোরবানির মাধ্যমে জনগণের পুষ্টির চাহিদা যেমন পূরণ হচ্ছে, তেমনি চামড়ার উৎপাদনও বাড়ে। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া মিলিয়ে দেশে কোরবানি দেয়া হয় প্রায় এক কোটি ১৬ লাখ পশু। এ ছাড়া কোরবানিদাতারা গোশতের একটি অংশ গরিব, দুঃখী ও অভাবগ্রস্তদের দান করে দেন। এতে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ লাভবান হয়। তাই কোরবানির তাৎপর্য ও অবদান অনেক। ইতোমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পশুহাট ইজারা প্রদান, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার গাইডলাইন তৈরি, বর্জ্য অপসারণ এবং ট্রেনযোগে কোরবানির পশু গ্রাম থেকে শহরে আনা নেয়ার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
কোরবানির এই ফজিলত হাসিল করতে হলে প্রয়োজন ওই আবেগ, অনুভূতি, প্রেম-ভালোবাসা ও নিষ্ঠা; যা নিয়ে কোরবানি করেছিলেন আল্লাহর খলিল বা বন্ধু হজরত ইবরাহিম আ:। কেবল গোশত ও রক্তের নাম কোরবানি নয়; বরং আল্লাহর রাহে নিজের সম্পদের একটি অংশ বিলিয়ে দেয়ার এক দৃপ্ত শপথের নাম কোরবানি। নিছক গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করা হলে তা আল্লাহর কাছে কবুল হবে না। কেননা আল্লাহ তায়ালার কাছে গোশত ও রক্তের কোনো মূল্য নেই। মূল্য আছে তাকওয়া, পরহেজগারি ও ইখলাসের। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহর কাছে কখনো জবাইকৃত পশুর গোশত ও রক্ত পৌঁছবে না, পৌঁছবে কেবল তাকওয়া।’ (সূরা হজ : ৩)
অতএব, আমাদের একান্ত কর্তব্য, খাঁটি নিয়তসহকারে কোরবানি দেয়া এবং তা থেকে শিক্ষার্জন করা। নিজেদের আনন্দে অন্যদের শরিক করা ঈদুল আজহার শিক্ষা। কোরবানি করা পশুর গোশত তিন অংশে ভাগ করে এক অংশ নিজের জন্য সংরক্ষণ, দ্বিতীয় অংশ আত্মীয়স্বজনকে দেয়া এবং তৃতীয় অংশ অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্র মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেয়াই ইসলামের বিধান। কোরবানি করা পশুর চামড়া অনাথ আশ্রম, এতিমখানা ও মাদরাসায় পড়–য়া দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ভরণপোষণের জন্য দিলে দ্বিবিধ সওয়াব হাসিল হয়। এক. দুঃখী মানুষের সাহায্য এবং দুই. দ্বীনি শিক্ষার বিকাশ। প্রকৃতপক্ষে কোরবানিদাতা কেবল পশুর গলায় চুরি চালান না, বরং ছুরি চালান সব প্রবৃত্তির গলায় আল্লাহর প্রেমে অধীর হয়ে। এটিই কোরবানির মূল নিয়ামক ও প্রাণশক্তি। এ অনুভূতি ব্যতিরেকে যে কোরবানি করা হয়, তা হজরত ইবরাহিম ও ইসমাইল আ:-এর সুন্নাত নয়, এটি এক রসম তথা প্রথা মাত্র। এতে গোশতের ছড়াছড়ি হয় বটে; কিন্তু ওই তাকওয়া হাসিল হয় না যা কোরবানির প্রাণশক্তি। পশু কোরবানির মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে বিরাজমান পশুশক্তি, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদি রিপুগুলোকেই কোরবানি দিতে হয়। আর হালাল অর্থে অর্জিত পশু কোরবানির মাধ্যমে এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। আমরা চাই ব্যক্তি, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সব অনিশ্চয়তা-শঙ্কা দূর হোক। হিংসা, হানাহানি ও বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে কোরবানির আনন্দে শামিল হয়ে সবার মধ্যে সাম্য ও সহমর্মিতার মনোভাব জেগে উঠুক।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।