কোরবানি যেভাবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে
কোরবানির হাট - ছবি : সংগৃহীত
ঈদুল আজহা উপলক্ষে ধনীরা কোরবানির পশু ক্রয় করে বিপুল অর্থ খরচ করে ও গোশত খাওয়ার উৎসব করে আর দরিদ্ররা গবাদিপশু বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে, ব্যাপারটি এতটা হালকা করে দেখলে কোরবানির মহত্ত্ব, শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পাবে। মহান আল্লাহ এই কোরবানির বিধানের পেছনে মানব জাতির জন্য যে কল্যাণ ও বরকত রেখেছেন তা থেকে যাবে অজানা।
কোনো সচ্ছল ব্যক্তি যখন কোরবানি করেন তখন তিনি কোরবানির গোশতের তিন ভাগের একভাগ নিজের কাছে রাখেন (মুস্তাহাব আমল হিসেবে)। আর বাকি দুই ভাগের একভাগ আত্মীয়স্বজনের কাছে এবং বাকি এক ভাগ দরিদ্রদের ঘরে পৌঁছে দেন। কোনো সচ্ছল ব্যক্তি যদি ৯০ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কোরবানি করে তাহলে ৬০ হাজার টাকার গোশতই ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে অন্যদের কাছে চলে যায়, যার মধ্য থেকে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকার গোশত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ঘরে পৌঁছে যায়। অনেক ধনী ব্যক্তি রয়েছেন যারা কোরবানির গোশতের সামান্যই নিজে ভক্ষণ করেন; বরং বেশির ভাগ অথবা পুরোটাই দরিদ্রদের মাঝে বিলি করে দেন। যেসব গরিব মানুষ বছরে একবারের জন্যও বাজার থেকে গোশত বা আমিষ কিনে খাওয়ার সামর্থ্য রাখেন না, অপুষ্টিতে ভোগেন তারা এই কোরবানির উৎসব উপলক্ষে আল্লøাহ তায়ালার মেহমান হিসেবে আপ্যায়িত হওয়ার ও গোশতের স্বাদ নেয়ার সুযোগ লাভ করেন। এর মাধ্যমে সামাজিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায় এবং আত্মীয়স্বজন ও ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় হয়।
তা ছাড়া, কোরবানির পশু যারা লালন-পালন করেন এবং ঈদের সময় কোরবানির পশু বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করেন তাদের বেশির ভাগই গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী তথা কৃষক, শ্রমিক ও খেটে খাওয়া মানুষ। যারা কোরবানির সময় একটু বাড়তি মূল্যে বিক্রি করার জন্য সারা বছর খেয়ে না খেয়ে একটি বা দুটি মাত্র পশু লালন পালন করেন। এই অর্থ দিয়ে তিনি হয়তো একখণ্ড কৃষিজমি ক্রয় করবেন বা ইজারা নেবেন অথবা ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাড় করবেন অথবা ছেলেকে বিদেশ পাঠাবেন অথবা ছোটখাটো একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য পুঁজি জোগাড় করবেন অথবা তার নড়বড়ে ঘরটি মেরামত করবেন অথবা ছেলেমেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করবেন অথবা স্ত্রীর ডেলিভারি বা অন্য কোনো অসুস্থতাজনিত অপারেশনের ব্যয় নির্বাহ করবেন। এটি একজন নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলে শেষ করা যাবে না। আর এত সব উদ্দেশ্যে পুরো একটি বছর লালন-পালন করার পর যদি কোনো পশু পালনকারী তার পশুটি কোরবানির হাটে বিক্রি করতে না পারেন তাহলে তার এই ক্ষতি পোষানোর দায়িত্ব কে নেবে? কোরবানি সম্পর্কে নিরুৎসাহিত করার আগে এ বিষয়গুলো আমাদের চিন্তা জগতে থাকা প্রয়োজন।
তা ছাড়া, এই কোরবানির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে লাখো মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন। পশুপালনের সাথে জড়িত সব শ্রমিক, ঘাস-দানাচাষি, পশুখাদ্যের ব্যবসায়ী, পশুচিকিৎসার সাথে জড়িত ব্যক্তি, ওষুধ কোম্পানি ও ওষুধ বিতরণের সাথে জড়িত হাজারও মানুষ এর সাথে জড়িত।
এই কোরবানির সাথে জড়িত রয়েছে দেশের পরিবহন মালিক ও হাজারো শ্রমিকের রিজিকের প্রশ্ন। ঈদ উপলক্ষে শহরের মানুষ আপনজনের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য গ্রামে ছুটে চলে। কোরবানির পশু ও গোশত পরিবহন করে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে পরিবহন সেক্টরের চাঞ্চল্য বলার অপেক্ষা রাখে না। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঈদ উপলক্ষে পরিবহন সেক্টরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার বাড়তি লেনদেন হয়ে থাকে। এটি অর্থনীতিতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।
