বড়দের ছোট ভুলের পরিণাম বিশাল ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী - ছবি : সংগৃহীত
বড়দের কিছু ছোট ভুলের পরিণাম বিশাল ভয়ঙ্কর ও ধ্বংসাত্মক হয়ে দাঁড়ায়। বেশির ভাগ বড় মানুষ চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে এটি ভাবতে থাকেন, তার কোনো বিকল্প ও অদ্বিতীয় নেই। যখন কারো এ বিভ্রম ঘটে যে, তার জাতির কাছে তাকে ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ পছন্দের নেই, তখন এই মহা-উন্মাদনায় কথা হয়ে যায় উল্টাপাল্টা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ব্যাপারে অসঙ্গত ভাষা ব্যবহার করতে থাকেন। আর যখন কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী সুপরামর্শ দেন, তখন নিজ অনুষ্ঠানগুলোতে তার সম্পর্কেও এমন কথাবার্তা শুরু হয়, যে কয়েকবার শীর্ষচূড়া থেকে পতনের কারণে তা পরিণত হয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে এমন কিছু বড় মানুষ ছিলেন, যারা মহা-উন্মাদনার শিকার হয়ে ভেবেছেন যে, এখন তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ পছন্দের নেই।’ এরপর তিনি এমন ভুল করেছেন, যার পরিণাম অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক ছিল। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের শখ জাগে কায়েদে আজমের মৃত্যুর পর রাজনীতিবিদদের জবাবদিহিতার। তিনি ১৪ আগস্ট ১৯৪৯ সালে জনপ্রতিনিধিদের অযোগ্যতার বিষয়ে একটি আইন জারি করেন, যাকে প্রোডা ((Public Representative And Officers Disqualification Act) বলা হয়ে থাকে। এই আইনের মাধ্যমে তিনি পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ইফতেখার মামদোত, সিন্ধুর মুখ্যমন্ত্রী পীর ইলাহীবখশ এবং পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে মামলা দাঁড় করান। কায়েদে আজমের সাবেক প্রাইভেট সেক্রেটারি কে এইচ খুরশিদ মির্জা ১৯৪৯ সালের ১৪ আগস্ট লাহোর থেকে আজিজ বেগের সাথে যৌথভাবে ইংরেজি সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান প্রকাশ করেছিলেন।
ওই সময় লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ার্দীকে ‘পাগলা কুকুর’ বললে গার্ডিয়ান প্রধানমন্ত্রীর কঠোর সমালোচনা করে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন এই সমালোচনার কারণে গার্ডিয়ানের প্রকাশনা বন্ধ করে দেন। খুরশিদকে হুমকিও প্রদান করা হয়। অথচ তিনি কিছু দিন আগেই জম্মুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি খুব দ্রুত সাংবাদিকতায় নিজের একটা স্থান করে নিয়েছিলেন।
১৯৫০ সালে কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ অল পাকিস্তান নিউজ পেপার্স কনফারেন্সের প্রেসিডেন্ট এবং কে এইচ খুরশিদ সেক্রেটারি জেনারেল হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সরকারের প্রতিশোধমূলক আচরণের কারণে গার্ডিয়ান বন্ধ হয়ে যায়। কে এইচ খুরশিদ, যাকে কায়েদে আজম শ্রীনগর থেকে খুঁজে এনে তার প্রাইভেট সেক্রেটারি করেন এবং পাকিস্তান গঠনের পর কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য বিশেষ মিশনে শ্রীনগর প্রেরণ করেছিলেন। সেই খুরশিদের পত্রিকা সরকার বন্ধ করে দেয়। এরপর ফাতেমা জিন্নাহ কে এইচ খুরশিদকে আইন বিষয়ে পড়ালেখার জন্য ব্রিটেন প্রেরণ করেন। অন্য দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মওলানা ভাসানীর সাথে মিলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। ইফতেখার মামদোত জিন্নাহ মুসলিম লীগ গঠন করেন। আর মিয়া ইফতেখারুদ্দীন আজাদ পাকিস্তান পার্টি গঠন করেছিলেন। আইউব খুরো সিন্ধু মুসলিম লীগ গঠন করেন। কায়েদে আজমের মুসলিম লীগ কয়েক টুকরো হয়ে যায়। এরপর সোহরাওয়ার্দী ও ইফতেখার মামদোত জোট গঠন করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ মুসলিম লীগকে এক করে জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। লিয়াকত আলী খানের হত্যার পর শাসক দল মুসলিম লীগও দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯৫৩ সালে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে তাকে জিন্নাহ আওয়ামী লীগ বানিয়ে দেন।
