যুদ্ধের ধকল সহ্য করতে পারবে ভারত?
যুদ্ধের ধকল সহ্য করতে পারবে ভারত? - ছবি : সংগৃহীত
গত ১৫ জুন ভারত ও চীনের মধ্যকার সঙ্ঘাতে ২০ ভারতীয় ও অজ্ঞাত সংখ্যক চীনা সৈন্য মারা গেছে। এর ফলে ভারতে ব্যাপক গণক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলরা টেলিভিশনে এসে দাবি জানাতে থাকেন যে ভারতের দরকার চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা। তারা দাবি করতে থাকেন যে কাজটি করতে সামরিক বাহিনী সর্বোচ্চ আত্মবিশ্বাসী। আর ভারতীয় জনসাধারণ চীনা পণ্য বয়কটের কথা বলতে থাকে। কোনো বিকল্পই ভারতের জন্য বিশেষভাবে ভালো নয়। যুদ্ধ হবে ভারতের জন্য ভয়াবহ রকমের ব্যয়বহুল এবং তা দিয়ে দেশটির কৌশলগত উদ্দেশ্য হাসিল হবে না। বরং কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বিকল্প দিয়েই ভারত একদিকে যেমন বৃহত্তর নিরাপত্তা লক্ষ্য হাসিল করতে পারবে, সেইসাথে চীনের ওপর চাপও সৃষ্টি করতে পারবে।
যুদ্ধ কেন কাজ করবে না
ভারতে রণডঙ্কা বাজলেও চীন এই ঘটনার গুরুত্বর খাটো করে দেখছে।যুদ্ধ হিমালয় সীমান্তে চীনের সাথে বিদ্যমান নিরাপত্তা সমস্যার কোনোই সমাধান করবে না। করোনাভাইরাস ও নোট বাতিলকরণের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দার ফলে ব্যয়বহুল যুদ্ধের আশঙ্কা হ্রাস করেছে। তবে যুদ্ধ হলে ভারতের অর্থনৈতিক সঙ্কট আরো বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, ভারত যৌক্তিকভাবেই বলছে যে তারা সীমান্তে অত্যন্ত সুরক্ষিত এবং তাদের পক্ষে তাদের ওই অবস্থান থেকে সরে আসা কঠিন। এ কারণে তারা আত্মবিশ্বাসী যে আরেকটি ১৯৫২ সালের মতো ঘটনা ঘটবে না। উল্লেখ্য, ওই সময় চীনা সৈন্যরা ভারতের অবস্থান গুঁড়িয়ে দিয়ে বেশ ভেতরে প্রবেশ করেছিল। তবে চীনারাও সম্ভবত ১৯৬২ সালের মতো কোনো যুদ্ধে জড়াবে না। তারা বরং তাদের বর্ধিত গতি ও অপেক্ষাকৃত উন্নত গোলাবর্ষণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভারতীয়দের মধ্যে হতাহত বাড়িয়ে তুলবে। ফলে এই আশঙ্কা থাকবে যে যুদ্ধে ভারতের লাভ হবে সামান্যই, কিন্তু এর জন্য মূল্য দিতে হবে বেশ চড়া, কিংবা এমননও হতে পারে, তার নাক ভয়াবহভাবে ভেঙে যেতে পারে এবং তা কাউকে আর দেখানো যাবে না। ভারতের কেউ বিশ্বাস করে না যে ভারতীয় সামরিক বাহিনী ১৯৬২ সালে হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করতে পারবে।
অধিকন্তু, চীনা অর্থনীতি হলো ১৪ ট্রিলিয়ন ডলারের, আর ভারতের ২.৯ ট্রিলিয়ন ডলারের। ফলে যুদ্ধ বেশি সময় ধরে বহন করার সক্ষমতা চীনেরই বেশি। ভারত এই দিবাস্বপ্ন দেখতে পারে যে তারা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, তারপর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক হস্তক্ষেপের সুবিধা পাবে। কিন্তু ভারতের হিসাবমতো সবকিছু চলতে নাও পারে। ২০১৭ সালে ভারতের কম্প্রটোলার ও অডিটর জেনারেল এক রিপোর্টে জানিয়েছিলেন, ভারতের ১০ দিন যুদ্ধ করার মতো গোলাবারুদ আছে।এর পর ভারতীয় সামরিক বাহিনী নিশ্চিতভাবেই রিজার্ভ গড়েছে। কিন্তু তা দিয়ে কত দিন যুদ্ধ চালানো যাবে তা নিশ্চিত নয়।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভারতকে খুব বেশি সমর্থন দেবে না। বরং তারা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করবে। কারণ বর্তমানে তারা চীনের ওপর আর্থিকভাবে খুবই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
আবার ভারত প্রায় তিন দশক ধরে লুক ইস্ট নীতি অনুসরণ করার কথা বলে এলেও কাজের কাজ তেমন হয়নি। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো বরং চীনের অর্থনৈতিক জালে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে আসিয়ান দেশগুলোর ভারতের সাথে থাকার সম্ভাবনা নেই।