গত ১৬ জুলাই ২০১৯ প্রকাশিত প্রথম আলো পত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে, ঈদুল আজহায় এক কোটি ১০ লাখ পশুর কোরবানি হতে পারে বলে জানানো হয়েছিল। এ বছরও যদি গত বছরের সংখ্যা ধরে নেই এবং এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ গরু-মহিষ ও এক-তৃতীয়াংশ ছাগল-ভেড়া কোরবানি হবে বলে ধরে নিই, তাহলে গরুর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৩ লাখ এবং ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা হবে ৩৩ লাখ।
প্রতিটি গরু-মহিষের গড় মূল্য ৫০ হাজার টাকা ধরলে এই গরু-মহিষ বাবদ লেনদেন হবে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং গড়ে ১০ হাজার টাকা দরে ৩৩ লাখ ছাগল-ভেড়া বাবদ লেনদেন হবে তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা। তাহলে দেখা যায়, পশু কোরবানি উপলক্ষে এ বছর প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন হবে। কোরবানির পশুর সরবরাহ ও কেনাবেচার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়Ñ চাঁদা, টোল, বকশিশ, দালাল, পশুর হাট ইজারা, হাসলি, ছামিয়ানা, বাঁশ-খুঁটির ব্যবসা, পশুর খাবার-দাবার, পশু কোরবানি ও গোশত প্রস্তুত করা বাবদও বিপুল অর্থ হস্তান্তর হয়ে থাকে। এ সব কিছুর পেছনেই খেটে খাওয়া মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন জড়িত।
দেশের চামড়াশিল্প অনেকাংশেই কোরবানির পশুর চামড়ার ওপর নির্ভরশীল। কোরবানির পশুর চামড়া আমাদের অন্যতম প্রধান রফতানি পণ্য, যার মাধ্যমে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের রিজার্ভে যোগ হয়। তা ছাড়া জুতাশিল্প, চামড়াভিত্তিক নানান ধরনের শিল্পে কোরবানির পশুর চামড়ার ওপর নির্ভরশীল। এই চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিক্রি ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এই চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণের সাথে কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও লেনদেন জড়িত রয়েছে। ব্যাংকগুলো প্রতি বছর প্রায় ১৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে থাকে। এই চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে আমাদের লবণশিল্পও লাভবান হয়।
ঈদ উপলক্ষে ব্যাংকগুলোর কর্মচাঞ্চল্যও চোখে পড়ার মতো। এ সময় রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। প্রবাসে থাকা বাংলাদেশীরা পরিবার-পরিজন ও দরিদ্র আত্মীয়দের কোরবানির ঈদ উপযাপনের জন্য বিপুল অর্থ পাঠিয়ে থাকেন। চামড়া ক্রয়ের জন্য বিনিয়োগ, বিতরণ, ঈদ বোনাস, শিল্প শ্রমিকদের বেতভাতা বিতরণ ইত্যাদি বাবদ ব্যাংকগুলোতে ব্যস্ততা বেড়ে যায়। আর ব্যস্ততা মানেই রিজিকের সংস্থান, অর্থনীতির গতিশীলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি আর দরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়ন। অর্থনীতির গতিপ্রবাহে যেকোনো ব্যয়ই অর্থনীতির জন্য আয় হিসেবে গণ্য হয়।
কোরবানিকে কেন্দ্র করে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ ও আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তা স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়া হলে এবং এটি সমন্বিতভাবে দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে তা যেমন দেশের অর্থনীতির জন্য আরো সুফল বয়ে আনবে, তেমনি তা সমাজের ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে হৃদ্যতা সৃষ্টি, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ, গরিব জনগোষ্ঠীর জীবনে আনন্দ-খুশির সুযোগ সৃষ্টিসহ নানা ক্ষেত্রে আরো কল্যাণ ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারে।
লেখক : তুলনামূলক ফিকহ, দাওয়াহও ইসলামিক ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ এবং শরিয়াহপরিদর্শক, শাহইসলামী ব্যাংক লিমিটেড।
ইমেইল : mizanbd2004@gmail.com