সোহরাওয়ার্দীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেছিলেন। ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহ আওয়ামী লীগ থেকে ‘জিন্নাহ’ শব্দ বাদ দিয়ে দিলেন। ১৯৫৬ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের কারণে তার সরকার বিদায় নেয়। এটা সেই সময়ের কথা, যখন ইস্কান্দার মির্জা ভাবতেন যে, তিনি পাকিস্তানের জন্য আবশ্যকীয়। তিনি পাকিস্তানের চতুর্থ গভর্নর জেনারেল ও প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইউব খানের সাথে মিলে পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুনের সরকার ভেঙে দেন। কিছুদিন পর আইউব খান ইস্কান্দার মির্জাকেও ক্ষমতাচ্যুত এবং মার্শাল ল জারি করে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। যদি লিয়াকত আলী খান মুসলিম লীগকে অখণ্ড রাখতেন, তাহলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হতো না এবং কখনো মার্শাল ল জারি করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।
এরপর আইউব খানও নিজেকে পাকিস্তানের জন্য ‘আবশ্যকীয়’ ভাবতে লাগলেন। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিলেন এবং মুসলিম লীগকে দখল করে নেন। তার দলকে কনভেনশন মুসলিম লীগ বলা হতো। এতে জুলফিকার আলী ভুট্টোও যুক্ত ছিলেন। যারা আইউব খান কর্তৃক মুসলিম লীগের দখলদারিত্বকে মেনে নেননি, তাদের মধ্যে ছিলেন মমতাজ দৌলতানা, সরদার শওকত হায়াত, চৌধুরী মুহাম্মদ হোসাইন ছাত্তা, খাজা মুহাম্মদ সফদর, চৌধুরী জহুর ইলাহী ও খান আবদুল কাইউম খান। এই বিদ্রোহীদের দলের নাম ছিল কাউন্সিল মুসলিম লীগ। এই শীর্ষ নেতারা ফাতেমা জিন্নাহকে আইউব খানের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াইয়ে রাজি করান। ওই নির্বাচনে আইউব খানের সমর্থকরা কায়েদে আজমের এই সহোদরা সম্পর্কে সেই শব্দই ব্যবহার করেছে, যা লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্কে ব্যবহার করেছিলেন। আইউব খান এ নির্বাচনে ‘জিতে’ যান, হেরে যায় পাকিস্তান। কয়েক বছর পর তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন সঙ্ঘটিত হলে ছোটদের মুখেও আইউব খান সম্পর্কে সেই শব্দই উচ্চারিত হচ্ছিল, যা ফাতেমা জিন্নাহ এবং এর আগে সোহরাওয়ার্দীর সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়েছিল।
যারাই নিজেদের ‘অপরিহার্য আবশ্যকীয় বিকল্পহীন’ ভেবেছে তাদেরকে কোনো-না-কোনো পশুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। এরপর পশু মানুষের ওপর হামলে পড়েছে এবং পাকিস্তান ভেঙে গেছে। ১৯৭১ সালের পর অবশিষ্ট পাকিস্তান মূলত নতুন দেশ ছিল। কিন্তু এই নতুন পাকিস্তানে কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি। একটি বড় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। পীর পাগাড়ো কাউন্সিল ও কনভেনশনকে এক করে ফাংশনাল মুসলিম লীগ গঠন করেন। কিন্তু খান কাইউম ও মালিক মুহাম্মদ কাসেম তাদের মুসলিম লীগ বিলুপ্ত করেননি। জেনারেল জিয়ার মার্শাল ল’য়ের ছত্রছায়ায় এক নতুন মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। কিন্তু জিয়া যখন মুহাম্মদ খান জুনেজুর সরকারকে বরখাস্ত করেন, তখন মুসলিম লীগে জুনেজু গ্রুপ ও নওয়াজ শরিফ গ্রুপ তৈরি হলো। জুনেজু গ্রুপ থেকে ‘মুসলিম লীগ জিন্নাহ’ বেরিয়ে যায় এবং মুসলিম লীগ (এন) থেকে পারভেজ মুশাররফ মুসলিম লীগ (কিউ) সামনে নিয়ে আসেন।
এখন শেখ রশিদ আহমদ আওয়ামী মুসলিম লীগ আর এজাজুল হক মুসলিম লীগ জিয়া বানিয়ে রেখেছেন। পক্ষান্তরে মুশাররফের অল পাকিস্তান মুসলিম লীগকে অধিকাংশ মানুষ রাজনৈতিক দলই মনে করে না। বর্তমানে পাকিস্তানে তিনটি বড় দল রয়েছে। তেহরিকে ইনসাফ, মুসলিম লীগ (এন) এবং পিপলস পার্টি। তেহরিকে ইনসাফের কিছু ব্যক্তি নিজেদের পাকিস্তানের জন্য অপরিহার্য ও বিকল্পহীন ভাবতে শুরু করেছেন। দুই বছরের হতাশাজনক কার্যক্রম সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো তেহরিকে ইনসাফকে কঠিন এক সময়ের আবর্তে ফেলতে ব্যর্থ হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগের কিছু পুরাতন লোক এ প্রস্তাব নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন যে, মুসলিম লীগ (এন), মুসলিম লীগ (কিউ) ও মুসলিম লীগ ফাংশনালসহ ছোট ছোট গ্র“পকে এক করে এক নতুন মুসলিম লীগ কেন বানানো হচ্ছে না? দলকে ব্যক্তির অনুগত বানানো যাবে না, বরং ব্যক্তিকে দলের অনুগত বানাতে হবে। তাহলে কিছু বড় মানুষের এ ভ্রান্তি খুব দ্রুত কেটে যাবে, যারা ভাবেন, আমার কোনো বিকল্প নেই।
পাকিস্তানের দৈনিক জং ১৬ জুলাই ২০২০ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)