চীন-ইরান জোটে পাকিস্তানের লাভ!
ইমরান, শি ও রুহানি - ছবি : সংগৃহীত
খবরে প্রকাশ, চীন ও ইরান ৪০০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। ইরান তার একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ দেয়ার গুঞ্জনের মধ্যে এই খবর প্রকাশিত হলো।
এই দুই ঘটনা পাকিস্তানের জন্য তাৎপর্য। কারণ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ চীনের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং তার পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলে ভারতের বিনিয়োগকে তার জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখে।
ইসলামাবাদের নীতিনির্ধারকেরা পূর্ব সীমান্তে লাইন অব কন্ট্রোলে (এলওসি) ভারতের সাথে উত্তেজনার মধ্যে এর চেয়ে ভালো কোনো খবর আশা করতে পারে না। অধিকন্তু, ইসলামাবাদ মনে করে, ইরানে বেইজিংয়ের ক্রমবর্ধমান অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে বেলুচিস্তানে নয়া দিল্লির কথিত হস্তক্ষেপ সংযত করার সাথে সম্পর্কিত হিসেবে।
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, পাকিস্তান ঘটনাটিকে ইরানের সাথে গভীরতম সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সুযোগ হিসেবে দেখছে। ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তান ও ইরানের দ্বিপক্ষীয সম্পর্ক উত্তেজনাকর থাকার কারণ প্রধানত সৌদি আরবের সাথে ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে দুই দেশের সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য পাকিস্তান চেষ্টা চালিয়েছে। এই প্রয়াসের অংশ হিসেবে ইরান সীমান্তে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি অবস্থা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। অবশ্য এ ধরনের চেষ্টার তাগিদ চীনের পক্ষ থেকেও আসতে পারে। কারণ পাকিস্তান-ইরান সীমান্ত অঞ্চলকে চীন তার বৈশ্বিক বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অনিবার্য অংশ বিবেচেনা করে।
পাকিস্তান ২০১৮ সালে ইরান-সমর্থিত শিয়া হুদি বিদ্রোহী বাহিনীর বিরুদ্ধে সৌদি-নেতৃত্বাধীন অভিযানে অংশ নিতে ইয়েমেনে সৈন্য পাঠানোর বিয়াদের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। গত বছর ইরান বিরল পদক্ষেপ হিসেবে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিলে ভারতের ভূমিকার নিন্দা করে। মুসলিমবিশ্বের বেশির ভাগ অংশ যখন কাশ্মির প্রশ্নে ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়াতে অস্বীকার করেছিল, তখন ইরানের এই অবস্থানকে পাকিস্তান ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে। ইসলামাবাদ এটাও মনে করে যে এই নিন্দার মাধ্যমে তেহরান এই আশ্বাস দিচ্ছে যে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে নয়া দিল্লির সাথে সম্পর্ক বিকাশ করার ব্যাপারে আগ্রহী নয় ইরান।
অতীতে উগ্রপন্থী গ্রুপগুলো উভয় দেশের সীমান্তে সৈন্যদের টার্গেট করার মাধ্যমে দুই দেশের সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালাত। অবশ্য পাকিস্তান ও ইরান সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করতে পারেনি, এমন কোনো ঘটনা নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেলুচিস্তান সীমান্তে বেলুচ সন্ত্রাসী গ্রুপ পাকিস্তানি সীমান্ত সৈন্যদের টার্গেট করলে পাকিস্তান সেনাপ্রধান সরাসরি ইরানের সামরিক প্রধানের কাছে সহায়তা কামনা করেন। কয়েক মাস আগে পাকিস্তান ও ইরান তাদের সীমান্ত সমস্যাগুলো সমাধানে একটি চুক্তিতে সই করে। উভয় দেশই ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকার উগ্রবাদী হুমকি মোকাবিলা করার জন্য একটি যৌথ র্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্স গঠনের কথা ঘোষণা করে।
এতে বোঝা যাচ্ছে, ইরান-পাকিস্তান সীমান্ত অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি চীন থেকে দৃঢ় সমর্থন পাওয়া যাচ্ছিল। কারণ চীনের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ সম্পর্কিত ছিল ইরান-পাকিস্তান সীমান্তের স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ অবস্থার ওপর। আর ইরানের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের অর্থ পাকিস্তানের জন্য এই যে ইসলামাবাদ এখন আরো ভালোভাবে বেলুচিস্তানে তার নিরাপত্তা স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পারবে, এবং ইরানকে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে। গত সপ্তাহে এক টুইটে পাকিস্তানে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী হোসাইনি বলেন, ইরান-চীন ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতা কর্মসূচির একটি পরিষ্কার রোডম্যাপ রয়েছে।
অতীতে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব সিপিইসিতে যোগ দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, পাকিস্তানের সাথে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বাড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। ইরানের সাথে চীনের প্রস্তাবিত অংশীদারিত্ব বিআরআইয়ের অধীনে হতে যাচ্ছে। আর বিআরআইয়ের লক্ষ্য হলো পাকিস্তানভিত্তিক সিপিইসির মাধ্যমে ইউরোপের সাথে মধ্য এশিয়া ও আফগাস্তিানকে সংযুক্ত করা।
বিআরআই ও সিপিইসিতে ইরানের আনুষ্ঠানিক অন্তর্ভুক্তির ফলে পাকিস্তানের জ্বালানি সঙ্কটের অবসানও ঘটতে পারে। ইরান তার বিদ্যুৎ রফতানি করতে পারে পাকিস্তানে। পরিমাণটি হতে পারে তিন হাজার মেগাওয়াট।এদিকে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত ইরান-পাকিস্তান গ্যাস পাইপলাইনের ইরানি অংশের কাজও তেহরান সম্প্রতি শেষ করেছে। এটাকে শান্তির পাইপলাইন নাম দেয়া হয়েছে। এটি চীন-ইরান বাণিজ্য চুক্তিকে সংহত করবে বলে আশা করা হচ্ছে। খবরে প্রকাশ সিপিইসি রুপে চীনের জন্য একটি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) পাইপলাইন নির্মাণ করার পরিকল্পনা করছে ইরান। পাকস্তিান, চীন ও ইরানের অংশীদারিত্বের মধ্যে জ্বালানি মাত্রাটি দক্ষিণ এশিয়ার একীভূতকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে।
নিরাপত্তাগত দিক থেকে বলা যায়, সিপিইসি ও পাকিস্তানে চীনা স্বার্থ সুরক্ষায় ইরানের কাছ থেকে এখন আরো বেশি সহায়তা পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য বেলুচ বিদ্রোহীরা এসব স্বার্থের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে ও ভারত বিরোধিতা করছে।
খবরে প্রকাশ, ইরান-চীন কৌশলগত চুক্তিটির প্রতি সমর্থন দিয়েছে ইরানের শক্তিশালী বিপ্লবী রক্ষী বাহিনী। চীন ও ইরানের মধ্যে বর্ধিত অর্থনৈতিক ও সামরিক পারস্পরিক নির্ভরশীলতা পাকিস্তান ও ইরানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে আরো বেশি সহযোগিতার পথ সৃষ্টি করবে। এই ঘটনার ফলে পশ্চিম অংশের ব্যাপারে পাকিস্তান পুরোপুরি উদ্বেগহীন থাকতে পারে।
দি ডিপ্লোম্যাট