চতুর্থত, ভারতের কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিকেরা কোয়াডের কথা বলে এলেও এর সীমাবদ্ধতার বিষয়টি জানেন না। নয়া দিল্লিতে অনেকেই বুঝতে পারছে না যে কোয়াডের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া সোচ্চার হলেও চীনের ওপর তার নির্ভরশীলতা অবসানের কোনো আগ্রহ নেই ক্যানবেরার। ক্যানবেরার প্রধান রফতানি পণ্য হচ্ছে শিক্ষা, পর্যটন, কৃষি ও পরিষেবা। চীনের সাথে সম্পর্ক থাকলে এসব খাতে অস্ট্রেলিয়ার অবস্থা ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অস্ট্রেলিয়া তার তামা ও লোহার বড় অংশ বিক্রি করে চীনের কাছে। চীন বছরে ৬৩ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার মূল্যের লোহার আকরিক, ১৬ বিলিয়ন ডলার মূ্ল্যের প্রাকৃতিক গ্যাস ও ১৪.৬ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কয়লা আমদানি করে অস্ট্রেলিয়ার কাছ থেকে। অস্ট্রেলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিপুলসংখ্যক চীনা ছাত্র পড়াশোনা করে। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে চীন। অস্ট্রেলিয়ার পর্যটন খাতেও চীনাদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বছরে অস্ট্রেলিয়ায় যায় ৮.৫ মিলিয়ন পর্যটক, এদের মধ্যে ১.৪ মিলিয়ন হলো চীনা। পর্যটন খাত থেকে অস্ট্রেলিয়ার আয় হচ্ছে ৪৩.৯ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার, আর এতে চীনা পর্যটকদের কাছ থেকে আসে এর প্রায় ২৫ ভাগ। অস্ট্রেলিয়া বর্তমানে চীনের কাছে ১২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষিপণ্য বিক্রি করে। ফলে চীনের সাথে অস্ট্রেলিয়া সামরিক সঙ্ঘাতে যেতে চাইবে না। ভারত যদি এমন অবস্থায় থাকে যে চীনকে ছাড়াই এসব দেশ ভারতের কাছে তাদের পণ্য সমান পরিমাণে বিক্রি করতে পারবে, তবেই তারা দিল্লিকে যুদ্ধে সমর্থন দেবে। তা না হলে নয়। বলাই বাহুল্য, ভারত ওই অবস্থায় নেই।
ভারতের বিকল্প
ভারতের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য দরকার বিদেশী বিনিয়োগ। আর তা করার জন্য ভারতকে থাকতে হবে জোট নিরপেক্ষ। অর্থনৈতিকভাবে চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করাই হবে ভারতের জন্য অনেক বেশি লাভজনক।
নতুন পররাষ্ট্রনীতি
ভারত ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে জোট নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে আসছিল। ফলে উভয় পরাশক্তির কাছ থেকেই ভারত সহায়তা পাচ্ছিল। কিন্তু ওই নীতি থেকে ভারত সরে আসছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক গড়ছে ভারত। এতে বেশ কিছু সুবিধা পাচ্ছে ভারত।বিশেষ করে সামরিক সম্ভারের দিক থেকে বেশ লাভবান হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য তাকে মূল্যও দিতে হচ্ছে অনেক।
ভারতীয়দের আপত্তি
ভারতের রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদেরা ভারতের কোনো জোটে যোগ না দেযার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছেন। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা বিকিয়ে লাভবান হওয়া যায় না। জাপান, জার্মানি ও ব্রিটেন তাদের স্বায়ত্তশাসন হারিয়েছে। কিন্তু তুরস্ক স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অক্ষুণ্ন রাখায় একদিকে যেমন রাশিয়ার এস-৪০০ বিমান প্রতিরক্ষা সিস্টেম ক্রয় করতে পেরেছে, আবার যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-৩৫ও পাচ্ছে।
আনুষ্ঠানিক মিত্রতা ভারতের নিরাপত্তা সঙ্কট দূর করতে সহায়তা করলেও এতে অনেক সমস্যা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে এতে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাটি আরো বাড়ে।
ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট